আফগানিস্তান কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, কেন এই দেশটির উপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায় বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদীরা এবং কেন এই দেশটা ঘুরে ফিরেই বিভিন্ন পরাশক্তির শক্তি পরীক্ষার রঙ্গমঞ্চে পরিণত হয় এ বিষয়ে পাঠককে কিছুটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম গতকালের লেখায়। তবে সেটা ছিল উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর প্রেক্ষাপটে। এখন একবিংশ শতাব্দীর আফগানিস্তান দাঁড়িয়ে আছে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে। অনিশ্চয়তার মেঘ আচ্ছন্ন করে রেখেছে দেশটির ভবিষ্যৎকে। তালেবানের উত্থান নিয়ে সারা বিশ্বে হইচই শুরু হয়েছে। চারদিকে প্রশ্ন উঠছে- সত্যিই কি তালেবানের কাছে হার মানল যুক্তরাষ্ট্র? নাকি ভিন্ন কোনো চক্রান্তের বীজ বোনা হচ্ছে দৃষ্টির অন্তরালে? হয়ত কিছুদিনের মধ্যেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে, তবে তা বোঝার জন্য আফগানিস্তানের গত শতাব্দীর আরও কিছু ঘটনাপ্রবাহ জানা থাকা আবশ্যক। জানতে হবে কারা এই তালেবান? কারা এই আল কায়েদা? কীভাবে আফগানিস্তান সন্ত্রাসীদের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল? মানুষের ঈমানকে ব্যবহার করে রক্তের হোলি খেলার আয়োজন কারা করেছিল? আরও জানতে হবে, আফগানিস্তানে গত কয়েক দশক ধরে রক্তারক্তির যে মহোৎসব চলছে, সেটার পেছনে কার কতখানি দায় আছে। আসুন সেই ঘটনাপ্রবাহে নজর দেওয়া যাক।
কথায় আছে ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’ অর্থাৎ হরিণের নিজের মাংসই তার বড় শত্রু। কেননা ওই সুস্বাদু মাংসের স্বাদ পাওয়ার জন্যই যত শিকারীর আনাগোনা হয়। আফগানদের বড় শত্রু বোধহয় তাদের দেশটার ভৌগোলিক অবস্থান, যার টানে ছুটে আসে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়ার মত বড় বড় বিশ্বশক্তিগুলো। কোনো একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখন আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে, অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলো তখন হাত গুটিয়ে বসে থাকে না। তারাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আফগান ভূমির দখল পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তাদের সেই পাটা-পুতার ঘষায় চিড়েচ্যাপ্টা হয় বেচারা আফগানরা। হাজার হাজার নিরীহ আফগানের প্রাণ যায় অকাতরে।
সমাজতন্ত্র নাকি পুঁজিবাদ?
এই পর্বে আমাদের আলোচনা করার কথা ১৯৭৩ পরবর্তী আফগানিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে। তবে সেই আলোচনা শুরু করার আগে তৎকালীন আন্তর্জাতিক সমীকরণটি একটু বুঝে নেওয়া দরকার। সংক্ষেপে বলছি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে হিটলারের উত্থান ঠেকানোর জন্য সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পুঁজিবাদী মিত্রশক্তি হাত মিলিয়েছিল। কিন্তু যেই না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলো, ফ্যাসিবাদের হুমকি থেকে মুক্তি পাওয়া গেল, অমনি সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একে অপরকে হুমকি মনে করতে লাগল। বলা বাহুল্য- এই দু’টো বিশ্বশক্তিই ছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। দেশে দেশে গণতন্ত্র রপ্তানির নামে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ল, আরেকদিকে সমাজতন্ত্র রপ্তানির নামে বিভিন্ন দেশের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় নামল সোভিয়েত ইউনিয়ন। শুরু হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ বা ঠাণ্ডা যুদ্ধ। এই লড়াই চলাকালে অর্থনৈতিক, সামরিক ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে বিশ্বের বহু দেশ যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ল, আবার বহু দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়ল। এ সময় বাদশাহ জহির শাহের আফগানিস্তান ঝুঁকে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিবিধ সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিতে লাগল আফগান সরকারকে।
১৯৫৬ সাল নাগাদ সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আফগানিস্তানের এই সম্পর্ক আরও উষ্ণ হতে থাকে। তবে মনে রাখতে হবে, এই সম্পর্ক কেবলই ছিল রাজনৈতিক। মতাদর্শিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এই দেশ দু’টি সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠিত ছিল ধর্মহীন বস্তুবাদী সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ, পক্ষান্তরে আফগানিস্তানের জনগণ ছিল কট্টর ইসলামপন্থী। মতাদর্শিক এই বৈপরীত্যটা পাঠকদেরকে সবসময় মনে রাখতে হবে, কেননা এই বৈপরীত্যটাই পরবর্তীতে আফগানিস্তানের মাটিতে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধরাশায়ী হতে বাধ্য করেছে, তবে সেটা আরও পরের ঘটনা। আপাতত ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝে নেওয়া যাক।
বাদশাহ জহির পরবর্তী আফগানিস্তান
১৯৭৩ সালে বাদশাহ জহির ইতালি থাকা অবস্থায় তার চাচাতো ভাই দাউদ খানের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। জহির শাহ উৎখাত হন। দাউদ খান জহির শাহের শাসনব্যবস্থাকে পছন্দ করতেন না। তাই শাসনক্ষমতা হাতে নিয়েই তিনি আফগানিস্তানের শাসনব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনেন। রাজতন্ত্র বাতিল করেন। নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। এছাড়াও দাউদ খান পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনেন। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতার আড়ালে মূলত আফগানিস্তান দখলের চেষ্টা করছে।
তার এই আশঙ্কা কিন্তু একেবারেই অমূলক ছিল না। কেননা আফগানিস্তানের সরকারে সোভিয়েতপন্থী ব্যক্তির সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছিল যা তার কাছে কাকতালীয় মনে হয়নি। ফলে তিনি সোভিয়েতের বলয় থেকে বের হয়ে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালান। সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভের আপত্তির জবাবে দাউদ খান সাফ জানিয়ে দেন- “আফগানিস্তান স্বাধীন দেশ হিসেবে থাকবে এবং কীভাবে দেশ চলবে সে বিষয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে নির্দেশ দিতে দেওয়া হবে না।”
পরিস্থিতি বিবেচনায় সোভিয়েত ইউনিয়ন বিকল্প পথে হাঁটতে থাকে। তবে সেই পথ পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আফগানিস্তান কারো জন্যই সুখকর হয়নি। এখানে বলে নেওয়া দরকার- আফগানিস্তানে ১৯৬৫ সালের পহেলা জানুয়ারি পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অব আফগানিস্তান (পিডিপিএ) নামের বামপন্থী একটি দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দলটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বারবাক কারমাল ও নুর মোহাম্মদ তারাকি। সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন দেখল দাউদ খান পুঁজিবাদী বলয়ে ঢুকে পড়ছে, তখন দাউদ খানকে সরিয়ে দিয়ে আফগানিস্তানের বামপন্থী দলটিকে ক্ষমতায় বসানোর পরিকল্পনা করল সোভিয়েত সরকার। এই পরিকল্পনাটি সোভিয়েত সরকারের অদূরদর্শিতার পরিচয় দেয়। কেননা আফগানিস্তানের জনগণের মধ্যে এই বামপন্থী দলটির কোনো সমর্থনই ছিল না। উপরন্তু সেই বামপন্থী দলটি ঐক্যবদ্ধও নয়। দলটির নেতাদের মধ্যে পাস্পরিক শত্রুতা বিরাজ করছিল। তারপরও সোভিয়েত ইউনিয়ন সেই কমিউনিস্ট দলকেই আশ্রয় করতে বাধ্য হয়। এদিকে দাউদ খানও কম যান না। তিনি বুঝতে পারলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন পিডিপিএ- এর সহায়তায় নতুন কোনো চক্রান্ত করছে। কাজেই তিনি দলটার শীর্ষস্থানীয় নেতাদেরকে গ্রেফতার করা শুরু করলেন। কেউ গ্রেফতার হলো, কেউ সোভিয়েত ইউনিয়নে পালিয়ে গেল, আবার কেউ গৃহবন্দী হয়ে গেল। পিডিপিএ নেতা হাফিজুল্লাহ আমিন গৃহবন্দী অবস্থায় তার অনুগত সেনা কর্মকর্তাদেরকে বিদ্রোহের ডাক দিলেন। সেই ডাকেই কাজ হয়ে গেল, কারণ অভ্যুত্থানের প্রয়োজনীয় সবকিছুই আগে থেকে প্রস্তুত ছিল। বিদ্রোহের সংগঠকরা আগেই সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছিলেন। ১৯৭৮ সালের ২৭ ও ২৮ এপ্রিল সংঘটিত এই বিদ্রোহে প্রেসিডেন্ট দাউদ ক্ষমতাচ্যুত ও সপরিবারে নিহত হলেন। ইতিহাসে এই বিদ্রোহকে “সাউর বিপ্লব” নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
সাউর বিপ্লবের পর আরেকদফা আফগানিস্তানের রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিবর্তন এলো। তবে এবারের পরিবর্তনকে শুধু পরিবর্তন না বলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন বলা যায়। কেননা কমিউনিস্ট দলটি ক্ষমতা হাতে পেয়েই প্রচলিত সিস্টেম বাতিল করে দিয়ে কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুকরণে আফগানিস্তানকে পরিচালনা করতে চাইল। দেশটির নতুন নাম দেওয়া হলো- ‘আফগানিস্তান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র।’ ক্রমেই আফগানিস্তানের জনসাধারণ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গন বুঝতে পারল আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট বিপ্লব হয়ে গেছে এবং এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের কপালে পড়ল চিন্তার ভাজ। কাবুলের মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে প্রেরিত টেলিগ্রামে বলা হলো- “প্রথম ব্রিটিশ ও পরে মার্কিনরা শত বছর ধরে যা প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে, তা সংঘটিত হয়ে গেছে। রুশ ভালুক হিন্দুকুশের দক্ষিণে এসে পড়েছে।”
সাউর বিপ্লব পরবর্তী গৃহযুদ্ধ
সাউর বিপ্লবের পর ক্ষমতায় আসা কমিউনিস্ট সরকারের বড় ভুল ছিল জনগণকে প্রস্তুত না করেই কমিউনিস্ট মতাদর্শ জোর করে গেলানোর চেষ্টা করা। তাদের এই জোর-জবরদস্তি ও তাড়াহুড়ার ফল হলো বুমেরাং। বিভিন্ন গোত্রপ্রধান, বিভিন্ন ইসলামপন্থী দল ও আফগান মোল্লাদের প্রচণ্ড বিরোধিতা শুরু হলো। এসব বিরোধিতার বহুমুখী কারণ ছিল। ক্ষমতা হারানোর ভয়, জায়গা-জমি হারানোর ভয়, ঐতিহ্য নষ্ট হবার ভয়, ঈমান হারানোর ভয় ইত্যাদি। ১৯৭৮ সালের মাঝামাঝি এসব বিরোধিতা রীতিমত বিদ্রোহে রূপ নিতে লাগলো। পূর্ব আফগানিস্তান নুরিস্তান প্রদেশে বিদ্রোহীরা স্থানীয় সেনানিবাসে আক্রমণ করে এবং শীঘ্রই সারা দেশে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে আফগান সরকারও অত্যন্ত কঠোর হস্তে বিদ্রোহ দমন করতে থাকে। এই বিদ্রোহ দমন করতে তৎকালীন আফগান সরকার ১৯৭৮ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কুখ্যাত পুল-এ-চারখি কারাগারেই অন্তত ২৭,০০০ বন্দিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। এ সময় সরকারি নির্যাতন ও নিষ্পেষণ যত বাড়তে থাকে বিদ্রোহও তত জোরালো হতে থাকে। দেখা যায় ১৯৭৯ সালের বসন্তকালের মধ্যে দেশের ২৮টি প্রদেশের মধ্যে ২৪টিতেই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহগুলোতে হাজার হাজার মানুষ মারা যেতে থাকে। পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে ওঠে।
আফগানিস্তান সরকারের সামনে এমন একটা অবস্থা দাঁড়ায় যেখান থেকে আর পেছনে ফেরা সম্ভব নয়। হয় সামরিক শক্তিবলে চরম নিষ্ঠুরতার সাথে বিদ্রোহ দমন করতে হবে অথবা তল্পিতল্পা গুটিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে হবে। আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকার প্রথমটিই বেছে নিল। এই সময় আফগানিস্তানের পিডিপিএ সরকার বারবার সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে সামরিক সহায়তার জন্য আবেদন জানাতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথমে সেনা পাঠাতে আপত্তি জানায়, তবে অস্ত্র সহায়তা অব্যাহত রাখে। কিন্তু পরিস্থিতি বেশি খারাপ হয়ে গেলে এবং আফগান সরকারের নিয়ন্ত্রণ শুধু শহরাঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকারকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার জন্য সেনা পাঠায়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন সেনা পাঠায়, তারা বলেছিল তাদের সেনারা আফগানিস্তানে থাকবে মাত্র ছয় মাস। তারা কি ঘুনাক্ষরেও ভেবেছিল- ছয় মাস নয়, ছয় বছরেও এই যুদ্ধের শেষ হবে না? বস্তুত তারা সেদিন দশ বছরের এমন একটি যুদ্ধের জন্ম দিয়েছিল যা সোভিয়েত ইউনিয়নকেই ভেঙে টুকরা টুকরা করে ফেলেছে।
সোভিয়েতের সেনারা আফগানিস্তানে ঢুকতেই বিদ্রোহ আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে। আফগানিস্তানের বিভিন্ন গোত্র ও জাতিগোষ্ঠী এটাকে ভিনদেশী আক্রমণ হিসেবে দেখতে শুরু করে এবং ইসলামপন্থীরা এটিকে ইসলামবিরোধী শক্তির আগ্রাসন হিসেবে দেখতে শুরু করে। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই বিদ্রোহ আরও বেগবান হয়ে ওঠে এবং আফগান গৃহযুদ্ধের বদলে এই যুদ্ধটি সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধে পরিণত হয়। বিশ্বের সুপার পাওয়ার সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত সেনাদের সাঁড়াশি আক্রমণে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতে থাকে একের পর এক গ্রাম, ধর্ষিতা হতে থাকে আফগান নারীরা, অকাতরে প্রাণ হারাতে থাকে আফগান যোদ্ধারা।
পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো কী ভাবছিল?
পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবার নড়েচড়ে বসল। কী করা যেতে পারে? আফগানিস্তানের মত গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ সোভিয়েতের হাতে চলে গেলে মুশকিল, আবার সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো মিলিটারি একশনে গেলে কুরুক্ষেত্র বেঁধে যাবে। সময়টা স্নায়ুযুদ্ধের- তা আগেই বলে এসেছি। কাজেই মার্কিন সেনাকে সোভিয়েত সেনার মুখোমুখী দাঁড় করানো যাবে না- এই নীতি ঠিক রেখে যা কিছু করা যায় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রকে তা করতে হবে। সিআইএ’র ধূর্ত অফিসাররা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সমন্বয় কমিটির কাছে আফগানিস্তানে গুপ্ত অভিযান পরিচালনার বেশ কয়েকটি পথ তুলে ধরলেন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত রাখলেন মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ওয়াল্টার স্লোকাম্বে। তিনি প্রস্তাব রাখলেন “সোভিয়েত ইউনিয়নকে আফগানিস্তানের মাটিতে আটকে ফেলতে হবে।” সম্ভবত ওয়াল্টার স্লোকাম্বের ওই প্রস্তাবটিই যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা গ্রহণ করেছিলেন, যা পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে স্পষ্ট বোঝা যায়।
আগুন নিয়ে খেলা শুরু করল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
ওয়াল্টার স্লোকাম্বের প্রস্তাব মোতাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে আফগানিস্তানের মাটিতে আটকে ফেলার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত বিপদজনক এক খেলা শুরু করল। যাকে বলে আগুন নিয়ে খেলা। যুক্তরাষ্ট্র ধর্মকে ব্যবহার করা শুরু করল। পুঁজিবাদী এই দেশটি দেখল আফগানিস্তানের মানুষ প্রচণ্ড ধর্মভীরু। কট্টর ইসলামপন্থী। এই মানুষগুলোকে যদি বোঝানো যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট নাস্তিকরা ইসলামবিরোধী, কাফের, এরা ইসলাম ধ্বংস করতে চায়, এদের বিরুদ্ধে জেহাদ করতে হবে; তাহলে এই আফগানরাই শুধু নয়, বহির্বিশ্ব থেকেও হাজার হাজার মুসলিম যুবক-তরুণ আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করার জন্য আফগানিস্তানে ছুটে আসবে। সেই মুজাহিদদের জীবন ও রক্তের বিনিময়ে চিরশত্রু সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধরাশায়ী করা সহজ হয়ে যাবে। আমেরিকার একটা সৈন্যও মরবে না, মরবে শুধু সোভিয়েত বাহিনী ও মুসলিম জেহাদীরা। আর বিজয়ের স্বাদ পাবে মার্কিনীরা। যাকে বলে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা কিংবা কৈ-এর তেলে কৈ ভাজা।
এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা আরবীয় মিত্র দেশগুলোর সহযোগে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে এমন কিছু ধর্মব্যবসায়ী ভাড়া করল যাদের দায়িত্ব ছিল মুসলিম তরুণদেরকে জিহাদের কথা বলে উদ্বুদ্ধ করে আফগানিস্তানের যুদ্ধভূমিতে যেতে উৎসাহিত করা। তাদের কথায় উৎসাহিত হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার তরুণ আফগানিস্তানে ছুটে গেল ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ’ করার জন্য। আর পর্দার আড়াল থেকে তাদের অস্ত্র, অর্থ ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জামাদি সরবরাহ করে গেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সামরিক পরিভাষায় এ ধরনের যুদ্ধকে ছায়াযুদ্ধ চৎড়ীু ধিৎ বলা হয়ে থাকে।
যারা এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চান তারা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের ইতিকথা – আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা’ বইটি পড়ে দেখতে পারেন। আমরা কেবল ধারণা দেওয়ার জন্য বইটির ১২৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখকৃত কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি, “(মার্কিন প্রেসিডেন্ট) কার্টারের রুশবিরোধী দল পাকিস্তান, মিশর আর সৌদি আরবের সাহায্য সম্বন্ধে একরকম নিশ্চিতই ছিল। এ উপদেষ্টাদের এখন প্রয়োজন, এ যুদ্ধে তিনটি উপকরণের, অর্থ, জনবল আর অস্ত্রের নিশ্চয়তা। এগুলোর সমন্বয়েই এ যুদ্ধ পরিচালিত হবে। প্রাথমিকভাবে ঈওঅ এবং পরে ধনী মুসলিম দেশগুলোকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এরপরে রয়েছে জনবল। বেশিরভাগ যোদ্ধা আফগান আর পাকিস্তানের সীমান্ত থেকেই আসবে, সে সাথে অন্যান্য মুসলিম দেশ এবং বিভিন্ন স্থানের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী সংগ্রহ করে এ যুদ্ধের জনবল যোগাড় হবে। এ যুদ্ধের জন্যে রাশিয়ার তৈরি অস্ত্র যোগাড় করে পরে এ ধরনের অস্ত্র তৈরি করবার উপযুক্ত দেশ খুঁজতে হবে। প্রশিক্ষণের জন্য পাকিস্তানের আফগানিস্তান সংলগ্ন স্থানগুলো উত্তম বলে বিবেচিত হয়েছিল, তাই সাব্যস্ত হলো এর দায়িত্ব ঈওঅ-র তত্ত্বাবধানে ওঝও এ প্রশিক্ষণ পরিচালনা করবে। মোটামুটি এই ছিল সোভিয়েতবিরোধী জেহাদের পরিকল্পনার মোটা দাগগুলো।”
এই যে বিভিন্ন মুসলিমপ্রধান দেশ থেকে লাখ লাখ যুবক আফগানিস্তানে ছুটে গিয়েছিল আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করার জন্য, তারা কি বুঝেছিলেন যে, এটা জেহাদ ফি সাবিলিল্লাহ নয়, এটি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাথের্র যুদ্ধ, এ যুদ্ধে আল্লাহ-রসুলের কিছু আসে যায় না? বুঝতে পারেন নি, কারণ এই যুবকদেরকে প্রাণদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে হাজার হাজার ধর্মব্যবসায়ীকে ভাড়া করেছিল যারা তাদের যার যার দেশের যুবকদেরকে যুদ্ধে যোগদানের জন্য উত্তেজিত ও সংঘটিত করেছিল। তারা বলত যে এটা যুদ্ধ নয়, জেহাদ ও কেতাল ফি-সাবিলিল্লাহ।
প্রাগুক্ত গ্রন্থে মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম. সাখাওয়াত হোসেন লিখেছেন, “আফগান জেহাদে যোগদানকারী আরবদের মধ্যে মিশরের জেহাদিদের সংখ্যায় ছিল বেশি। এর কারণ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য ইসলামের পুনঃজাগরণের প্রচেষ্টার সাথে মিশরের উত্তর হতে দক্ষিণ পর্যন্ত গোপন সংস্থাগুলো তৎপর রয়েছে বেশি। তদুপরি আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যাপীঠে সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠী থেকে ছাত্ররা একত্রিত হয় উচ্চ শিক্ষার জন্যে। এখানে পরিচিত হয় ইসলাম প্রবর্তনের তথাকথিত অগ্রগামী ধর্মীয় গুরুদের সাথে।”
আফগানিস্তানে বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে যে কট্টরপন্থী ইসলামিস্টরা এসেছিলেন তাদেরকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ওসামা বিন লাদেন, আব্দুল্লাহ আজ্জাম প্রমুখ। এমনিভাবে আজকের যত জঙ্গি নেতাদের নাম উল্লেখ করা হচ্ছে তাদের বেশিরভাগই আফগান ছায়াযুদ্ধের (চৎড়ীু ধিৎ) অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রাক্তন অথবা নবীন যোদ্ধা। মার্কিনি গোয়েন্দা সংস্থা ঈওঅ এই সব স্বেচ্ছাসেবী জঙ্গিদের তালিকা সংরক্ষণ করত যে ডেটাবেইজ-এ, সেই কম্পিউটার ফাইলটির নাম ছিল “আল কায়েদা”, যার আক্ষরিক অর্থই হচ্ছে ডেটাবেইজ, বেইজ বা ভিত্তি। সুতরাং আল কায়েদা কোনো বিশেষ সামরিক দলের নাম ছিল না, আফগানিস্তানে লড়াই করতে আসা সকল ইসলামিস্টরাই ছিল আল কায়েদা নামক তালিকাটির অন্তর্ভুক্ত। ঈড়-ড়ঢ়বৎধঃরাব জবংবধৎপয ঐরংঃড়ৎু ঈড়সসড়হং. জবঃৎরবাবফ ঔধহঁধৎু ৯, ২০০৭.- এর বিবরণে সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে, অ ঈওঅ ঢ়ৎড়মৎধস পধষষবফ “ঙঢ়বৎধঃরড়হ ঈুপষড়হব” পযধহহবষবফ ভঁহফং ঃযৎড়ঁময চধশরংঃধহ’ং ওহঃবৎ-ঝবৎারপবং ওহঃবষষরমবহপব ধমবহপু ঃড় ঃযব অভমযধহ গঁলধযরফববহ যিড় বিৎব ভরমযঃরহম ঃযব ঝড়ারবঃ ড়পপঁঢ়ধঃরড়হ. ঈওঅ ধহফ ইৎরঃরংয জবপৎঁরঃ ধহফ ঞৎধরহ গরষরঃধহঃং ডড়ৎষফরিফব ঃড় ঐবষঢ় ঋরমযঃ অভমযধহ ডধৎ.
অর্থাৎ অপারেশান সাইক্লোন নামে ঈওঅ-র একটি কর্মসূচি ছিল যা পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে আফগান মোজাহেদিনদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করত। ঈওঅ এবং ব্রিটিশ আফগান যুদ্ধের জন্য সারা বিশ্ব থেকে ‘মিলিট্যান্ট’ (জঙ্গি) রিক্রুট করেছে এবং তাদেরকে প্রশিক্ষিত করে তুলেছে।
পাঠক, এই সোভিয়েত বিরোধী কথিত জেহাদের ফলাফল কী হয়েছিল এবং কীভাবে এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সংঘটিত জেহাদের তথাকথিত “মুজাহিদিনরা” পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে “সন্ত্রাসী” হয়ে উঠল, যুক্তরাষ্ট্রের এই আগুন নিয়ে খেলার পরিণতিতে কীভাবে আল কায়েদা ও তালেবানসহ বিভিন্ন মুসলিমপ্রধান দেশে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর সৃষ্টি হলো সেই ইতিহাস আমরা পরবর্তী লেখায় তুলে ধরব। জানার ও বোঝার চেষ্টা করব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে হাজার হাজার মুসলিম তরুণ যেই জেহাদ ফি সাবিলিল্লাহ করার জন্য আফগানিস্তানে ছুটে গিয়েছিল, তাদের রক্ত ও জীবনের বিনিময়ে ইসলামের আদৌ কোনো লাভ হয়েছে, নাকি আন্তর্জাতিক পরাশক্তিদের স্বার্থের খেলায় তাদের জীবন শুধুই দাবার ঘুটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে? থাকছে পরবর্তী লেখায়।
প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে
https://hezbuttawheed.org/%e0%a6%86%e0%a6%ab%e0%a6%97%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%a8-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%b6%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b0/