সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ব্লগে উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর
প্রশ্ন: ইসলামে দাসদের প্রতি অত্যাচার করার ব্যাপারে জোরালো নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু দাস কেনাবেচা হারাম করে কোর’আনে কোনো নির্দেশ প্রদান করা হয় নি। এটা কি ইসলামের ব্যর্থতা নয়?
উত্তর: খুব সুন্দর প্রশ্ন করেছেন। কোর’আনে দাস কেনাবেচা নিষেধ করে কোনো আয়াত নেই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ইসলাম দাসব্যবস্থাকে সমর্থন করছে। বিষয়টা বুঝতে হলে আরেকটু গভীরে প্রবেশ করতে হবে। প্রথমত, ইসলামে কোনো বিষয় নিষিদ্ধ হবার জন্য কোর’আনে তাকে হারাম উল্লেখ থাকতে হবে এমন কোনো কথা নেই। অনেক বিষয়ই আমরা জানি যেগুলো ইসলামের দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, কিন্তু কোর’আনের কোথাও সেটাকে হারাম বলা হয় নি। দাসব্যবস্থাকে বুঝতে হলে ইসলামের শ্রমব্যবস্থা আগে বুঝতে হবে। শ্রমব্যবস্থার ব্যাপারে ইসলাম যে নীতিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছে সেই নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে প্রকৃতপক্ষে দাসব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকে না। ইসলামী শ্রমব্যবস্থায় শ্রম প্রদান করা হবে দু’টি কারণে। এক, মানবিক দায়বদ্ধতা ও কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে এবাদত মনে করে; দুই অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে। উভয়ক্ষেত্রেই ইসলামের স্পষ্ট নির্দেশনা- শ্রমিকের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তার প্রাপ্য মজুরি পরিশোধ কর, সাধ্যের অতিরিক্ত ভার অর্পণ করো না, নিজে যা খাও শ্রমিকদেরও তা খেতে দাও ইত্যাদি। অর্থাৎ মানবিক দায়বদ্ধতা থেকেই হোক, আর অর্থের বিনিময়েই হোক সবই কিন্তু সেবা, দাসত্ব নয়। এই ভারসাম্যপূর্ণ শ্রমব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই ছিল ইসলামের লক্ষ্য।
দ্বিতীয়ত, যে কোনো আদেশ-নিষেধ প্রদান করার ব্যাপারে ইসলামের নীতি হচ্ছে- আদেশ দানের পূর্বে সে আদেশ পালন করার মতো উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা। একটি উদাহরণ দেই। মদ ইসলামে হারাম। কিন্তু ইসলাম কি হঠাৎ করে মদ হারাম করেছে? ইতিহাস দেখুন, মদ খাওয়া হঠাৎ করে নিষেধ করা হয় নি। মক্কা জীবনে তো রসুল মদের বিরুদ্ধে কোনো কথাই বলেন নি। মদীনায় গিয়ে তারপর প্রথমে নির্দেশ এল মাতাল অবস্থায় সালাতে (নামাযে) যোগ দিও না (সুরা নেসা ৪৩)। এতে সুরা পান অনেকটা কমে গেল। এর বেশ পরে আল্লাহর নির্দেশ এল সুরাপানের মধ্যে ভালও আছে, মন্দও আছে কিন্তু ভালোর চেয়ে ওতে মন্দের ভাগ বেশী (সুরা বাকারা ২১৯)। অত্যন্ত মৃদু নিষেধাজ্ঞা, যেন আল্লাহ øেহ করে বুঝিয়ে বলছেন। আরও কমে গেল মদ খাওয়া। তারপর এল সরাসরি আদেশ মদ খাবে না (সুরা মায়েদা ৯৩)। অর্থাৎ একটু একটু করে বুঝিয়ে-সুজিয়ে আগে জাতিকে মদ না খাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হলো, তারপর এলো নিষেধাজ্ঞা। ঠিক একই কথা প্রযোজ্য দাসপ্রথার ব্যাপারেও। ভুলে গেলে চলবে না দাসপ্রথা একদিনে গড়ে ওঠে নি। হাজার বছরের প্রথাকে রাতারাতি হারাম ফতোয়া দিয়ে বন্ধ করে দেয়া যায় না। দিলে সেটা ইসলাম হতো না। ইসলাম জোরজবরদস্তি স্বীকার করে না। ইসলাম যে বিধান প্রদান করে সে বিধান গ্রহণ করার মতো ক্ষেত্র প্রস্তুত করেই সে বিধান কার্যকর করা হয়। দাস কেনাবেচাকে রাতারাতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। কারণ সেটার সাথে আরবের অর্থনীতি জড়িত। দাস ছিল মালিকের সম্মান ও আভিজাত্যের প্রতীক। তাই রাতারাতি নিষেধাজ্ঞা প্রদান না করে রসুলাল্লাহ একের পর এক দাস আজাদ করে ও অন্যদের আজাদ করতে উৎসাহিত করে জাতিকে বোঝাতে চেয়েছেন যে, মানুষকে দাস হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়। অন্যদেরও তাদেরকে আজাদ করে দেওয়া উচিত। কাবার সম্মান ও মর্যাদা কে না জানে? অথচ মক্কা বিজয়ের দিন আল্লাহর রসুল সেই কাবার চূড়ায় যাকে উঠালেন তিনি হচ্ছেন বেলাল (রা.), যিনি কিছুদিন পূর্বেও দাস ছিলেন। এটা করে তিনি মক্কাবাসীর সমস্ত গর্বকে চূর্ণ করেছেন। তিনিই বলেছেন- আল্লাহর কাছে একজন মু’মিনের সম্মান তার কাবারও ঊর্ধ্বে। আল্লাহ যাদেরকে এত সম্মান দেন তাদেরকে দাস হিসেবে ব্যবহার করতে পারে এমন ¯পর্ধা কার আছে? সর্বশেষে মক্কা বিজয়ের দিনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে তিনি যে আদেশ-নিষেধগুলো প্রদান করেছেন সেগুলো জাতিতে বাস্তবায়িত হলে দাসপ্রথার চিহ্নটুকুও থাকার কথা নয়। এক কথায়, ইসলাম দাসপ্রথাকে নিষিদ্ধ করেছে, কিন্তু যেহেতু ইসলাম হচ্ছে প্রাকৃতিক জীবনব্যবস্থা কাজেই রাতারাতি এরকম কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় নি। হাজার বছরের একটি প্রথা, যার সাথে অর্থনীতির প্রত্যক্ষ সপর্ক, তাকে এক বাক্যে হারাম বলে বন্ধ করতে যাওয়া অপ্রাকৃতিক হতো। কিন্তু এমন পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে যাতে মানুষ স্বেচ্ছায় দাসপ্রথাকে প্রত্যাখ্যান করে।
কিন্তু ইসলাম নামক মহাকল্যাণময় পুষ্প এক শ্রেণির স্বার্থবাদীদের কারণে পুরোপুরি প্রস্ফুটিত হতে পারে নি। এর দায় ইসলামের নয়, ইসলামকে ব্যবহার করে যারা স্বার্থ হাসিল করেছে তাদের। ইসলামী নীতিমালা ১৪০০ বছর পূর্বে যা ছিল আজও সেটাই আছে। সেখানে শ্রমিক-মালিকের সম্পর্ক দাস-মনিবের নয়, ভ্রাতৃত্বের।
উত্তর প্রদান করেছেন: মোহাম্মদ আসাদ আলী, সহকারী সাহিত্য সম্পাদক, হেযবুত তওহীদ।