হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

আল্লাহ-মানুষ-ইবলিস

আজমল হোসাইন:

ফেরেশতারা যে দু’টি শব্দ মানুষ সৃষ্টির বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন তার একটা ফ্যাসাদ, যার অর্থ অবিচার, অশান্তি, অন্যায় ইত্যাদি। অন্যটি রক্তপাত। দুটো মিলিয়ে অর্থ দাঁড়ায় মানুষ অন্যায়, অশান্তি আর রক্তপাত করবে। সত্যই তাই হয়েছে, আদমের (আ:) ছেলে থেকে আজ পর্যন্ত শুধু ঐ রক্তপাতই নয়, অশান্তি, অন্যায়, অবিচারও বন্ধ হয় নি, এবং তখন থেকে আজ পর্যন্ত মানব জাতির জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা এই অন্যায়, অশান্তি, অবিচার আর রক্তপাত, যুদ্ধ-মানুষ শত চেষ্টা করেও বন্ধ করতে পারে নি। শুধু তাই নয়, এই সমস্যাই মানুষ জাতিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে এসেছে যে আজ তার অস্তিত্বই প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মানুষ সৃষ্টির বিরুদ্ধে যুক্তি হিসাবে মালায়েকরা এ কথা বলেন নি যে মানুষ মন্দিরে, মসজিদে, গীর্জায়, প্যাগোডায়, সিনাগগে যেয়ে তোমার উপাসনা করবে না, উপবাস করবে না। তারা এসবের একটাও বলেন নি। বলেছেন অশান্তি, অন্যায়, ঝগড়া আর রক্তপাত করবে। অর্থাৎ আসল সমস্যা ওটা নয়, এইটা। আল্লাহ কি বোঝেন নি মালায়েকরা কী বলেছিলেন? তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন এবং তা সত্ত্বেও তাদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে মানুষ বানালেন। তারপর আল্লাহ আদমের দেহের মধ্যে তাঁর নিজের আত্মা থেকে ফুঁকে দিলেন (সুরা আল হিজর ২৯)। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা, শব্দ ব্যবহার করেছেন আমার আত্মা, স্বয়ং স্রষ্টার আত্মা। অর্থাৎ আল্লাহর যত রকম গুণাবলী, সিফত আছে সব মানুষের মধ্যে চলে এলো। এমনকি তার যে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি এটাও ঐ আত্মার সঙ্গে মানুষের মধ্যে চলে এলো। আল্লাহর এই গুণ, এই শক্তিগুলি সৃষ্টির আর কারো নাই- ফেরেশতা, মালায়েকদেরও নেই- সব তাঁর বেধে দেওয়া আইন, নিয়ম মেনে চলছে। এইগুলিকেই আমরা বলি প্রাকৃতিক নিয়ম। কারো সাধ্য নেই এই নিয়ম থেকে এক চুল পরিমাণও ব্যতিক্রম করে। কারণ তা করার ইচ্ছাশক্তিই তাদের দেয়া হয় নি। ইচ্ছা হলে করবো, ইচ্ছা না হলে করবো না, এ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি একমাত্র আল্লাহর। আল্লাহ তাঁর নিজের আত্মা মানুষের মধ্যে ফুঁকে দেয়ার আগে পর্যন্ত মানুষ লক্ষ কোটি সৃষ্টির আরেকটি মাত্র ছিল। কিন্তু স্রষ্টার আত্মা তার মধ্যে ফুঁকে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে এক অনন্য সৃষ্টিতে রূপান্তরিত হয়ে গেলো। সে হয়ে গেলো স্রষ্টার, আল্লাহর প্রতিনিধি যার মধ্যে রয়েছে সেই মহান স্রষ্টার প্রত্যেকটি গুণ, শুধুমাত্র গুণ নয় প্রত্যেকটি শক্তি। শুধু তফাৎ এই যে, অতি সামান্য পরিমাণে। ব্যাখ্যা করতে গেলে বলতে হয়- মহাসমুদ্র থেকে এক ফোঁটা পানি তুলে এনে তার যদি রাসায়নিক বিশ্লেষণ করা যায় তবে ঐ এক ফোঁটা পানির মধ্যে সেই মহাসমুদ্রের পানির প্রত্যেকটি গুণ পাওয়া যাবে, মহাসমুদ্রের মধ্যে যত পদার্থ আছে তার প্রত্যেকটি পাওয়া যাবে। কিন্তু তবু ঐ এক ফোঁটা পানি মহাসমুদ্র নয়-সে প্রলয়ংকর ঝড় তুলতে পারে না, জাহাজ ডোবাতে পারবে না।
দ্বিতীয় হলো:- স্রষ্টা তাঁর এই নতুন সৃষ্টিটাকে সব জিনিসের নাম শেখালেন (আল বাকারা ৩১)। এর অর্থ হলো তিনি যা সৃষ্টি করেছেন সেই সব জিনিসের ধর্ম, কোন জিনিসের কি কাজ, কেমন করে সে জিনিস কাজ করে ইত্যাদি, এক কথায় বিজ্ঞান, যে বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে তিনি তাঁর বিশাল সৃষ্টি করেছেন, মানুষকে সেই বিজ্ঞান শেখালেন। এই কথা বলে তিনি জানিয়ে দিচ্ছেন যে, মানুষ জাতি সৃষ্টির প্রত্যেক জিনিস সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করবে।
তৃতীয় হলো:- আল্লাহ তাঁর মালায়েকদের ডেকে হুকুম করলেন তাঁর এই নতুন সৃষ্টি আদম অর্থাৎ মানুষকে সাজদা করতে। ইবলিস ছাড়া আর সমস্ত মালায়েক মানুষকে সাজদা করলেন (আল বাকারা ৩৪)। এর অর্থ কী? এর অর্থ প্রথমতঃ ফেরেশতারা মানুষকে তাদের চেয়ে বড়, বেশি উচ্চ বলে মেনে নিলেন, কারণ তার মধ্যে আল্লাহর আত্মা আছে যা তাদের মধ্যে নেই। দ্বিতীয়তঃ প্রাকৃতিক শক্তিগুলিকে আল্লাহ মানুষের খেদমতে নিযুক্ত করে দিলেন। আগুন, পানি, বাতাস, বিদ্যুৎ, চুম্বক, মাটি ইত্যাদি লক্ষ কোটি মালায়েক তাই মানুষের সেবায় নিয়োজিত। একমাত্র ইবলিস আল্লাহর হুকুম অমান্য করে আদমকে (আ:) সাজদা করলো না।
ইবলিস আল্লাহর হুকুম অমান্য করতে পারলো কারণ মূলতঃ ইবলিস ছিল একজন জ্বীন- মালায়েক নয়। কঠিন ইবাদত ও রেয়াযত করে পরে সে মালায়েকের স্তরে উন্নীত হয়। আগুনের তৈরি বলে তার মধ্যে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি না থাকলেও অহঙ্কার তখনো বজায় ছিল, যা সে অত সাধনা করেও নিশ্চিহ্ন করতে পারে নি। মাটির তৈরি আদমকে সাজদা করতে বলায় তার ঐ অহঙ্কার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল বলেই সে আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ দিলো যে, তুমি যদি আমাকে এই শক্তি দাও যে আমি মাটির তৈরি তোমার ঐ সৃষ্টিটার দেহের, মনের ভেতর প্রবেশ করতে পারি তবে আমি প্রমাণ করে দেখাবো যে, ঐ সৃষ্টি তোমাকে অস্বীকার করবে। আমি যেমন এতদিন তোমাকে প্রভু স্বীকার করে তোমার আদেশ মত চলেছি, এ তেমন চলবে না। আল্লাহ ইবলিসের এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। তাকে আদমের দেহ, মন, মস্তিষ্কে প্রবেশ করে আল্লাহকে অস্বীকার করার, তার অবাধ্য হবার প্ররোচনা দেবার শক্তি দিলেন (সুরা আল বাকারা ৩৬, সুরা আন নিসা ১১৯)।
এর পরের ঘটনাগুলো অতি সংক্ষেপে এই যে, আল্লাহ তার প্রতিভু আদমের জন্য তার স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি করলেন, তাদের জান্নাতে বাস করতে দিলেন একটি মাত্র নিষেধ আরোপ করে। আল্লাহর অনুমতি পেয়ে ইবলিস আদম ও হাওয়ার মধ্যে প্রবেশ করে তাদের প্ররোচনা দিয়ে ঐ একটিমাত্র নিষেধকেই অমান্য করালো, যার ফলে আল্লাহ তাদের জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নির্বাসন দিলেন একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য (সুরা আল বাকারা ৩৬) -অর্থাৎ কেয়ামত পর্যন্ত। আর বললেন- নিশ্চয়ই আমি তোমাদের জন্য পথ-প্রদর্শক পাঠাবো (সুরা আল বাকারা ৩৮)।
প্রশ্ন হতে পারে- যে মানুষের মধ্যে তিনি তাঁর নিজের আত্মা ফুঁকে দিয়েছেন তাকে পথ-প্রদর্শন করতে হবে কেন? এই জন্য হবে যে মানুষ নিজে তার পথ খুঁজে নিজের জন্য একটি জীবনব্যবস্থা তৈরি করে নিতে পারতো যদি কী কী প্রাকৃতিক নিয়মে এই সৃষ্টি হয়েছে, চলছে তার সবই যদি সে জানতো। কিন্তু তা সে জানেনা। দ্বিতীয়তঃ ইবলিস তো তার মধ্যে বসে নিরবচ্ছিন্নভাবে তাকে প্ররোচনা দিয়ে চলেছেই। তার চেয়ে বড় কারণ, ঐ ইবলিসের চ্যালেঞ্জ- মানুষকে দিয়ে আল্লাহকে অস্বীকার করিয়ে, আল্লাহর দেয়া জীবন পথকে বর্জন করিয়ে নিজেদের জন্য জীবনব্যবস্থা তৈরি করিয়ে তাই মেনে চলা- যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি অন্যায়, যুদ্ধ-বিগ্রহ, রক্তপাত। আল্লাহ তাঁর নবীদের মাধ্যমে যুগে যুগে মানুষের জন্য জীবনব্যবস্থা পাঠিয়ে বলছেন আমাকে একমাত্র প্রভু, একমাত্র বিধানদাতা বলে বিশ্বাস করে, এই জীবনব্যবস্থা মত তোমাদের জাতীয়, পারিবারিক ব্যক্তিগত জীবন পরিচালনা কর, তাহলে তোমাদের ভয় নেই (সুরা আল বাকারা ৩৮)। কিসের ভয় নেই? ঐ ফ্যাসাদ, অশান্তি, রক্তপাতের এবং পরবর্তীতে জাহান্নামের ভয় নেই। যে জীবনব্যবস্থা দীন আল্লাহ নবীদের মাধ্যমে বার বার পাঠালেন- এর নাম, স্রষ্টা নিজে রাখলেন শান্তি, আরবি ভাষায় ইসলাম। অর্থ – এই দীন, জীবনব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠা করলে তার ফল শান্তি, জাতীয়, পারিবারিক, ব্যক্তিগত জীবনে শান্তি, ইসলাম। না করলে অশান্তি, অন্যায়, অবিচার মানুষে মানুষে যুদ্ধ, রক্তপাত- মানুষ তৈরির বিরুদ্ধে মালায়েকরা যে কারণ পেশ করেছিলেন আল্লাহর কাছে। তাই সেই আদম (আ:) থেকে শেষ নবী মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত যতবার নবীর মাধ্যমে এই জীবনব্যবস্থা তিনি পাঠালেন, সবগুলির ঐ একই নাম-ইসলাম-শান্তি।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...