প্রতি বছরের মত এবারেও পালিত হলো আশুরা দিবস। দিবসটি বিভিন্ন কারণে তাৎপর্যপূর্ণ হলেও সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়ে থাকে কারবালার ঐতিহাসিক বিষাদময় ঘটনার কারণে। আজ থেকে সাড়ে ১৩ শ বছর আগে (৬৮০ খ্রি.) ইরাকের কারবালার প্রান্তরে সপরিবারে নবীর প্রিয় দৌহিত্র হোসাইনের শাহাদাৎ বরণের ঘটনা ইসলামের ইতিহাসের এক মর্মান্তিক অধ্যায় হয়ে আছে। এক অসম যুদ্ধে ইমাম হোসাইন (রা) এবং তাঁর ৭২ জন সঙ্গী শাহদাত বরণ করেন।
এই দিনটিতে শিয়া সম্প্রদায় তাজিয়া মিছিলসহ বিভিন্ন মিছিল, মাতম ও শোকানুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে, ‘হায় হোসেন হায় হোসেন বলে’ বুক চাপড়ে, নিজের শরীর নিজে রক্তাক্ত করে শোক প্রকাশ করে, হায় হুতোশ করে। সুন্নিদের মধ্যেও অনেকে আশুরার রোজা রাখে। কিন্তু এই মর্মান্তিক ঘটনাটির প্রকৃত যে গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবনীয় ছিল, তা না শিয়ারা অনুধাবন করতে পারে, না সুন্নিরা। যদি কোনোদিন এই মুসলিম নামক জাতি কারবালার ঘটনাটির সঠিক তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারত তাহলে সেদিনই সমগ্র মুসলিম বিশ্বের চিত্র পাল্টে যেত। ১৬০ কোটির এই জাতিকে বিভ্রান্ত করতে পারত না কোনো ধর্মব্যবসায়ী ফতোয়াবাজ গোষ্ঠী এবং এই জাতিকে পদানত করে রাখতে পারত না কোনো সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী।
আল্লাহর রসুল সারাটিজীবন সংগ্রাম করে গেছেন মানবজীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য। বলার অপেক্ষা রাখে না- উম্মতে মোহাম্মদীর উপরও একই দায়িত্ব অর্পিত ছিল। কিন্তু যখন ইতিহাসে দেখি আল্লাহর রসুলের ওফাতের কয়েক দশক পর নবীজীর দৌহিত্রকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো, তখন এই প্রশ্নটি তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, খোদ নবীর পরিবার-পরিজনই যদি এতখানি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তবে অন্যদের অবস্থা কেমন ছিল? তাহলে কি উম্মতে মোহাম্মদী তাদের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিল? অনেক দেরিতে হলেও ঘটনাটির সঠিক মূল্যায়ন করা অতিব জরুরি হয়ে পড়েছে।
আল্লাহর রসুলের আবির্ভাব: আরবের বিস্ময়কর পরিবর্তন:
ইসলামের চূড়ান্ত সংস্করণ নিয়ে আখেরী নবী, বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা.) এমন এক সময় পৃথিবীতে এসেছিলেন, যে সময়কে আমরা বলি ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ বা অজ্ঞানতার যুগ। এমন নয় যে সে যুগের মানুষ সম্পূর্ণ ধর্মবিমুখ হয়ে গিয়েছিল, আল্লাহ বিশ্বাস করত না, এবাদত-বন্দেগী করত না ইত্যাদি। তা নয়। তৎকালীন আরবরা ধর্মকর্মে কারও চেয়ে পিছিয়ে ছিল না। তারা আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা বলে বিশ্বাস করত, ক্বাবা তাওয়াফ করত, তাদের পদ্ধতিতে নামাজ পড়ত, রমজান মাসে রোজা রাখত, দান-খয়রাত করত, মানত করত, খাৎনা করত এবং নিজেদেরকে মিল্লাতে ইব্রাহীম বলে দাবি করত। কোনো ভালো কাজ শুরু করার আগে উচ্চারণ করত- বিসমিকা আল্লাহুম্মা। অর্থাৎ প্রচলিত অর্থে ধর্মকর্ম বলতে যা বোঝানো হয় তা ওই সমাজেও ছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় আচার-আচরণ, এক কথায় অত ধর্মকর্ম থাকার পরও ওই যুগকে জাহেলিয়াতের যুগ বলার কারণ তারা ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করত না। ফলে অন্যায়, অবিচার, হানাহানি, রক্তপাত, শত্রুতা, জিঘাংসা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, দাঙ্গা-হাঙ্গামায় ভরা ছিল তাদের সমাজ। সেখানে চলত ‘Might is Right’ এর শাসন। শক্তি যার হাতে, ক্ষমতা যার হাতে, তার কথাই ন্যায় বলে সাব্যস্ত হত। একক নেতৃত্ব, একতাবোধ, শৃঙ্খলাবোধ, আনুগত্যবোধ- কিছুই ছিল না। কৃষি বা ব্যবসা উভয়ক্ষেত্রেই তারা ছিল অনগ্রসর। অভাব, দারিদ্র, অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর বর্বরতার দরুন তৎকালীন পৃথিবীতে তারা গণ্য হত সর্বাধিক উপেক্ষিত, অবজ্ঞাত ও মর্যাদাহীন জনগোষ্ঠী হিসেবে। সভ্য জাতিগুলো তাদেরকে দেখত অবহেলা ও ঘৃণার দৃষ্টিতে। আল্লাহর রসুল তাদেরকে ন্যায়-অন্যায় শেখালেন। ধর্ম-অধর্মের পার্থক্য জানালেন। শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মত্যাগী, আত্মোৎসর্গকারী বিপ্লবী হবার প্রেরণা যোগালেন। অনৈক্য, দাঙ্গা-হাঙ্গামায় লিপ্ত মানুষগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করলেন, শৃঙ্খলাবোধ শেখালেন। কীভাবে নেতার কথাকে দ্বিধাহীনভাবে, প্রশ্নহীনভাবে মেনে নিয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় সে শিক্ষা দিলেন। ফলে অল্পদিনের মধ্যে আরবজাতিটির মধ্যে এমন বিস্ময়কর পরিবর্তন সাধিত হলো যা সমকালীন বিশ্বে কল্পনারও অতীত ছিল।
উম্মতে মোহাম্মদীর দায়িত্ব কী ছিল?
আখেরী নবীর আগমনের পূর্বেও অনেক নবী-রসুল পৃথিবীতে এসেছিলেন। তাদের সাথে বিশ্বনবীর একটি বৃহৎ পার্থক্য হলো এই যে, আগের সমস্ত নবীর দায়িত্ব ছিল সীমিত পরিসরে, যার যার এলাকায় সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে শেষ নবীর দায়িত্ব সমস্ত পৃথিবীব্যাপী (সুরা ফাতাহ ২৮)। কিন্তু কাজ সবারই এক, সেটা হচ্ছে মানবজীবনে ন্যায়, সুবিচার, নিরাপত্তা অর্থাৎ শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহর দেওয়া দ্বীনুল হক্ব প্রতিষ্ঠিত হলে সেই প্রত্যাশিত ‘শান্তি’ আসবে বলেই এই দ্বীনের নামকরণ করা হয়েছে ইসলাম অর্থাৎ শান্তি।
আল্লাহর রসুল তাঁর নবুয়্যতি জিন্দেগীতে যা কিছু বলেছেন ও করেছেন সবই সমাজের নিরাপত্তার জন্য, মানুষের শান্তির জন্য। কিন্তু সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায় কোনো মানুষের একার পক্ষে এতবড় দায়িত্ব সম্পন্ন করা অসম্ভব। তাই আল্লাহর রসুল সারাজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে সমগ্র আরব উপদ্বীপে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার পর বাকি পৃথিবীতেও একইভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার, সুবিচার, সাম্য, মৈত্রী এক কথায় ‘শান্তি’ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অর্পণ করলেন উম্মতে মোহাম্মদীর উপর, যে জাতিটিকে তিনি নিজ হাতে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন।
তিনি বারবার জাতিকে সতর্ক করলেন যাতে তিনি দুনিয়া থেকে চলে যাবার পরও তাঁর সুন্নাহ (শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম) ছেড়ে দেয়া না হয়। বলেছেন- ‘যে আমার সুন্নাহ ত্যাগ করল সে আমার কেউ নয় আমিও তার কেউ নই।’ আল্লাহর রসুল জানতেন এই মহাদায়িত্ব পূরণ করার জন্য উম্মতে মোহাম্মদীর যে জাতীয় চরিত্র দরকার তার মধ্যে প্রথম ও প্রধান হচ্ছে ‘ঐক্য’। তাই কোনোভাবেই যাতে উম্মাহর ঐক্যে ভাঙ্গন না ধরে সেজন্য সারাজীবন তিনি জাতিকে হাজারো উপদেশ তো দিয়েছেনই, ঐক্যভঙ্গের কোনো কথা বা আচরণ দেখলেই তিনি রেগে লাল হয়ে যেতেন। সর্বশেষ বিদায় হজ্বের ভাষণে, যে ভাষণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে শেষবারের মত স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন, সেখানে পুনরায় বললেন, ‘‘আজকের এই দিন, এই মাস, এই শহর যেমন পবিত্র, তোমাদের একের জন্য অপরের জান, মাল, ইজ্জত ততটাই পবিত্র। আমার পরে তোমরা একে অপরকে খুনোখুনি করে কুফরিতে ফিরে যেও না।’’ আরেকটি হাদীসে রসুলাল্লাহ বলেন, ‘‘আল্লাহ আমাকে পাঁচটি কাজের আদেশ করেছেন। আমি তোমাদেরকে সেই পাঁচটি কাজের দায়িত্ব অর্পণ করছি।
(১) তোমরা ঐক্যবদ্ধ হবে।
(২) (তোমাদের মধ্যবর্তী আদেশকারীর কথা) শুনবে।
(৩) (আদেশকারীর হুকুম) মান্য করবে।
(৪) (আল্লাহর হুকুম পরিপন্থী কার্যক্রম থেকে) হেজরত করবে।
(৫) আল্লাহর রাস্তায় জীবন-সম্পদ দিয়ে জেহাদ (সংগ্রাম) করবে।
যারা এই ঐক্যবন্ধনী থেকে এক বিঘত পরিমাণও দূরে সরে যাবে, তার গলদেশ থেকে ইসলামের বন্ধন খুলে যাবে যদি না সে তওবা করে ফিরে আসে। আর যে জাহেলিয়াতের কোনো কিছুর দিকে আহ্বান করে সে জাহান্নামের জ্বালানি পাথরে পরিণত হবে, যদিও সে নামাজ পড়ে, রোজা রাখে এমন কি নিজেকে মুসলিম বলে বিশ্বাসও করে [হারিস আল আশয়ারী (রা.) থেকে আহমদ, তিরমিজি, বাব-উল-ইমারত, মেশকাত]।’’ এখানেও একই কথা। ঐক্য নষ্ট করার অর্থ ইসলাম থেকে বহির্গত হয়ে যাওয়া।
আল্লাহর রসুলের এই শিক্ষাকে, ঐক্যের গুরুত্বকে সঠিকভাবে ধারণ করতে পেরেছিল বলেই পৃথিবীর সবচেয়ে পশ্চাদপদ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বর্বর, দাঙ্গাবাজ, অশিক্ষিত, অসভ্য ও নৈতিকভাবে অধঃপতিত একটি জাতি মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে একটি সভ্য, ঐক্যবদ্ধ, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও আধুনিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতিতে পরিণত হয়েছিল, একটি ‘সম্ভাবনাহীন উপাদান বা শূন্য’ (পি. কে হিট্টির ভাষায়) থেকে বিরাট এক বটবৃক্ষের জন্ম হতে পেরেছিল। যারা কিছুদিন আগেও ক্ষুদ্রতায় ডুবে ছিল, তারাই এমন সোনার মানুষে পরিণত হলো যাদের নামের শেষে আমরা বলি- ‘রাদিআল্লাহু আনহু ওয়া রাদু আনহুম।’ আল্লাহর রসুলের ওফাতের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাতে গড়া জাতিটি পারমাণবিক বোমের মত বিস্ফোরিত হয়ে তৎকালীন পৃথিবীর দুইটি সুপার পাওয়ার রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যকে এক এক করে নয়, একইসাথে ঝড়ের মুখে তুলোর মত উড়িয়ে দিল এবং মাত্র ৬০/৭০ বছরের মধ্যে অর্ধপৃথিবীর শাসনকর্তায় পরিণত হলো। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, সামরিক শক্তিতে, শিল্প-সাহিত্যচর্চায় সমস্ত দিক দিয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন হলো- যে ইতিহাস লিখতে গিয়ে পাশ্চাত্যের খ্রিস্টান পণ্ডিতরাও বারবার বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
আল্লাহর রসুল ইন্তেকাল করলেন নবুয়তের ২৩তম বছরে, ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে। সমগ্র নবুয়তি জিন্দেগীতে কঠোর অধ্যাবসায় ও সংগ্রামের মাধ্যমে তওহীদের ভিত্তিতে যেই ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্ত্বা তিনি গঠন করেছিলেন তাঁর ইন্তেকালের পরও সেই ঐক্য বলবৎ ছিল। জাতি আবু বকর (রা.) এর খেলাফতের অধীনে ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ ছিল। আবু বকর (রা.) আড়াই বছর খেলাফত করার পর ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করলেন। আবু বকরের (রা.) পর জাতির ইমাম হলেন ওমর ফারুক (রা.)। তখনও জাতি ঐক্যবদ্ধ। নেতার হুকুমে জীবন দিতে প্রস্তুত হাজার হাজার মো’মেন-মো’জাহেদ। দীর্ঘ ১০টি বছর জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার পর ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে ওমর ফারুক (রা.) ইন্তেকাল করলেন এবং জাতির ইমাম হলেন উসমান বিন আফফান (রা.)। উসমান (রা.) এর শাসনামলেই সর্বপ্রথম জাতির মধ্যে বেজে উঠল ভাঙনের সুর। বিভিন্ন ইস্যু সৃষ্টি করে একটি গোষ্ঠী উসমান (রা.) এর বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডায় লিপ্ত হলো এবং ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে ফতোয়া দিতে লাগলো যে, উসমান (রা.) মুরতাদ হয়ে গেছেন, তিনি খলিফা থাকার যোগ্য নন! ফতোয়া মোতাবেক ইসলামী শাসনাধীন এলাকা বুসরা, কুফা ও মিসর থেকে সশস্ত্র বিদ্রোহী দল মদীনায় এসে উসমান (রা.) এর ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালাল। যেই উসমান (রা.) ইসলামের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, যিনি দীন প্রতিষ্ঠার জিহাদে বারংবার দুই হাত উজাড় করে দান করতেন, তাবুকের অভিযানে যিনি একাই দশ হাজার সৈন্যের যুদ্ধাস্ত্র ও রসদের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন, যাকে বিশ্বনবী তাঁর দুই কন্যার সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন, যিনি দশজন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্তদের মধ্যে অন্যতম বলে ধরা হয়, যাঁকে গৃহে প্রবেশ করতে দেখলে রসুলাল্লাহ বসন সংযত করে সম্মান প্রদর্শন করতেন- সেই উসমান (রা.) এর উপর তলোয়ার চালাতে দ্বিধা করল না বিদ্রোহীরা, এমনকি তার লাশ দাফন করতে পর্যন্ত বাধা দেওয়া হয়েছিল। ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র কোর’আন পাঠরত অবস্থায় উসমান (রা.) শহীদ হন। আর তা থেকেই সূচিত হয় মুসলিম জাতির কলংকজনক, হতাশাজনক, দুর্ভাগ্যজনক এক কালো অধ্যায়ের।
বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা.) জাতিকে আকিদা শিক্ষা দিয়ে ও কর্মসূচি শিক্ষা দিয়ে যেই তলোয়ার হাতে তুলে দিয়েছিলেন পৃথিবী থেকে শিরক ও কুফরকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে, সেই তলোয়ার এবার ব্যবহৃত হতে লাগলো মুসলিমদের, এমনকি রসুলাল্লাহর জলিল কদর সাহাবিদের একে অপরের রক্ত ঝরানোর কাজে। জাতি ভুলে গেল ঐক্য নষ্ট করা কুফর, যারা করবে তারা কাফের, তারা ইসলাম থেকেই বহির্গত হয়ে যাবে, জাহান্নামের জ্বালানি পাথর হবে যদিও তারা নামাজ পড়ে, রোজা রাখে এবং নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবি করে। উম্মাহর জাতীয় জীবনে নেমে এলো ভয়াবহ বিপর্যয়কাল। বিদায় হজ্বের ভাষণে আল্লাহর রসুল যে ‘ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত’ এর আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটাই বাস্তবে রূপ নিল।
এমনকি এই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ-রক্তপাতে উম্মুল মু’মিনিন আয়েশা (রা.)-কে পর্যন্ত জড়িয়ে ফেলা হলো। উসমান (রা.) এর শাহাদাতের পর একদিকে আলী (রা.) খলিফা হলেন, আরেকদিকে মুয়াবিয়া (রা.) সিরিয়ায় স্বাধীনভাবে শাসনকার্য চালাতে লাগলেন। তিনি বললেন, উসমান হত্যার বিচার না করা পর্যন্ত আলীর (রা.) হাতে বাইয়াত নিবেন না। এরই পরিণতিতে আলী (রা.) এর সাথে মুয়াবিয়া (রা.) এর বাহিনীর রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হলো যা ইতিহাসে ‘সিফফিনের যুদ্ধ’ নামে খ্যাত। মুসলমানের হাতে হাজার হাজার মুসলমানের রক্ত ঝরল, প্রাণ গেল। এই অনৈক্য, এই ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত জাতিকে এমনভাবে পেছনে টেনে ধরল যে, জাতি আর সামনে এগোতেই পারল না। যে প্রচণ্ড গতি নিয়ে তারা যাত্রা শুরু করেছিল, মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে অর্ধপৃথিবীর চিত্র পাল্টে দিতে পেরেছিল সেই জাতিই গতি হারিয়ে, নিজেরা নিজেরা সংঘাতে জড়িয়ে স্থবির হয়ে পড়ল। এ সময় ধর্মীয় অপব্যাখ্যা দিয়ে একটি গোষ্ঠী মুসলিম সংহতি থেকে নিজেদেরকে “খারিজ” বা বিচ্ছিন্ন করে নিল এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হলো বর্তমান যুগের জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলোর মত। এই গোষ্ঠী অতীতে যেভাবে উসমানকে (রা.) ইসলামের শত্রু আখ্যা দিয়ে হত্যা করেছিল এবং সেই হত্যাকাণ্ডকে কোর’আন হাদিস দিয়ে জায়েজ করতে চেয়েছিল ঠিক সেভাবেই ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে রসুলাল্লাহর জামাতা, ইসলামের ইতিহাসের সাহসী বীর যোদ্ধা আলীকেও (রা.) হত্যা করল। মাত্র দশ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করে রসুলাল্লাহর নবুয়ত-লগ্ন থেকেই যিনি ইসলামের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন, ছোটবেলা থেকেই যিনি রসুলাল্লাহর সংসারে লালিত-পালিত হয়েছেন, যার আর্থিক অনটন সত্ত্বেও রসুলাল্লাহ যার সাথে স্বীয় কন্যা ফাতেমাকে বিয়ে দিয়েছিলেন, যিনি খায়বার যুদ্ধে চরম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে কীংবদন্তি হয়ে আছেন যুগ যুগ ধরে, যার উপাধী হচ্ছে আসাদুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর সিংহ- সেই আলীও (রা.) ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যার ফলে ও জাতির অন্তর্কোন্দলের মুখে শাহাদাৎবরণ করলেন অত্যন্ত নির্মমভাবে।
হায়! যদি এখানেই শেষ হত অনৈক্যের! আর কোনো মুসলমানের হাত রঞ্জিত হত না মুসলমানের রক্তে! কিন্তু না। তখনও অনেক কিছুই ঘটার বাকি। ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের যে গরল তারা গলাধঃকরণ করে ফেলেছে তার প্রতিক্রিয়া এত সহজে নিঃশেষ হলো না। ঐ শত্রুতা, ঘৃণা ও বিদ্বেষ এক প্রজন্ম থেকে সংক্রমিত হলো পরবর্তী প্রজন্মে। যে জাতির হাতে দায়িত্ব ছিল সমস্ত পৃথিবীতে ন্যায়, সাম্য, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করে পৃথিবীর অত্যাচারিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষকে মুক্তি দেওয়া, তারা নিজেরাই মারামারি, খুনোখুনিতে মেতে উঠল। এই ভ্রাতৃঘাতী বিদ্বেষ কত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল তারই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত আশুরার বিষাদময় হত্যাযজ্ঞ। আল্লাহর নবীর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, যিনি কিনা রসুলের কোলে বসে, পিঠে চড়ে খেলা করতেন, যার গলদেশে, গণ্ডদেশে, মস্তকে আল্লাহর নবীর পবিত্র ¯্নহেচুম্বনের স্পর্শ, যার সম্পর্কে আল্লাহর নবী বলেছেন যে, হাসান-হোসাইনের সাথে যে ব্যক্তি বিদ্বেষ পোষণ করল সে আমার সাথেই বিদ্বেষ পোষণ করল, নবীজীর সেই অতি আদরের দৌহিত্রের মস্তকও ছিন্ন হলো ধারালো তরোবারির আঘাতে।
আলীর (রা.) পর মুয়াবিয়া (রা.) এর হাতেই পূর্ণ ক্ষমতা চলে গিয়েছিল। মুয়াবিয়া (রা.) খলিফা হিসেবে মুসলিম ভূখণ্ড শাসন করছিলেন। কিন্তু জাতিবিনাশী অন্তর্কোন্দল, ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা, ষড়যন্ত্র, অস্থিতিশীলতা বন্ধ থাকেনি একদিনের জন্যও। আলী (রা.) এর শাহাদাতের পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন ইমাম হাসান (রা.)। ওদিকে মুয়াবিয়া (রা.) খলিফা হিসেবে সিরিয়াসহ বিভিন্ন এলাকা শাসন করে চলেছেন। হাসান (রা.) প্রথমে চেষ্টা করলেন যুদ্ধের মাধ্যমে মুয়াবিয়াকে (রা.) পরাজিত করে খেলাফত সুসংহত করতে কিন্তু বাস্তবতা উপলব্ধি করে মুয়াবিয়ার (রা.) সাথে সন্ধি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সন্ধির অন্যতম শর্ত ছিল এই যে, মুয়াবিয়ার (রা.) ইন্তেকালের পর হাসান (রা.) বা হোসাইন (রা.) হবেন মুসলিম বিশ্বের খলিফা। যেহেতু মুয়াবিয়ার (রা.) পূর্বেই ৬৭০ খ্রিস্টাব্দে ইমাম হাসান মৃত্যুবরণ করেন, কাজেই খলিফা দাবিদার বলতে ইমাম হোসাইনই (রা.) অবশিষ্ট থাকলেন। সবাই ধরেই নিল সম্ভাব্য খলিফা হচ্ছেন ইমাম হোসাইন (রা.)। কিন্তু ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর পূর্বে মুয়াবিয়া (রা.) পুত্র ইয়াজিদকে পরবর্তী খলিফা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে গেলেন- যা অনেকেই মেনে নিতে পারলেন না। ইমাম হোসাইন (রা.) ইয়াজিদের হাতে বাইয়াত না নিয়ে বরং নিজেই খেলাফতের দায়িত্ব পালনের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। দেখা গেল ইয়াজিদের পক্ষ থেকে ইমাম হোসাইনকে বিবেচনা করা হচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহী ও ইসলামী খেলাফতের শত্রু হিসেবে, অন্যদিকে ইমাম হোসাইনের সমর্থকরা ইয়াজিদকে বিবেচনা করছে ইসলামের দুশমন হিসেবে। পরিণতি সেদিকেই গড়ালো যেমনটা অতীতে উসমান (রা.) ও আলী (রা.) এর ক্ষেত্রে ঘটেছিল। যেই ফতোয়াবাজি ও ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যার ফলে উসমান ও আলীর (রা.) মত ব্যক্তিত্ব প্রাণ হারিয়েছিলেন, তা ইমাম হোসাইনকেও ছাড়ল না। ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে সপরিবারে শাহাদাৎবরণ করলেন ইমাম হোসাইন (রা.)। ইমাম হোসাইনের রক্তে সিক্ত কারবালার ভূমিতে সেদিন যে বিষবৃক্ষের চারা গজিয়েছিল পরবর্তী হাজার বছরে সেই বৃক্ষের ডালপালা বিস্তৃত হয়ে ইসলামের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে চলেছে। জাতি সেদিনই দেউলিয়া হয়ে গেছে। জাতির পতনের পর্ব শুরু হয়েছে। সেই থেকে আজ অবধি ১৩০০ বছরের ইতিহাস- জাতির অনৈক্য/সংঘাতের ইতিহাস। শত্রুতা ভুলে উম্মতে মোহাম্মদীর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার জন্য শিয়াও ফিরল না, সুন্নিও ফিরল না। যাদের বিকৃত ফতোয়াবাজি উসমান (রা.) এর প্রাণ নিয়েছিল, আলী ও মুয়াবিয়াকে (রা.) একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছিল, ইয়াজিদের বাহিনীর হাতে ইমাম হোসাইনের (রা.) মস্তক ছিন্ন করিয়েছিল- সেই ফতোয়াবাজদের উত্তরসূরীরা আজও নিঃশ্বাস ফেলছে জাতির ঘাড়ে। প্রতিপক্ষকে কাফের, মুরতাদ, ইহুদির দালাল, ইসলামের দুশমন ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে মুসলিমদেরকেই মুসলিমদের বিরুদ্ধে লাগিয়ে রেখেছে। শিয়া-সুন্নি বিরোধ কেবল শাসনক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক বিরোধই ছিল না, এখানে ধর্মের নামেও অনেক রাজনীতি জড়িয়ে ছিল। আর আজও শিয়া সুন্নী এই দুটো বৃহৎ বিভক্তি মুসলিম জাতিকে খণ্ডিত করে রেখেছে যার ফায়দা লুটছে পাশ্চাত্যের পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো। তারা এই উভয়পক্ষের কাছে তাদের অস্ত্র বিক্রি করছে, তাদেরকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে যুদ্ধ বাধাচ্ছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ মেরে খনিজসম্পদ লুটে নিচ্ছে।
আজ সারা বিশ্ব চালাচ্ছে অত্যাচারীরা। মুসলিম জনগোষ্ঠীকে যে যেভাবে পারছে বিনাশ করে চলেছে। এদের দেশগুলো দখল করে নিচ্ছে। শিশুদের পাখির মত গুলি করছে, নারীদের সম্ভ্রম কেড়ে নিচ্ছে, বাড়িঘর থেকে উৎখাত করে খোলা সমুদ্রে ডুবিয়ে মারছে। আর যাদের দায়িত্ব ছিল দুনিয়াকে এই অত্যাচারীদের হাত থেকে মুক্ত রাখা, তারা সেই দায়িত্বের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে নিজেরা নিজেরা কামড়াকামড়ি করছে, রক্তারক্তি করছে, বংশানুক্রমিক প্রতিহিংসার চর্চা করে নিজেরা ধ্বংস হচ্ছে অন্যকেও ধ্বংস করছে। হাজার বছর আগের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার ভিত্তিতে আজও কেউ পরিচয় দিচ্ছে শিয়া, কেউ পরিচয় দিচ্ছে সুন্নি। তারপর শিয়ারা ইরানের নেতৃত্বে হয়েছে এক ব্লক, সুন্নিরা সৌদির নেতৃত্বে হয়েছে আরেক ব্লক। কারো ঘাড়ে চেপেছে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা, কারো ঘাড়ে চেপেছে রাশিয়া। আমরা যখন কারবালায় প্রাণ হারানো শিশুদের জন্য আহাজারি করছি তখন শিয়া-সুন্নি বিবাদের জের ধরে ইয়েমেনে ৫২ লাখ শিশু দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। মধ্যপ্রাচ্যে এখন প্রতিটি দিনই কারবালার দিন। এখনও যদি এদের হুঁশ না ফেরে তাহলে ঐ শিয়ারা যে পারস্য নিয়ে গর্ব করে সেই পারস্যও থাকবে না, আর সুন্নিরা যে আরব নিয়ে বড়াই করে সেই আরবের গৌরবও নিশ্চিহ্ন হবে। এটা ভবিষ্যদ্বাণী নয়, এটা হলো কর্মফল, পরিণতি।
১৩০০ বছর ধরে কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনা স্মরণ করে হায়-হুতোশ ও মাতম কম হলো না। তাতে কী লাভ হয়েছে? ন্যায় আজও পরাজিত, আর অত্যাচারী যালেমরা দোর্দণ্ড প্রতাপে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এর কারণ আমরা কারবালার ইতিহাসে পড়ে আবেগাপ্লুত হয়ে চোখের পানি ফেলতে অভ্যস্ত, কিন্তু এই ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে অভ্যস্ত নই। যদি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতাম, যদি নির্মোহ পর্যালোচনা করে সমস্যার গোড়ায় প্রবেশ করতে পারতাম তবে মুসলিমদের জন্য সারা পৃথিবী কারবালায় পরিণত হত না। এই মাতম অর্থহীন, এটা কোনো জীবন্ত জাতির কাজ নয়। আজ আমাদের প্রথম যেই পদক্ষেপ দরকার সেটা হলো- অতীতকে অতীতের জায়গায় রেখে বর্তমানে সমাধানের রাস্তা খুঁজে নেওয়া। একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেছে, এখন আমরা চাইলেও কি সেটা মুছে ফেলতে পারব? পারব না। আমরা শুধু সেই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে পারব এবং বর্তমানে সেই শিক্ষাটি কাজে লাগাতে পারব। কাজী নজরুল বলেছেন, ‘‘ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাই না।’’ আসুন বৃথা মাতম করা ছেড়ে ন্যায়প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেদের জীবন ও সম্পদকে ত্যাগ করা শিখি। ত্যাগ করি বিভাজনকে। ত্যাগ করি তাদেরকে যারা বিভাজন সৃষ্টি করতে চায়। পুনরায় তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হই। যেই তওহীদের রজ্জু আল্লাহর রসুল আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই তওহীদই হোক আমাদের নব-সভ্যতা নির্মাণের ভিত্তি।