আল্লাহর রসুল নবুয়ত লাভের পর মানুষকে একটি কথার দিকে আহ্বান জানাতে লাগলেন- বলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই। এতেই মক্কার ধর্মব্যবসায়ী আলেম শ্রেণি ও গোত্রপতিরা রসুলাল্লাহর সাথে চরম শত্রুতা শুরু করল। কারণ তারা বুঝতে পারল- রসুলের আহ্বান যদি সমাজ গ্রহণ করে নেয় তাহলে তাদের স্বেচ্ছাচারিতামূলক শাসনব্যবস্থা আর টিকবে না এবং ধর্মব্যবসারও আখেরী দিন ঘনিয়ে আসবে। তারা নিজেদের মনগড়া হুকুম দিয়ে এতদিন সমাজকে পরিচালিত করেছে, এখন যদি মানুষ আল্লাহর হুকুম গ্রহণ করে নেয় তাহলে তাদের গন্তব্য হবে কোথায়? সেটা চিন্তা করেই তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল কীভাবে আল্লাহর রসুলের পথরোধ করা যায়। যে মুষ্টিমেয় সত্যনিষ্ঠ মানুষ আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হলো তাদের উপর এমন নির্যাতন চালাতে লাগল যে বর্ণনা শুনলে পাথরের হৃদয়ও মোমের মত গলে যায়। তাতেও যখন কাজ হলো না, তখন ঐ ধর্মব্যবসায়ী আলেম ও গোত্রপতিরা আরেক ষড়যন্ত্রের জাল বুনল। তারা ঠিক করল- যে গোত্রগুলো রসুলাল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তাদেরকে বয়কট করা হবে, তাদের সাথে কেনাবেচা করা হবে না, ব্যবসা করা হবে না, বিয়ে-সাদী করা হবে না, সাহায্য-সহযোগিতাও বন্ধ করে দেওয়া হবে। এইভাবে রসুলাল্লাহর ঐ মুষ্টিমেয় অনুসারী মো’মেনদেরকে ‘একঘরে’ করে ফেলা হলো।
এদিকে মো’মেনদেরকে সাথে নিয়ে রসুলাল্লাহ একটি গিরি উপত্যকায় অবস্থান গ্রহণ করলেন এবং প্রায় তিন বছর সেখানে খাদ্য-পানীয়’র অভাব ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে কাটাতে হলো মো’মেনদেরকে। সিরাত গ্রন্থগুলোতে এই দুর্ভোগের হৃদয়বিদারী চিত্র পাওয়া যায়। খাদ্যাভাব এই পর্যন্ত পৌঁছেছিল যে, মো’মেনদেরকে গাছের পাতা খেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণা নিবারণ করতে হয়েছিল। অসহ্য উদর-জ্বালা, আবক্ষ তৃষ্ণা, ক্ষুধার্ত শিশুদের কাতর ক্রন্দন, স্বজনদের বিমর্ষ মলিন বদন এবং সর্বোপরি সম্মুখপানে মৃত্যুর ভীষণ বিভীষিকা- এই দুর্যোগ একদিন দুইদিন নয়, তিনটি বছর বয়ে বেড়াতে হয়েছে তাদেরকে। একদিকে সারা পৃথিবী, অন্যদিকে ঐ মুষ্টিমেয় কয়েকজন মো’মেন, যেন এক মহাসমুদ্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো একটি বিন্দুকণা। সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়, মহাসমুদ্রের বিরুদ্ধে জয়ী হতে হলে ঐ বিন্দুকণার মধ্যে কতখানি ঐক্য, কতখানি দৃঢ়তা, কতখানি আত্মত্যাগের দরকার পড়বে। তাই ইতিহাসে দেখি আবি তালিব গিরি উপত্যকায় দাঁড়িয়ে আল্লাহর রসুল ঐ ছোট্ট মো’মেন জাতিটাকে মহাপ্রয়োজনীয় সেই ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, আর আত্মত্যাগের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলছেন! রসুলাল্লাহর ঐ উপদেশমূলক ভাষণটি যে বৃথা যায়নি, ঐ মুষ্টিমেয় মানুষ নিজেদের আত্মায় ও চরিত্রে গেঁথে নিয়েছিলেন তার প্রমাণ পরবর্তী ইতিহাস। সে আলোচনা অন্য সময় করা যাবে, আপাতত পাঠকদের সামনে রসুলাল্লাহর ভাষণটি তুলে ধরা হলো-
‘আবি-তালিব গিরি উপত্যকায় রসুলাল্লাহর প্রথম ভাষণ’
হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবের আনুগত্য কর এবং পারস্পরিক ঝগড়া বিবাদ থেকে বিরত থাক। তা না হলে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলবে এবং তোমাদের ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাবে। তোমরা কি এ সত্য সম্পর্কে অবগত নও যে, আল্লাহর যমীন যখন চতুর্দিক থেকে অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল, বোত-পরস্তি (শয়তানের পূজা) যখন আল্লাহ-পরস্তির (আল্লাহর এবাদত) স্থান দখল করে নিয়েছিল, তখন মানবীয় নৈতিকতা মুছে গিয়েছিল, সর্বত্র ফেতনা-ফাসাদের তুফান প্রবাহিত ছিল। তোমরা সে যুগ প্রত্যক্ষ করেছ। এখানের বাসিন্দারা শত শত বছরের হিং¯্র প্রাণীর ন্যায় পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। এ হানাহানি-খুনাখুনির জন্য দুনিয়ার কোথাও আরববাসীর সম্মান ছিল না। প্রত্যেক কওম তাদেরকে নিকৃষ্ট ও লাঞ্ছিত মনে করত। যুদ্ধ-বিগ্রহ, শত্রুতা-দুশমনি ও ঘৃণা-বিদ্বেষ ছিল তাদের পরিচয়ের বৈশিষ্ট্য। নিজেদের এ দুর্ভাগ্য সম্পর্কে তারা অজ্ঞ ছিল। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের অবস্থার ওপরে রহম করেছেন। তোমাদের অন্তরে মহব্বত সৃষ্টি করেছেন এবং তার ফলে তোমরা ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ হয়েছ। অতএব তোমরা এ মেহেরবানীর প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়ো না। পরস্পর মিলে মিশে থাকো এবং আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমাদের লক্ষ্য হাসিল করতে সক্ষম হও। হে মানুষ! নিঃসন্দেহে সকল মো’মেন পরস্পর ভাই ভাই এবং সকল মো’মেন এক ব্যক্তি সদৃশ। শিরপীড়া উপস্থিত হলে তার সারাটা শরীর বেদনায় জর্জরিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এক মো’মেন অন্য মো’মেনের জন্য এক বুনিয়াদস্বরূপ, যার এক অংশ অন্য অংশের বোঝা বহনে সাহায্যকারী। আমি তোমাদের নসিহত করছি, প্রত্যেক মো’মেন পরস্পর ভাই, তাই কেউ যেন কারও প্রতি যুলুম (অন্যায় আচরণ) না করে এবং কাউকে যেন একাকী বন্ধুহীন বা সাহায্যহীন ছেড়ে না দেয়া হয়। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করে দিবেন, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করে দিবেন। যে ব্যক্তি মো’মেনের কষ্ট দূর করবে আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার কষ্ট দূর করে দিবেন। যে ব্যক্তি অন্যের ত্রুটি গোপন করবে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তার ত্রুটিও গোপন রাখবেন। হে মানুষ! যথাসম্ভব ঐক্যবদ্ধভাবে জীবন যাপন করো। পরস্পর ঝগড়া বিবাদ থেকে বিরত থাকো। তোমাদের রব তোমাদেরকে নিঃস্বার্থ কর্মের হুকুম দিচ্ছেন এবং ফেত্না-ফাসাদ এবং খুনাখুনী নিষিদ্ধ করেছেন। যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ, তোমরা মো’মেন না হওয়া পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর নিজের জন্য তোমরা যা পছন্দ করো অপর ভাইয়ের জন্যও তাই পছন্দ না করা পর্যন্ত তোমরা মো’মেন হতে পারবে না। এবং হে মো’মেনগণ অবশ্যই মহাপবিত্র আল্লাহ তোমাদের ওপর করুণা করেছেন, তিনি তোমাদের অন্তরে ভালবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন এবং তোমাদেরকে হিংসা-বিদ্বেষের অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছেন। এ নেয়ামতের সম্মান করা তোমাদের কর্ত্তব্য এবং পরস্পর সুখে দুঃখে অংশগ্রহণ করো। আমি ইতিপূর্বে বলেছি যে এক মো’মেন অন্য মো’মেনের জন্য বুনিয়াদস্বরূপ। তার অর্থ হলো, এক মো’মেন অন্য মো’মেনের জন্য দেওয়ালে ইটের মত একে অপরকে আঁকড়ে থাকে। যেরূপ দেয়ালের এক ইট অপর ইটকে সংযুক্ত রাখে, সেরূপ পরস্পর ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য আমি তোমাদেরকে হেদায়াত করছি। তোমরা যে অবস্থাতেই থাকো না কেন একে অপরের সাহায্য করবে। আমি হুঁশিয়ার করছি যে, তোমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকো, একে অপরকে সাহায্য করো অর্থাৎ আশ্রয় দান করো তাহলে তোমরা প্রাচীরের ন্যায় মজবুত থাকবে। অন্যথায় তোমরা স্তুপীকৃত ইটের ন্যায় হবে, কোন দৃঢ়তা থাকবে না এবং যে কেউ তা উড়িয়ে দিতে পারবে। আর তোমাদের মধ্যে যার সামর্থ্য রয়েছে, সে যেন অবশ্যই তার ভাইয়ের উপকার করে এবং আমি পুনরায় তোমাদেরকে একথা বলছি যে, কোন লোক ততক্ষণ পর্যন্ত মো’মেন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে তার ভাই এর জন্যেও তাই পছন্দ করে। আমি এ উদ্দেশ্যে বলছি যে, প্রত্যেক মো’মেন লাভ-লোকসানের কাজে যেন অপর মো’মেনকে তার নিজের মত মনে করে এবং
সে যা নিজের জন্য অপছন্দ করে তা যেন তার ভাই এর জন্যও অপছন্দ করে। যতদূর সম্ভব এক মো’মেন ভাইকে যেন নিজের সত্তার ন্যায় প্রিয় মনে করে এবং নিজের সত্তার প্রতি যে আচরণ করে সেরূপ আচরণ যেন তার ভাইয়ের প্রতিও করে। কথাবার্ত্তায় মোনাফেকও নিজেকে মো’মেন বলে থাকে, কিন্তু মো’মেন তো সেই ব্যক্তি যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য মো’মেন নিরাপদ থাকে। হে মানুষ! মো’মেনের প্রত্যেক জিনিস অপর মো’মেনের জন্য হারাম। পরস্পরের রক্ত, ইজ্জত, আব্রু, সম্পদ এর কোনটারই ক্ষতি সাধন তোমরা করো না। মানুষের চারিত্রিক গুণাবলীর মধ্যে এমন দু’টি গুণ রয়েছে যার চেয়ে উত্তম আর কিছু নেই। এর প্রথমটি হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ঈমান আর দ্বিতীয়টি মো’মেনদের উপকার সাধন। দোষাবলীর মধ্যেও এমন দু’টি দোষ রোয়েছে যার চেয়ে নিকৃষ্টতম আর কিছুই নেই। প্রথমটি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা, দ্বিতীয়টি কোন মো’মেনের ক্ষতি সাধন করা। কোন অবস্থাতেই মো’মেন ভাই এর ওপর যুলুম করা অন্য মো’মেনের জন্য বৈধ নয়। বিপদকালে মো’মেন ভাইকে সাধ্যমত সাহায্য করা অবশ্য কর্ত্তব্য (ফরদ)। সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতাল্লাহে ওয়া বারাকাতুহ্।
(সংগ্রহ: মো: আবু ফাহাদ, মোহাম্মদ রিয়াদুল হাসান সম্পাদিত ‘বিশ্বনবী মোহাম্মদ (দ:) এর ভাষণ’ থেকে)