মোহাম্মদ আসাদ আলী
অনেকে মনে করেন যাদের মধ্যে বিশ্বনবী এসেছিলেন তারা বোধহয় আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করত না, আল্লাহকে মা’বুদ বলে মানত না। আসলে কিন্তু তা নয়। তারাও আল্লাহকে বিশ্বাস করত, তাঁকে সমস্ত সৃষ্টির স্রষ্টা বলে জানত। এ কথার সাক্ষ্য স্বয়ং আল্লাহ দিচ্ছেন। তিনি তাঁর রসুলকে বলছেন- তুমি যদি তাদের (আরবের অধিবাসীদের) জিজ্ঞাসা কর আসমান ও যমীন কে সৃষ্টি করেছেন? তবে তারা অবশ্যই জবাব দেবে- সেই সর্বশক্তিমান মহাজ্ঞানী (আল্লাহ) (কোরান- সুরা যখরুফ, আয়াত ৯)। অন্যত্র বলছেন- তুমি যদি তাদের প্রশ্ন কর আকাশ ও পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছেন এবং কে সূর্য ও চাঁদকে (তাদের কর্তব্যকাজে) নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রণ করছেন? তবে তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ (সুরা আন্কাবুত, আয়াত ৬১)। আল্লাহ আবার বলছেন- যদি তুমি তাদের জিজ্ঞাসা কর- মাটি (পানির অভাবে শুকিয়ে যেয়ে) মরে যাবার পর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে কে তাকে আবার পুনর্জীবন দান করেন? তবে তারা অবশ্যই বলবে- আল্লাহ (সুরা আন্কাবুত, আয়াত ৬৩)। তিনি আবার বলছেন তাঁর রসুলকে- যদি তাদের প্রশ্ন কর- কে এই মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন? তবে তারা অবশ্যই জবাব দেবে- আল্লাহ (সুরা লোকমান, আয়াত ২৫)। প্রশ্ন আসতে পারে আল্লাহর প্রতি এতই যখন বিশ্বাস তাহলে তারা মূর্তি বানিয়ে পূজা করত কেন? এর জবাবও আল্লাহ দিয়েছেন। তারা লাত, মান্নাত, হুবাল ইত্যাদিকে স্রষ্টা মনে করত না। এসব দেব-দেবীর মূর্তি বানিয়ে পূজা করত এই আশায় যে, এরা আল্লাহর কাছে তাদের জন্য সুপারিশ করবে (সুরা ইউনুস, আয়াত ১৮)।
তারা ইবরাহীমকে (আ.) আল্লাহর নবী বলে বিশ্বাস করত; নিজেদের মিল্লাতে ইবরাহীম বলে বিশ্বাস করত; ইবরাহীম (আ.) দ্বারা পুনর্নির্মিত কাবাকে আল্লাহর ঘর বলে বিশ্বাস করত; কাবার দিকে মুখ করে ইবরাহীমের (আ.) শেখানো পদ্ধতিতে সালাহ (নামাজ) কায়েম করত; কাবাকে কেন্দ্র করে বছরে একবার হজ্ব করত; কাবা তওয়াফ (পরিক্রমা) করত; সেখানে যেয়ে আল্লাহর রাস্তায় পশু কোরবানি করত; বছরে একমাস, রমাদান মাসে সওম (রোযা) পালন করত; এমন কি প্রত্যেকে ইবরাহীমের (আঃ) শেখান খাত্না করত। তারা প্রতি কাজে আল্লাহর নাম নিত, দলিল ইত্যাদি লিখতে বিয়ে-শাদীর কাবিন লিখতে তারা প্রথমেই ওপরে আল্লাহর নাম লিখে আরম্ভ করত। আমরা যেমন এখন লেখি ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’, তারা লেখত ‘বিসমিকা আল্লাহুম্মা’। একই অর্থ। কিন্তু এতকিছুর পরও তারা কাফের, মোশরেক ছিল কারণ তারা তাদের সর্বময় জীবনে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বদলে ক্বাবার ঐ তিনশ’ ষাটটি মূর্তির পুরোহিতদের সার্বভৌমত্ব মেনে নিয়েছিল। পুরোহিতরা যে হুকুম দিত তারা সেটাই পালন করত। ফলে অন্যায়, অবিচার, চুরি, ডাকাতি, যুদ্ধ, রক্তপাতে ভরে গিয়েছিল তাদের সমাজ। আল্লাহর রসুল এসে যখন ঘোষণা দিলেন- আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা (ইলাহ) নেই, তখন ঐ পুরোহিতদের কায়েমী স্বার্থে আঘাত লাগল। সমাজপতিরা, ধর্মের ধ্বজাধারীরা উত্তেজিত হয়ে উঠল। আল্লাহর রসুল ও তাঁর মুষ্ঠিমেয় অনুসারীর উপর অকথ্য নির্যাতন নিপীড়ন চলতে থাকল। সেদিন আল্লাহর রসুল যদি সর্বাঙ্গীন জীবনের তওহীদের দিকে আহ্বান না করে আজকের বিকৃত আকিদায় আমরা যেমন আল্লাহকে কেবল ব্যক্তিগত জীবনের উপাস্য বলে মনে করি কিন্তু জাতীয় জীবনে কার হুকুম চলছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাই না- আল্লাহর রসুলও যদি তেমন ব্যক্তিগত জীবনের উপাসনার দিকে ডাকতেন তাহলে আর যাই হোক তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদেরকে নির্যাতিত হতে হতো না।
ওই আরবদের মধ্যেই কিছু লোক ছিল তারা মূর্তিপূজা করাকে ঘৃণ্য কাজ মনে করত যেমনটা আমরা বর্তমানে মনে করি। তাদের মধ্যে একজনের নাম জায়েদ ইবনে আমর। ইবনে ইসহাক রসুলাল্লাহর জীবনীগ্রন্থে এই জায়েদ ইবনে আমর সম্পর্কে লিখেছেন যে, ‘তিনি নিজের বাপ-দাদার ধর্মবিশ্বাস পরিত্যাগ করে মূর্তি, মৃত প্রাণী ও রক্ত ভক্ষণ এবং প্রতিমাকে অর্ঘ্যদান ইত্যাদি বিষয় থেকে বিরত থাকতেন। বলতেন, তিনি কেবল ইবরাহিমের উপাস্যকে পূজা করেন। নিজের লোকজনকে প্রকাশ্যে তিনি তাদের আচার-আচরণের জন্য নিন্দা করতেন।’ কই, এই ব্যক্তিকে তো ওতবা, শায়বা, আবু জাহেলরা কিছু বলত না। অন্যদিকে বিশ্বনবীকে সমস্ত রকমের নির্যাতন তো বটেই, শেষাবধি হত্যার সিদ্ধান্ত পর্যন্ত নিল।
এর কারণ খুব সোজা- জায়েদ ইবনে আমর যেটা করেছিলেন আর আল্লাহর রসুল যেটা করেছিলেন এই উভয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ রয়েছে। জায়েদ ডাকছিলেন উপাসনা, আরাধনার দিকে, ওটা পূর্ণাঙ্গ তওহীদ নয় যে তওহীদ নিয়ে যুগে যুগে আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী-রসুলগণ এসেছেন, অন্যদিকে আখেরী নবী মানুষকে আহ্বান করছিলেন সেই প্রকৃত তওহীদ তথা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র দিকে, যে দাবিকে শয়তান সবচাইতে বেশি ভয় পায়, কারণ এই একটি দাবি গ্রহণ করে নিলেই মানুষের জীবন থেকে অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাত ইত্যাদি নির্মূল হয়ে যাবে, মানুষকে পথভ্রষ্ট করার চ্যালেঞ্জে সে হেরে যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের যে, তৎকালীন মোশরেক আবরদের মত বর্তমানে আমরা আল্লাহকে একমাত্র হুকুমদাতা হিসেবে না মেনে কেবল মা’বুদ হিসেবে মানছি। আমরা উপাসনা-আরাধনায় আছি, খুব ভালোভাবেই আছি। আমাদের লক্ষ লক্ষ মসজিদ আছে। এসি মসজিদ, টাইলস মসজিদ, সোনার গম্বুজ বসানো মসজিদ। লক্ষ লক্ষ মাদ্রাসা আছে, সেখানে নিখুঁত আরবি শেখানো হয়, ব্যাকরণ শেখানো হয়, কোর’আন-হাদিস, ফেকাহ, মাসলা-মাসায়েল মুখস্ত করানো হয়। এসবের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জ্ঞান নিয়ে অসংখ্য আলেম, পণ্ডিত বের হন। মিলাদ, মাহফিল, ইজতেমা, হজ্ব ইত্যাদিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের জমায়েত হয়। অনেকে নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়েন। পাড়া-মহল্লা কাঁপিয়ে জিকির করেন। কিন্তু একটি জায়গায় আমরা ধরা এবং সেই জায়গাটি দ্বীনের একেবারে মূলমন্ত্র, ভিত্তিমূল, যেখানে কোনো আপস চলে না। সেটা হচ্ছে আমরা আল্লাহকে সর্বাঙ্গীন জীবনের একমাত্র হুকুমদাতা, বিধানদাতা অর্থাৎ ইলাহ হিসেবে মানছি না। আমরা আল্লাহর দেওয়া জীবনবিধানকে কয়েক শ’ বছর পূর্বেই পরিত্যাগ করে পাশ্চাত্যের তৈরি বিধানকে কার্যকর করে নিয়েছি। পাশ্চাত্যের তৈরি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, আইন, কানুন, দণ্ডবিধি দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে আমাদের জাতীয় জীবন। অর্থাৎ আমাদের ইলাহ এখন আল্লাহ নেই, দ্বীন বা জীবনব্যবস্থাও ‘ইসলাম’ নেই। আখেরী যামানায় কি কি হবে সে সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণীতে আল্লাহর রসুল বলেছিলেন, তখন মসজিদসমূহ পূর্ণ হবে- সেখানে জায়গা পাওয়া যাবে না, কিন্তু সেখানে হেদায়াহ থাকবে না (বায়হাকী)। হেদায়াহ’ই হলো আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ, হুকুমদাতা বলে বিশ্বাস করা, মেনে নেওয়া অর্থাৎ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। মুসল্লি দিয়ে ভর্তি মসজিদগুলোতে যদি হেদায়াহ’ই না থেকে থাকে তবে সেখানে আর রইল কী? আল্লাহ বলেছেন, আল্লাহ যে বিধান নাযেল করেছেন তা দিয়ে যারা হুকুম করে না তারাই কাফের, জালেম, ফাসেক (সুরা মায়েদা- ৪৪, ৪৫, ৪৭)। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে- আল্লাহর ভাষায় কার্যত কাফের, জালেম, ফাসেক হবার পরেও ব্যক্তিজীবনে আমরা খুব আমল করে যাচ্ছি, নামাজ পড়তে পড়তে কপালে কড়া ফেলে দিচ্ছি, আর ভাবছি- খুব বোধহয় সওয়াবের কাজ হচ্ছে। এই ঈমানহীন আমল যে আল্লাহ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন সেটা বোঝার সাধারণ জ্ঞানটাও আমাদের লোপ পেয়েছে!
লেখক: সহকারী সাহিত্য সম্পাদক, হেযবুত তওহীদ।