রাশেদুল হাসান:
ইসলামের যে কোনো কাজের বিনিময়ে পার্থিব সম্পদ গ্রহণ যেমন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, তেমনি সত্য, ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কাজেও কাফের, মোশরেক ও মোনাফেকদের কাছ থেকেও কোনো প্রকার আর্থিক সাহায্য গ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটা আল্লাহর সিদ্ধান্ত যে, সমগ্র পৃথিবীতে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবেই এতে কারো করুণার দরকার নেই এবং এই সত্য প্রতিষ্ঠা করবে মো’মেনরা। সত্য প্রতিষ্ঠায় আল্লাহ একমাত্র মো’মেনদের জানমাল দাবি করেছেন। মো’মেনরা যেহেতু কাফের, মোশরেক, মোনাফেকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে কাফেরদের তৈরি করা বিধান উৎখাত করে দিয়ে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করবে সেহেতু কাফেরদের নিকট থেকে কোনো অর্থ সাহায্য গ্রহণ করা যুক্তিসংগতভাবেই নিষেধ হয়ে যায়। নবী করীম (সা.) এর জীবনীতে আমরা কোথাও দেখতে পাই না যে, দীন প্রতিষ্ঠায় কোনোদিন তিনি কাফের মোশরেকদের দান, অনুদান গ্রহণ করেছেন, বরং আমরা দেখি মোনাফেকদের কেহ কেহ বলেছিল আমরা সংগ্রামে যাব না কিন্তু টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে চাই। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন মোনাফেকদের অর্থ গ্রহণ না করার জন্য। আল্লাহ বলেন, আপনি বলুন, তোমরা ইচ্ছায় অর্থ ব্যয় কর বা অনিচ্ছায়, তোমাদের থেকে তা কখনো কবুল হবে না, তোমরা নাফরমানের দল। তাদের অর্থ ব্যয় কবুল না হওয়ার এছাড়া আর কোনো কারণ নেই যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি অবিশ্বাসী, তারা নামাযে আসে অলসতার সাথে ব্যয় করে সঙ্কুচিত মনে। সুতরাং তাদের ধন-স¤পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন আপনাকে বিস্মিত না করে। আল্লাহর ইচ্ছা হলো এগুলো দ্বারা দুনিয়ার জীবনে তাদের আযাবে নিপতিত রাখা এবং প্রাণবিয়োগ হওয়া কুফরী অবস্থায়। [সুরা তাওবা: ৫৩-৫৫]
উক্ত আয়াত দ্বারা কয়েকটি বিষয় পরিস্কার হয়ে যায়। যেমন ইসলামে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের গুরুত্ব। যারা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে না তারা আল্লাহর দৃষ্টিতে মোনাফেক পদবাচ্য। তারা বাহ্যিকভাবে নবীকে নবী বলে স্বীকার করে নিয়েছে এবং সালাহ কায়েম করে, যদিও তা হচ্ছে এদের লোক দেখানো। এদের লক্ষণ (১) এরা সংগ্রাম করতে ইচ্ছুক নয়, (২) এরা সালাতে দাঁড়ায় শৈথিল্যের সাথে (ঢিলেঢালাভাবে) অর্থাৎ আল্লাহর রসুল যেভাবে সালাহ কায়েম করতে বলেছেন সেভাবে করে না।
বর্তমান মুসলিম বলে পরিচিত এই জাতির অধিকাংশই ভালোভাবে মোনাফেকের এই লক্ষণ দু’টি ধারণ করেছে। এরা আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করার কথা শুনলেই তাদের আত্মা শুকিয়ে যায়। কেবল সংগ্রামে অনাগ্রহীই নয়, তারা জাতিগতভাবেই এখন ইসলামকে তাদের দীন হিসাবে পছন্দ করে না। তাদের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ দীন হচ্ছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র। আর যারা চায় সত্যদীন প্রতিষ্ঠা হোক, সত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন সংগঠন ও আন্দোলন করে (যদিও তারা যেটা প্রতিষ্ঠা করতে চায় সেটা আল্লাহর প্রকৃত দীন নয়), তারা দীন প্রতিষ্ঠার কাজে সবার কাছ থেকেই অর্থ গ্রহণ করতে প্রস্তুত, গণতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী তো বটেই অন্য ধর্মের অনুসারীদের অর্থেও তাদের কোনো আপত্তি নেই।
সুতরাং কেউ আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে কেবলমাত্র মো’মেন ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে কোনরূপ দান গ্রহণ করা যাবে না। বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বুঝতে হলে মো’মেন ও কাফেরের পরিচয় সঠিকভাবে জানা প্রয়োজন। আল্লাহ বলেছেন, মানুষ দুই প্রকার; মো’মেন ও কাফের (সুরা তাগাবুন ২)। মো’মেন ও কাফেরের পরিচয় ও সংজ্ঞা তিনি পবিত্র কোর’আনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যেন কোন অবস্থাতেই এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মানুষের মধ্যে কোনরূপ মতদ্বৈততা, দ্বিধা, দ্বন্দ্ব সৃষ্টি না হতে পারে। মো’মেন হওয়ার যে সংজ্ঞা আল্লাহ দিয়েছেন সুরা হুজরাতের ১৫নং আয়াতে সেখানে আল্লাহ দু’টি শর্ত আরোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, “সত্যনিষ্ঠ মো’মেন শুধুমাত্র তারা যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের উপর ঈমান আনয়নের পর আর কোনরূপ সন্দেহ করে না এবং জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় সর্বাত্মক সংগ্রাম (সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য) করে।” বর্তমানের মুসলিম নামধারী জাতিটি আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে মৌখিকভাবে স্বীকৃতি দিলেও প্রকৃতপক্ষে বিশ্বাস করে না, কারণ বিশ্বাস করলে তারা আল্লাহ ও রসুলের বিধান পরিত্যাগ করে ভোগবাদী পাশ্চাত্য ইহুদি খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’ দাজ্জালের বানানো গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র গ্রহণ করত না। এছাড়াও আল্লাহ কোর’আনে কাফেরের যে সংজ্ঞা দিচ্ছেন তার সঙ্গে এই জাতির কর্মকাণ্ড পুরোপুরি মিলে যায়। আল্লাহ বলেন, আল্লাহ যে আইন, বিধান নাযেল করেছেন তা দিয়ে যারা হুকুম করে না অর্থাৎ শাসনকার্য, বিচার ফায়সালা পরিচালনা (এখানে বিচার অর্থে আদালতের বিচার, শাসনকার্য সব বুঝায়, কারণ শব্দটা হুকুম) করে না তারাই কাফের, জালেম, ফাসেক (সুরা মায়েদা- ৪৪, ৪৫, ৪৭)। এখানে আল্লাহ-রসুলের প্রতি বিশ্বাস ও কোন প্রকার এবাদত করা বা না করার শর্ত রাখা হয় নি। অর্থাৎ যারা আল্লাহর কোর’আনে দেওয়া আইন, বিধান দিয়ে শাসনকার্য ও বিচার ফায়সালা সম্পাদন করে না তারা যত বড় মুসুল্লিই হন, যত বড় মুত্তাকি, আলেম, দরবেশ, পীর-মাশায়েখ হোন না কেন কার্যতঃ কাফের। এই আয়াতের অর্থে সমস্ত পৃথিবীর মুসলিম বলে পরিচিত এই জনসংখ্যা কার্যতঃ কাফের, জালেম এবং ফাসেক। তারা সুদভিত্তিক অর্থনীতি মেনে নেওয়ার কারণে এবং বিভিন্ন হারাম উপায়ে উপার্জন করার কারণে তাদের টাকা হয়ে যায় অপবিত্র; সেই অপবিত্র টাকার দান আল্লাহ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন।
এ কারণে বর্তমানের নামধারী মুসলিমদের কাছ থেকেও কোনরূপ অর্থ নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রামে ব্যয় করা যাবে না কারণ ওদের অর্থ আল্লাহ গ্রহণ করেন না। কিন্তু আমরা দেখি, বর্তমান দুনিয়ায় যে কয়টি সংগঠন ইসলাম প্রতিষ্ঠার কথা বলে তারা তাদের সংগঠনের সদস্য ছাড়াও অন্যান্য দল বা ব্যক্তির নিকট থেকে অর্থ, টাকা-কড়ি সংগ্রহ করে, চাঁদা আদায় করে। শুধু তাই নয়, এরা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য জাতি থেকে অর্থ জোগাড় করে। কিন্তু হেযবুত তওহীদ প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই যামানার এমাম এ বিষয়ে খুবই সতর্ক। এমামুযযামান যখন হেযবুত তওহীদ গঠন করেন তখন তাঁর মনে চিন্তা এসেছিল যে একটি আন্দোলন করতে বহু টাকা পয়সা লাগে। এত টাকা তিনি পাবেন কোথায়? অনেকে বুদ্ধি দিল, যেহেতু এটা ইসলামের কাজ, আমরা চাঁদা তুলে কাজটি শুরু করতে পারি। এমামুযযামানও রাজি হলেন। দু’য়েকজন সদস্য করটিয়া বাজারে চাঁদা তুলতে গেলেন। তখন হঠাৎ এমামুযযামানের মনে হলো, যে লোক চাঁদা দেবে তার যদি হারাম উপার্জনের টাকা হয় তখন কী হবে? হারাম টাকা দিয়ে তো আর আল্লাহর কাজ চলতে পারে না। তখনই তিনি লোক পাঠিয়ে তাদেরকে চাঁদা তুলতে নিষেধ করলেন। কয়েকজনের থেকে টাকা নেওয়াও হয়ে গিয়েছিল, তিনি তাদের টাকা ফেরত দিয়ে দিতে বললেন। সেই থেকে হেযবুত তওহীদ তার ১৯ বছর অতিক্রম করেছে। আজ পর্যন্ত হেযবুত তওহীদের বাইরে থেকে একটি পয়সাও এতে প্রবেশ করে নাই। ছোট বড় কোন কাজের উদ্যোগ নিলে টাকার অভাবে এক মুহূর্তের জন্যও দেরি করতে হয় নাই, কেন্দ্রীয় ফান্ড এক মুহূর্তের জন্য শূন্য হয় নাই। এ আন্দোলনের হাতে গোনা মাত্র কয়েশ’ মোজাহেদ-মোজাহেদা, এদের সবাই অতি দরিদ্র। মধ্যবিত্তও নেই বললে চলে। দরিদ্র থেকে দরিদ্রতম মোজাহেদ মোজাহেদাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এ আন্দোলন ইােতমধ্যেই অবিশ্বাস্য সব উদ্যোগ নিয়েছে এবং আল্লাহর রহমে কোনদিন টাকার অভাবে কোথাও ঠেকতে হয় নি। একমাত্র হেযবুত তওহীদই শুধু যারা সত্য গ্রহণ করেছে, হেযবুত তওহীদের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেছে তাদের কাছ থেকে ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে অর্থ সাহায্য গ্রহণ করে না। সেটা এক টাকা হোক বা কোটি টাকাই হোক। এটিও হেযবুত তওহীদ ও অন্যান্য সংগঠনের মধ্যে একটা বিরাট পার্থক্য।