হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম
‘গত ২২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর গেন্ডারিয়ায় হেযবুত তওহীদের উদ্যোগে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় মুখ্য আলোচক হিসেবে ভাষণ দান করেন হেযবুত তওহীদের এমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম। তাঁর ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বজ্রশক্তির পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো’-
‘‘আল্লাহ কোর’আনের সুরা নিসার প্রথম আয়াতেই বলে দিয়েছেন, ‘হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন; আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী। আর আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাচনা করে থাক এবং আত্মীয় জ্ঞাতিদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে সচেতন রয়েছেন।’
অর্থাৎ পুরো মানবজাতি হচ্ছে এক জাতি, এক পিতা-মাতার সন্তান, এই বোধ আমাদের প্রত্যেকের অন্তরে জাগ্রত করতে হবে। আজকের এই যে বিশ্বসঙ্কট- সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন, দাঙ্গা, সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, ১৬ হাজার অ্যাটম বোম প্রস্তুত, সীমান্তে সীমান্তে উত্তেজনা, সমুদ্রে সমুদ্রে রণতরী টহল দিচ্ছে, পরাশক্তিরা হুমকির ভাষায় কথা বলছে, সমস্ত সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে আছে অল্পকিছু মানুষের হাতে। এই বিত্তশালী শ্রেণিটি যখন অকল্পনীয় ভোগ-বিলাসিতার মধ্যে ডুবে আছে, তখন কোটি কোটি মানুষ বিনা চিকিৎসায় অনাহারে মারা যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত শহর-নগর, বন্দর বোমার আঘাতে ধ্বংস হচ্ছে। মানবজাতির এই অবস্থা থেকে উদ্ধারের পথ নিয়ে প্রত্যেককে ভাবতে হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ তৈরি করা হলো। কিন্তু যুদ্ধ-রক্তপাত থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে পারল না। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ গঠন করল, কিন্তু এগুলো আরও অবিচারের সৃষ্টি করল। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে নতুন নতুন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গঠন করা হচ্ছে, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে শক্তিশালী করা হচ্ছে, প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে, কিন্তু পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে, প্রতিটি দেশে প্রতিটি রাষ্ট্রে অন্যায় অবিচার ধাঁই ধাঁই করে বাড়ছে। কী উন্নত রাষ্ট্র কী অনুন্নত রাষ্ট্র, কী হিন্দু রাষ্ট্র কী মুসলমান রাষ্ট্র, কী প্রাচ্য কী পাশ্চাত্য- সর্বত্রই অন্যায় অপরাধ, যুলুম, রক্তপাতে নিমজ্জিত। তাহলে এই থেকে নিস্তারের উপায় কী? সেমিনার র্যালি আলোচনা মানববন্ধন তো হচ্ছে। লেখালেখি হচ্ছে, টকশোতে কথা হচ্ছে। ধর্মগুরুরা ওয়াজ-নসিহত করে যাচ্ছে। পূজা-প্রার্থনা হচ্ছে। শুক্রবার, শনিবার, রবিবার মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডায় জায়গা পাওয়া যায় না। বাইবেল পাঠ হচ্ছে, গীতা পাঠ হচ্ছে, ত্রিপিটক পাঠ হচ্ছে, কই শান্তি তো আনতে পারছেন না। প্রতিবাদ বিক্ষোভেরও অন্ত নাই। কিন্তু লাভ তো হচ্ছে না। তাহলে মানবজাতি কি এভাবেই ধ্বংস হয়ে যাবে? নিস্তারের কোনোই উপায় নাই? এভাবেই আমার নিরীহ মা-বোনেরা ধর্ষিতা হতে থাকবে? এভাবেই কোলের অবুঝ শিশুর মরদেহ দেখতে হবে?
মিয়ানমার থেকে দশ লক্ষ রোহিঙ্গাকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো, পৈত্রিক ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হলো, কিন্তু কোনো বিচার নাই। পশ্চিমারা নাকিকান্না করতে থাকে আর বলতে থাকে – বাংলাদেশ একটা মানবিক কাজ করেছে। প্রশংসনীয়। অবশ্যই বাংলাদেশ মানবতার পক্ষে থাকবে। উদ্বাস্তু নিরাপরাধ মানুষগুলোকে জায়গা না দিয়ে কীভাবে ফিরিয়ে দিবেন? কিন্তু ঐ নাকিকান্না করা পশ্চিমাদের প্রতি কথা হচ্ছে- তোমরা দৌড়ে গিয়ে আফগানিস্তানকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারো, দৌড়ে গিয়ে হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী দেশ ইরাক ধ্বংস করে ফেলতে পার, লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে বিমান হামলা করে হত্যা করতে পার, সিরিয়া ধ্বংস করতে পার, সাদ্দাম বলল তার কাছে অস্ত্র নাই তারপরও তার ক্ষমা হলো না, সাদ্দাম হোসেনকে ধরে আনতে পার, ওসামা বিন লাদেনকে ধরে আনতে পার, কিন্তু মিয়ানমারে কারো কিছু করতে পার না। আসল কথা হচ্ছে তোমরা করবে না। করবে না কারণ এরা মুসলমান না। মুসলমানকে ধ্বংস করার বেলায় সবকিছু জায়েজ আছে, অসুবিধা নেই, কারণ মুসলমানের কোনো অভিভাবক নেই পৃথিবীতে। এই কথাটা মুসলমানদেরকে বুঝতে হবে।
কাজেই আজকে আপনারা যারা এখানে এসেছেন, আপনারা অনেক জ্ঞানী মানুষ, অনেক চিন্তাশীল মানুষ আছেন, আলেম-ওলামারাও আছেন, আপনারা আমার কথাগুলোকে অনুধাবন করুন। আমরা কী বলতে চাই, কী আমাদের অভিপ্রায়, আমাদের পথ কী, লক্ষ্য কী, গন্তব্য কোথায়, আমাদের কর্মসূচি কী, ভেতর কী বাহির কী, ভালো করে বুঝুন। অনর্থক কারো অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে ভালো করে বুঝে নিন।
আজকে একেক জনের কাছে একেক রকম ধর্ম! যেহেতু আমরা মুসলমান, কাজেই ইসলাম নিয়েই আগে কথা বলি। আমার সামনে যারা মুরুব্বিগণ আছেন, আমার পিতার বয়সী অনেকে আছেন, বোনেরা আছেন, আমি বিশ্বাস করি আপনারা সকলেই সুস্থ মস্তিষ্কের সচেতন মানুষ। আমার বক্তব্য বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। দেখুন- হুকুম হচ্ছে দুইটি, আল্লাহর হুকুম ও ইবলিশের হুকুম, পক্ষও হচ্ছে দুইটি। সত্য ও মিথ্যা, ন্যায় ও অন্যায়, ধর্ম ও অধর্ম। মানবজাতির ইতিহাস এই ন্যায় অন্যায়, সত্য মিথ্যার দ্বন্দ্বের ইতিহাস। মানুষ যখন আল্লাহর হুকুম অমান্য করেছে তখন সে অনিবার্যভাবেই ইবলিসের হুকুম মেনে নিয়েছে। ফলে অশান্তিতে পড়েছে। আর যখন আল্লাহর হুকুম মেনে নিয়েছে তখন পৃথিবীতে শান্তি পেয়েছে এবং পরকালও সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে। আমার কথা হচ্ছে, আল্লাহর হুকুম কয় ধরনের হবে? এক ধরনের। জান্নাতের পথ হবে কয়টা? অবশ্যই একটা। অথচ খেয়াল করুন- আল্লাহ এক, রসুল এক, কিতাব এক, কিন্তু আজ আমাদের মধ্যে একেকজনের কাছে একেকরকমের ইসলাম। শিয়া মানেনা সুন্নিকে। সুন্নি মানেনা শিয়াকে। ঢাকার পীর মানে না মানিকগঞ্জের পীরকে। মানিকগঞ্জের পীর মানে না ঢাকার পীরকে। সরকারি আলেমরা মানে না কওমী আলেমকে। কওমীরা মানে না সরকারি আলেমকে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন কোনো ফতোয়া দিলে অন্যরা সেটা অস্বীকার করেন। ইরাক থেকে ফতোয়া দিলে পাকিস্তানি আলেমরা মানেন না। ইন্ডিয়ার আলেমরা বললে মালয়েশিয়ার আলেমরা মানেন না। এত মত, এত পথ কেন? সবগুলাই কি ঠিক হতে পারে? তা তো হতে পারে না।
আজকে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকান- শিয়াকে মারার জন্য সুন্নির অস্ত্র প্রস্তুত, সুন্নিকে মারার জন্য শিয়ার অস্ত্র প্রস্তুত। আমার জানামতে এ পর্যন্ত শিয়া ইরানের প্রত্যেকটি গুলি মুসলমানদের হত্যা করতে ব্যবহৃত হয়েছে, আবার সৌদি আরবের নেতৃত্বে সুন্নি জোটের গুলিও মুসলিমদের হত্যা করতেই ব্যবহৃত হয়েছে। আমি জানতে চাই- শিয়ারা মুসলমান নাকি সুন্নিরা মুসলমান? কে জান্নাত যাবে? এক মসজিদের ইমাম মানেন না আরেক মসজিদের ইমামকে, এক মাদ্রাসার হুজুর মানেন না আরেক মাদ্রাসার হুজুরকে। ঐক্য তো না-ই, জাতি যাতে কোনোদিন এই অবস্থা থেকে বের হতে না পারে সেই পথটাও রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। মাকড়শার জালের মতো মাসলা-মাসায়েলের জালে আটকে রাখা হয়েছে জাতিকে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অপ্রয়োজনীয় অনর্থক বিষয়ের মধ্যে মানুষের চিন্তা-ভাবনাকে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এরা আর ছুটতে পারবে না।
একটি ঘটনা বলি আপনাদেরকে, মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। ফেসবুকের একটি পোস্ট প্রিন্ট করে এনেছি আমি। আইডির নাম আবু জুনাইদ। ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’ নামের একটা পেজে এই পোস্টটি করা হয়েছে। সেখানে প্রশ্ন করা হয়েছে, ‘‘মশা মারার জন্য বাজারে এক ধরনের ইলেকট্রিক র্যাকেট পাওয়া যায়। এই ধরনের ইলেকট্রিক র্যাকেট দিয়ে মশা মারলে এক ধরনের স্ফূলিঙ্গ বের হয় এবং মশা মারা যায়। প্রশ্ন হলো- এই ধরনের বস্তু দিয়ে মশা মারা জায়েজ হবে কিনা।’’
এর উত্তরে বলা হয়েছে কী, সেটা শুনুন। বলা হচ্ছে- ‘কোনো ক্ষতিকর প্রাণীকেও আগুনে পুড়িয়ে মারা জায়েজ নাই।’ জায়েজ নাজায়েজের রায়ে আরও বলা হচ্ছে, ‘রসুলাল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ ব্যতীত আর কারো অধিকার নাই আগুন দিয়ে শাস্তি দেওয়ার। সহিহ আল বোখারী, হাদীস ৩০১৬। উক্ত র্যাকেট দিয়ে আঘাত করলে যেহেতু মশা পুড়ে মারা যায় তাই তার দ্বারা মশা মারা জায়েজ হবে না।’
এই বলে ইসলামের আইনশাস্ত্রের কতগুলো বইয়ের নাম দিয়ে দিয়েছে।
তার মানে বোঝা গেল আগুন দিয়ে মশা মারা যায়েজ নাই, তাই তো? এবার বলি আমার কথা। ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ। আমার দুইটা ভাইকে ধরে নিয়ে জবাই করে দেওয়া হলো। প্রকাশ্য দিবালোকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। ফেসবুকে শত শত পোস্ট দিয়ে এরাই সাধারণ মানুষকে উস্কানী দিয়েছে হেযবুত তওহীদের লোকদেরকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দাও, কারণ তারা কাফের, মোশরেক, মুরতাদ, খ্রিস্টান। আজকে সেই তোমরা কিনা মশা মারার কাফফারা জানতে চাও? ইলেকট্রিক ব্যাট দিয়ে মশা মারা তোমাদের কাছে নাজায়েজ, অথচ তোমরা পেট্রল ঢেলে আমার দুইজন ভাইকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছো! এদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। শত শত মানুষকে পেট্রল বোমা মেরে হত্যা করেছো। সেই তোমরা এখন মশা মারার ফতোয়া খুঁজে বেড়াও।
আমাদের এমামুয্যামান তাঁর লেখা বইতে একটি ঘটনা উল্লেখ করেছিলেন। কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পরে ইরাক থেকে অনেকে হজ্বে গেলেন। তখনও আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) জীবিত ছিলেন। ইরাক থেকে যাওয়া একজন হাজী তাকে প্রশ্ন করল- হে আব্দুল্লাহ বিন উমর (রা.), হজ্বের মধ্যে মশা মাছি মারলে তার কাফফারা কী হবে? এই প্রশ্ন শুনে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) অত্যন্ত ক্ষোভের সাথে জবাব দিলেন, যে ইরাকিরা আল্লাহর রসুলের নয়নের মনি হোসেনকে শহীদ করল সেই ইরাকীরা কিনা মাছি মারার কাফফারা জিজ্ঞেস করে!
আজকে এদের অন্ধত্ব কোন পর্যায়ে গেছে চেয়ে দেখুন। বিরাট বিশাল পাহাড় তারা দেখতে পায় না। তারা আতশী কাঁচ দিয়ে পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা ছোট ছোট বালুকণা দেখতে গিয়ে ঐ ছোট ছোট বালুকণাকেই পাহাড় মনে করছে। এটার নামই আকিদার বিকৃতি। আমাদের বাড়িতে দুইজন মো’মেন, মোজাহেদ ভাইকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়ে এখন জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে মশা আগুন দিয়ে মারা জায়েজ কিনা। ফেসবুকে প্রতিদিন আমাকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। আমাকে জ্বালিয়ে দেওয়া জায়েজ, আর মশা নাজায়েজ- তাই না? এই যখন তোমরা শিখেছো- তখন তোমাদের কপালে সা¤্রাজ্যবাদীদের বোম খাওয়া ছাড়া উপায় নাই। তৈয়ার হও, ফেরাতে পারবে না।
এই অবস্থায় আমি দাঁড়িয়েছি আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলাম নিয়ে। আমি ধর্মব্যসায়ীদের কায়েম করে রাখা ধর্মের নামে চালু অধর্ম নিয়ে দাঁড়ায় নাই। কঠিন পথ, কন্টকাকীর্ণ পথ, খুব কঠিন আছে এই পথে হাঁটা। কাজেই যারা এসেছেন তারা অনুধাবন করুন, শক্ত সিদ্ধান্তের উপর দাঁড়ান। আপনাদেরকে ভাবতে হবে, আমাদের ইহকাল আছে, পরকাল আছে। দেহ আত্মা যেন আলাদা নয়, তেমনি ইহকাল পরকালও আলাদা নয়। যারা ইহকালকে পরকাল থেকে আলাদা করেছে তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে। আল্লাহ কোর’আনে আমাদেরকে দোয়া করতে শিখিয়েছেন, দুনিয়ার জীবনকে সুন্দর কর এবং পরকালের জীবনকে সুন্দর কর। কাজেই আগে দুনিয়া, তারপর আখেরাত। একটাকে বাদ দিয়ে আরেকটার সফলতা আসবে না। (সম্পাদিত)