আবু ফাহাদ
(প্রথম অংশের পর) বর্তমানে আমরা এক ভয়াবহ দুঃসময় অতিক্রম করছি। সামাজিক অন্যায়, নেতৃবৃন্দের অসততা, অঙ্গীকারভঙ্গ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য, হানাহানি ইত্যাদির মধ্যে মানবজাতি নিমজ্জিত হয়ে আছে। আমরা মনে করি, এই অবস্থাটি সৃষ্টির পেছনে কেবল কোনো একক ব্যক্তি বা দল দায়ী নয়, প্রধানত দায়ী হচ্ছে আমাদের সিস্টেম বা জীবনব্যবস্থা। একদিনে হঠাৎ করে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় নি। আমরা যখন বৃটিশ খ্রিস্টানদের গোলাম ছিলাম তখন থেকেই তারা আমাদের উপর আত্মাহীন, স্রষ্টাহীন বস্তুবাদী এক সিস্টেম চাপিয়ে দিয়েছে। ভৌগোলিকভাবে বর্তমানে স্বাধীন হলেও অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও মানসিকভাবে এখনও তারাই আমাদের প্রভু। সেই থেকে আজও তাদের দেওয়া সিস্টেমে আমাদের সবকিছু চলছে। আমরা ভুলেই গেছি যে, আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর নিজের তৈরি একটি সিস্টেম দিয়েছেন, আল্লাহর দেওয়া সেই সিস্টেম আমরা ত্যাগ করে ইহুদী-খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’ অর্থাৎ দাজ্জালের তৈরি সিস্টেম গ্রহণ করে নিয়েছি। এই সমস্ত সিস্টেমে বাস করে কেউ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ভালো হতে পারবে না; কোনোভাবে আইন শৃঙ্খলার উন্নতি ঘটানো যাবে না; ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট ইত্যাদি ঠেকানো যাবে না। বরং দিন দিন পরিস্থিতি আরও ভায়াবহ ও জটিল আকার ধারণ করবে। আফ্রিকা থেকে শুরু করে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রায় সকল দেশে আজ একটি অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন, আন্দোলন, ভাঙচুর, হরতাল, জ্বালাও পোড়াও ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণহানি হচ্ছে। আমাদের দেশও এর বাইরে নয়। ক্ষমতাসীন একটা সরকারকে প্রবল আন্দোলন, জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে টেনে হিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামানো হয়, আরেক দলকে ক্ষমতায় বসানো হয়। তারা এসে আবার পূর্ববর্তী সরকারের মতই দুর্নীতি, লুটপাট, স্বজনপ্রীতি, অর্থ-সম্পদ বিদেশে পাচার ইত্যাদি করতে থাকে। সরকারের বিরুদ্ধবাদীর উপর চলে দমন পীড়ন আর পর্দার অন্তরালে চলে বৈদেশিক প্রভুদের মনোরঞ্জনের প্রতিযোগিতা। এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেখে দেখে মানুষ হতাশ। কিন্তু তাদের কাছে কোনো উত্তম বিকল্প নেই। তাই তারা একবার কড়াই থেকে চুলোয় লাফিয়ে পড়ছে, আবার বাঁচার জন্য লাফিয়ে কড়াইতে উঠছে। এতে করে দিনে দিনে তাদের যন্ত্রণা বাড়ছে এবং বাড়বে, কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ আপনার চলার পথটাই যদি বাঁকা হয় তবে আপনি শত চেষ্টা করেও সোজা চলতে পারবেন না, পথই আপনাকে বাঁকা চলতে বাধ্য করবে। সুতরাং চলমান এই সিস্টেম না পাল্টালে মুক্তি নেই- এটা একেবারে সাফ কথা।
ঠিক অনুরূপ অবস্থা ছিল ইসলাম-পূর্ব আরবের। আরবের গোত্রগুলির মধ্যে তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বেঁধেই চলত, যা পুরুষানুুক্রমে অব্যাহত থাকতো। এই শত্রুভাবাপন্ন গোত্রগুলিই যখন আল্লাহর রসুলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মানবরচিত সকল তন্ত্র-মন্ত্র, বিধি-ব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করে স্রষ্টার দেওয়া জীবনব্যবস্থা গ্রহণ ও সামগ্রিকভাবে প্রয়োগ করেছিল অর্থাৎ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া আর কারও বিধান গ্রহণ করি না) এই মূলমন্ত্রের ভিত্তিতে জীবন পরিচালিত করেছিল, তখন তারা হয়ে গেল বিশ্বজয়ী একটি জাতি। প্রায় নিরক্ষর আরবদের থেকে এমন একটি জাতির উন্মেষ ঘটল যারা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, সামরিক শক্তিতে সকল জাতির শিক্ষকের আসনে অধিষ্ঠিত হলো। আল্লাহর রসুলের আনীত সিস্টেম বা জীবনব্যবস্থা আইয়্যামে জাহেলিয়াতের পরস্পর শত্রুভাবাপন্ন মানুষগুলোকে ভাই বানিয়ে ফেললো। আত্মিক উন্নতির ফলে প্রতিটি মানুষ একেক জন সোনার মানুষে রূপান্তরিত হয়ে গেলেন। চুরি, ডাকাতি প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। অভাব, অনটন, দারিদ্র্য দূর হয়ে সমাজে সমৃদ্ধি আসলো। আজ আমরা রসুলাল্লাহর যে সাহাবীদেরকে আদর্শ মানুষ হিসেবে জানি, তাঁরা আল্লাহর দেওয়া সিস্টেমে প্রবেশের আগেও কি এমনই ছিলেন? না। কিন্তু স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ঠিক তাঁরাই একেকজন মহামানবে পরিণত হন। আজ আমরা তাদের নামের পরে বলি ‘রাদি আল্লাহু আনহুম’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ তাঁর প্রতি খুশি’।
বর্তমানের প্রেক্ষাপটেও আমাদের সকল সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে আল্লাহর দেওয়া সেই অপরূপ, নিখুঁত সিস্টেমটি। মানুষ নামক এই প্রাণী সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ, কাজেই কোন রাস্তায় বা সিস্টেমে সে সুখে থাকবে সেটা ভালো জানেন মহান আল্লাহ। আল্লাহর দেওয়া সিস্টেমই হচ্ছে সরল পথ, কাজেই এর নামই আল্লাহ রেখেছেন সিরাতুল মুস্তাকীম বা সহজ-সরল পথ। আমরা যদি আল্লাহর দেওয়া প্রকৃত ইসলামের রূপরেখা মোতাবেক আমাদের জীবন পরিচালিত করি, আমরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সমষ্টিগত জীবনে পরিপূর্ণ শান্তিতে, প্রগতিতে বাস করতে পারবো। তাই মানবজাতির প্রতি আমাদের আহ্বান- আসুন, আমরা বারবার ব্যক্তিকে পাল্টানোর চিন্তা না করে সিস্টেমটাকেই পাল্টাই। আল্লাহর দেওয়া সিস্টেমই পারে সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার ও রক্তপাতের পথ বন্ধ করে দিতে। সেই সিস্টেম বাস্তবায়নের ফলে আজকের ঘুণে ধরা সমাজের অসৎ মানুষগুলোই একেকজন সোনার মানুষে পরিণত হবে ইনশা’আল্লাহ। মানবজাতি যদি পাশ্চাত্য ইহুদি খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’ দাজ্জালের চাপিয়ে দেওয়া আল্লাহহীন, বস্তুবাদী এই সিস্টেম বাদ দিয়ে আল্লাহর দেওয়া সিস্টেম গ্রহণ করে নেয় তবে সে মুহূর্ত থেকেই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যাবে, ঠিক যেমনটি হয়েছিল ১৪০০ বছর আগে। (চলবে..)