মাননীয় এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর লেখা থেকে:
দুনিয়াময় মুসলিম জনগোষ্ঠীর আজ চরম দুর্দশা। অন্য সব জাতি দ্বারা তারা পরাজিত, অপমানিত, নির্যাতিত। অপরদিকে দুনিয়াব্যাপী অন্যায়-অবিচার, দুর্নীতি, কোন্দল, হানাহানি, যুদ্ধ, রক্তপাতের আধিক্য পৃথিবীর সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। রাসুলাল্লাহর (সা.) আগমন পূর্বাপর যুগকে আইয়্যামে জাহেলিয়াতের বা অন্ধকারের যুগ বলা হত। কারণ তখন পৃথিবীর কোথাও ইসলাম ছিল না। আজ ১৬০ কোটি মুসলিম ইসলামের অনুসারী হবার দাবিদার, ৫৫ টি দেশে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। অথচ বর্তমান পৃথিবী আইয়্যামে জাহিলিয়াতের চেয়েও অন্ধকারে নিমজ্জিত। এর কারণ মুসলিম নামধারী বর্তমানের এই জনসংখ্যাটি আল্লাহর অস্তিত্বকে, তাঁর একত্বকে অবিশ্বাস না করলেও আল্লাহর সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করে দাজ্জালের অর্থাৎ ইহুদী-খ্রিস্টান সভ্যতার, যে সভ্যতার সার্বভৌমত্ব আল্লাহর নয়, মানুষের; তা মেনে নিয়ে তার আনুগত্য করছে।
ঠিক এই অবস্থা ছিলো আরবের মানুষের চৌদ্দশ’ বছর আগে যখন আল্লাহ তাঁর রসুলকে সেখানে পাঠালেন। তখনকার ওই আরবরা আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্বে তেমনি বিশ্বাস করতো যেমন আজ আমরা করি; তিনি যে স্রষ্টা, প্রতিপালক, সব কিছুর নিয়ামক, তিনি যে সর্বশক্তিমান এ সব কিছুই তারা বিশ্বাস করতো ( সুরা যুখরুফ ৯; সুরা আনকাবুত ৬১ ও ৬৩; সুরা লোকমান ২৫)। তারা ইবরাহীমকে (আ.) আল্লাহর নবী বলে বিশ্বাস করতো; নিজেদের মিল্লাতে ইবরাহীম বলে বিশ্বাস করতো; ইবরাহীম (আ.) দ্বারা পুননির্মিত কাবাকে আল্লাহর ঘর বলে বিশ্বাস করতো; কাবার দিকে মুখ করে ইবরাহীমের (আ.) শেখানো পদ্ধতিতে সালাহ (নামাজ) কায়েম করতো; কাবাকে কেন্দ্র করে বছরে একবার হজ করতো; কাবা তওয়াফ (পরিক্রমা) করতো; সেখানে যেয়ে আল্লাহর রাস্তায় পশু কোরবানী করতো; বছরে একমাস, রমাদান মাসে সওম (রোজা) পালন করতো; এমন কি প্রত্যেকে ইবরাহীমের (আ.) শেখানো খাতনা করতো। তারা প্রতি কাজে আল্লাহর নাম নিতো, দলিল ইত্যাদি লিখতে, বিয়ে-শাদীর কাবিন লিখতে তারা প্রথমেই উপরে আল্লাহর নাম লিখে আরম্ভ করতো। তাহলে যাদের মধ্যে আল্লাহর রসুল তওহীদ অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য আসলেন তাদের সাথে বর্তমানের মুসলিম বলে পরিচিত এই জনসংখ্যার তফাৎ কোথায়?
যদি বলেন যে তারা মূর্তিপূজা করতো তবে তার জবাব হচ্ছে এই যে ওই মোশরেক আরবরা ওই মূর্তিগুলোকে আল্লাহ বলে বিশ্বাস করতো না, তাদের স্রষ্টা বলেও বিশ্বাস করতো না, তাদের প্রভু (রব) বলেও বিশ্বাস করতো না। তারা বিশ্বাস করতো ওগুলি আল্লাহর নিকটবর্তী, ঘনিষ্ঠ এবং প্রিয়জন। তারা ওগুলির পূজা করতো দু’টো কারণে-
প্রথমত, যেহেতু ওগুলো আল্লাহর ঘনিষ্ঠ সেহেতু তারা পূজারীদের পক্ষ হয়ে কোন ব্যাপারে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করলে আল্লাহ তা মঞ্জুর করবেন। যেমন রোগ-শোক থেকে মুক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্যে সাফল্য, কোন বিপদ থেকে উদ্ধার ইত্যাদি। এ কথার প্রমাণ এই যে, স্বয়ং আল্লাহ বলছেন, “তারা আল্লাহ ব্যতীত যার ইবাদত করে তা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। তারা বলে, এইগুলি আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী (সুরা ইউনুস ১৮)।”
দ্বিতীয়ত তারা বিশ্বাস করতো যে যেহেতু ওই মূর্তিগুলি, ওই দেব-দেবীগুলি আল্লাহর ঘনিষ্ঠ ও প্রিয় কাজেই তাদের পূজা করে তাদের সন্তুষ্ট করতে পারলে তারা পূজারীদের আল্লাহর সান্নিধ্য (কুরবিয়াহ) এনে দেবে। এ ব্যাপারেও আল্লাহ বলেছেন, “যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে তারা বলে, আমরা তো এদের পূজা এ জন্যই করি যে, এরা আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দিবে (সুরা যুমার ৩)।” দেখা যাচ্ছে- আরব মোশরেকদের মূর্তিপূজার পেছনে দু’টো উদ্দেশ্য ছিলো, একটি দুনিয়াদারী, অন্যটি আখেরাত। ওই মূর্তিগুলিকে আরবের মোশরেকরা কখনই আল্লাহর স্থানে বসায় নিই।
তাহলে প্রশ্ন হোচ্ছে- আজ মুসলিম বলে পরিচিত এই জনসংখ্যাটি (কোন উম্মাহ নয়) যে দীনটাকে পালন করে নিজেদের মো’মেন, মুসলিম ও উম্মতে মোহাম্মদী বলে বিশ্বাস করে এবং মৃত্যুর পর জান্নাতে যাবার আশা করে ওই জনসংখ্যাটি এবং আরবের ওই মোশরেকদের জাতিটি যার মধ্যে তাদের হেদায়াহর জন্য আল্লাহ তাঁর রসুল প্রেরণ করলেন এ দু’টোর মধ্যে প্রভেদ কোথায়? ওই আরবদের মধ্যে যদি রসুল পাঠানোর প্রয়োজন হয়ে থাকে তবে এখনকার এই জনসংখ্যার অবস্থা কী?
উত্তর হচ্ছে- আল্লাহর অস্তিত্বে ও একত্বে বিশ্বাস (ঈমান) থাকা সত্ত্বেও এবং অতসব ইবাদত সত্ত্বেও ওই আরবরা মোশরেক ছিল, কারণ তাদের মধ্যে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ছিলো না। তাদের সার্বভৌম, ইলাহ ছিল কাবা ঘরের অভিভাবক, কোরায়েশরা। তাদের দীন ছিলো কোরায়েশরা যে সিদ্ধান্ত দিবে তা পালন করা। আজ যেমন এই জাতির ইলাহ হল দাজ্জাল অর্থাৎ ইহুদি খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’ আর তাদের দীন হল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, রাজতন্ত্র, আমীরতন্ত্র ইত্যাদি।
বর্তমানের মুসলিম বলে পরিচিত এই জনসংখ্যা ওই মোশরেক আরবদের মতই আল্লাহর অস্তিত্বে, একত্বে বিশ্বাসী, সালাহ (নামাজ) কায়েম করে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান-খয়রাত (যাকাত) করে, বছরে একবার হজ করে, কা’বা তওয়াফ করে, রমাদান মাসে সওম (রোজা) রাখে এবং খাতনা করে কিন্তু ওই আরবদের মতই এ জনসংখ্যা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ত্যাগ করে দাজ্জালের অর্থাৎ মানুষের সার্বভৌমত্বকে গ্রহণ করে মানুষের সিদ্ধান্ত পালন করছে তাদের জাতীয় জীবনে। তাই তারাও সেই আরবদের মতই মোশরেক ও কাফের হয়ে গেছে। এজন্যই আল্লাহর রসুল মক্কায় আগত কাফের হাজীদের তাবুতে তাবুতে গিয়ে তওহীদের বালাগ দিয়েছেন। প্রতি বছর মক্কায় হজের প্রচলন করেন বাবা ইব্রাহীম (আ.)। তিনি ও তাঁর ছেলে ইসমাইল (আ.) কা’বা গৃহের পুনর্নির্মাণের পর আল্লাহ ইব্রাহীমকে (আ.) হুকুম করলেন, “মানুষের জন্য হজের ঘোষণা প্রচার করো। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে (সুরা হজ ২৭)।”
এরপর প্রতি বছরই ইব্রাহীম (আ.) হজে আসতেন। তাঁর ওফাতের পর ইসমাইল (আ.) এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেন। কালক্রমে হজের উদ্দেশ্য ও প্রক্রিয়া বিকৃত হতে লাগলো। মিল্লাতে ইব্রাহীমের মধ্যে প্রবেশ করল পৌত্তলিকতা। কাবা প্রাঙ্গনে এবং এর অভ্যন্তরে ৩৬০ টি প্রতিমা স্থাপনের কারণে কাবা তার পবিত্রতা হারালো। কবিতা লিখে আর ছবি টাঙিয়ে মোশরেকরা এর দেয়ালগুলিকে প্রায় ঢেকে দিল। এর মধ্যে মা মরিয়ম ও ঈসা (আ.) এর একটি ছবিও ছিল। হজ আগে কাবায় হতো, আরাফতে নয়। কাবায় তওয়াফ হতো, কোরবানী হতো, বহু যুগ থেকে হতো, এবং তা মোশরেকরা করতো। শেষ নবী হজকে নিয়ে গেলেন আরাফাতের ময়দানে, কিন্তু হজের অঙ্গ হিসেবে কাবা তওয়াফ ঠিক রইলো। পার্থক্য শুধু এই হলো যে আগে মোশরেকরা সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে তওয়াফ করতো তা এক ধাপ তফাৎ করে সেলাই বিহীন দু’টুকরো কাপড় জড়িয়ে করা হয়। প্রাক-ইসলামের হজের সঙ্গে ইসলামের ‘হজের’ আনুষ্ঠানিকতায় খুব বেশী তফাৎ ছিলো না, এখনও নেই। আসমান জমীনের তফাৎ এসে গেলো দু’টো বিষয়ে, দু’টো আকীদায়। একটা হলো- কা’বার ভেতরের মূর্তিগুলি অদৃশ্য হয়ে গেলো, দ্বিতীয় হলো মোশরেকদের ‘ইবাদতের’ বদলে একে করা হলো বিশ্ব-মুসলিমদের বার্ষিক মহা সম্মেলন। যেহেতু মুসলিমদের দীন ও দুনিয়া এক, কাজেই এ মহাসম্মেলনের রাজনৈতিক, সামাজিক, আইনগত অর্থাৎ জাতীয় দিকটার সঙ্গে মুসলিমদের ব্যক্তিগত আত্মার দিক অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িত। তাই মুসলিম হজে যেয়ে যেমন উম্মাহর জাতীয় সমস্ত সমস্যার সমাধানে অংশ নেবে, তেমনি আরাফাতের ময়দানকে হাশরের ময়দান মনে করে নিজেকে আল্লাহর সামনে উপস্থিত বলে মনে করবে। মনে করবে মুসলিম হিসাবে, উম্মতে মোহাম্মাদী হিসাবে তার উপর যে দায়িত্ব অর্পিত ছিলো তার কতটুকু সে পূরণ করতে পেরেছে সে হিসাব তাকে আজ দিতে হবে। প্রাক-ইসলামী অজ্ঞানতার যুগে (আইয়ামে জাহেলিয়াতে) মোশরেকরা উলঙ্গ হয়ে হজ করতো কারণ হাশরের ময়দানে সমস্ত নারী-পুরুষ উলঙ্গ থাকবে। ইসলাম শুধু দু’টুকরো সেলাইহীন কাপড় দিয়ে সেটাকে শালীন করেছে। জাতীয় জীবনের সবকিছু বাদ দিয়ে আজ হজ আবার উল্টে সেই মোশরেকদের হজের মত শুধু ব্যক্তিগত ইবাদতে ফিরে গেছে।
অবশ্য স্বীকার করতে হবে যে একদিক দিয়ে বর্তমানের হজ ও নামাজ বাহ্যিকভাবে ঠিকই আছে। সেটা হলো এই ভাবে, বিশ্বনবী ওফাতের ৬০/৭০ বছর পর থেকে এই উম্মাহর সমস্ত দুনিয়াতে এই দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, জেহাদ নেই, যুদ্ধও (কিতাল) নেই। কাজেই বার্ষিক সম্মেলনে (হজে) পরামর্শ আলোচনা, সিদ্ধান্তেরও কোন প্রয়োজন নেই, প্রশিক্ষণ ট্রেনিং (নামাজ) এরও কোন প্রয়োজন নেই। মহানবীর সময়, খোলাফায়ে রাশেদুনের সময় ও তার পরও কিছু সময় পর্যন্ত আরাফাতের হজ করতে যারা যেতেন, তারা যদিও বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষার, বিভিন্ন রংয়ের মানুষ ছিলেন, কিন্তু তারা এক জাতিভুক্ত লোক ছিলেন, একই আকীদার মানুষ ছিলেন, তারা ছিলেন তওহীদবাদী।
মুসলিম, এক আল্লাহর ও তাঁর দেয়া জীবন-বিধান (দীন) ছাড়া তারা আর কোন কিছুই মানতেন না। শুধু মানতেন না তাই নয় তারা জানতেন ঐ অন্যগুলি ধ্বংস করে সেখানে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে প্রকৃত ইবাদত এবং রসুলাল্লাহর প্রকৃত সুন্নাহ। তারা তাদের কর্তব্য সম্পাদনের পর দুনিয়া থেকে চলে যাবার পর থেকে, জেহাদ ছেড়ে দেবার পর থেকে যারা হজ করেন তারা তওহীদবাদী আল্লাহর সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী শুধু ব্যক্তিগতভাবে, জাতিগতভাবে নয়। জাতিগতভাবে তারা কেউ গণতন্ত্রী (জনগণের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী) কেউ সমাজতন্ত্রী, কমিউনিস্ট (মানুষের একটি বিশেষ শ্রেণির সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী) কেউ একনায়কত্বে, কেউ রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ইত্যাদি। তারা তো একে অপরের শত্রু! কাজেই তাদের তো একত্রে বসে আলোচনার, পরামর্শের প্রশ্নই ওঠে না। এই ‘হাজী’দের কে বলে দেবে যে তাদের ঐ আংশিক তওহীদ অর্থাৎ শিরক হজ আল্লাহ শুধু যে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করবেন তাই নয়, তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে, তিনি কোন অবস্থাতেই শিরক মাফ করবেন না। কোর’আনে আল্লাহ বলেছেন, “আমি আমার রসুলকে (মোহাম্মাদ সা.) দুনিয়াতে পাঠিয়েছি এই জন্য যে, তিনি যেন দুনিয়ার অন্যান্য সব দীনগুলিকে (জীবন-ব্যবস্থা) বাতিল, বিলুপ্ত করে দিয়ে এই শেষ দীন ইসলামকে সমস্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই কথার সত্যতার সাক্ষী হিসাবে আমিই যথেষ্ট (সূরা আল ফাতাহ ২৮)।”
ঐ যে বিরাট কাজের ভার দিয়ে আল্লাহ তাঁর শেষ রসুলকে পাঠালেন ঐ কাজ পূর্ণ করতে গেলে যে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম করতে হবে, তা বর্তমানের মহা ধার্মিক মুসলিমরা না বুঝলেও আল্লাহ ও তার রসুল বুঝতেন বলেই বিশ্বনবী তার অনুসারীদের বললেন, “আমি আদিষ্ট হয়েছি (আল্লাহ কর্তৃক) সর্বাত্মক সংগ্রাম চালিয়ে যেতে যে পর্যন্ত না সমস্ত দুনিয়ার মানুষ স্বীকার করে নেয় যে আল্লাহ ছাড়া বিধানদাতা, বিধাতা (ইলাহ) আর কেউ নেই, মোহাম্মদ তার রসুল, নামাজ কায়েম করে এবং যাকাত দেয় [হাদীস- আব্দাল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে, বোখারী]।” ঐ কাজ সর্বাত্মক সংগ্রাম (জেহাদ) ছাড়া সম্ভব নয় বুঝেই এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী মহানবী এক দুর্ধর্ষ, অপরাজেয় জাতি গড়ে তুললেন, যে জাতি উত্তাল মহা তরঙ্গের মত আরব থেকে বাইরে বেরিয়ে পৃথিবীর বুকের উপর গড়িয়ে পড়ে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেলো।
আর আজকের অন্তর্মুখী, অতি-মুসলিম এই ঘৃণিত জাতির আকীদায় বিশ্বনবীকে আল্লাহ দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন টাখনুর উপর পাজামা পরা শেখাতে, ডান পাশে শুয়ে ঘুমাতে, মাথায় টুপি দিতে, খানকায় বসে তসবিহ টপকাতে, গোল হয়ে বসে চিৎকার করে যিকির করতে, কুলুখ নিতে, মেসওয়াক করতে আর গোঁফ কেটে ফেলার মত সামান্য কাজ করতে। শ্রেষ্ঠ নবীর প্রকৃত সুন্নাহ জেহাদ ত্যাগ করে তার উম্মাহ হতে বহিষ্কৃত হবার শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ এই জাতির মগজ থেকে সাধারণ জ্ঞানটুকুও (Common sense) বের কোরে দিয়ে চূড়ান্ত আহাম্মকে পরিণত করে দিয়েছেন, নইলে কি করে এই আকীদা সম্ভব? আর আসল কাজ বাদ দিয়ে নিজেরা শেরকের মধ্যে ডুবে থেকে ঐ সব তুচ্ছ, খুঁটিনাটি কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থেকে নিজেদের শুধু মহা মুসলিম নয়, একেবারে উম্মতে মোহাম্মদী বলে মনে করে আল্লাহর ক্ষমা ও জান্নাতের আশা করা কতখানি নির্বুদ্ধিতা তা উপলব্ধি করার শক্তিও এই মহা পরহেজগার অতি মুসলিম জাতির নেই। কিন্তু পিছনে আমি বর্তমানে হজকে প্রাক-ইসলামী যুগের মোশরেকদের হজের সঙ্গে তুলনা করেছি। আমি জানি এ কথায় বর্তমানের মুসলিম জাতি, বিশেষ করে যারা হজ করেছেন, তারা কেমন উত্তেজিত হয়ে উঠবেন। তাদের কাছে আমার অনুরোধ- একটু শান্ত হয়ে দু’একটা কথা শুনুন। এটা ইতিহাস যে আল্লাহর রসুলের আসার আগেও বহু শতাব্দী ধরে মক্কায় প্রতি বৎসর হজ হতো- ঐ একই সময়েই- জিলহজ মাসেই, এবং কোরবানী, কা’বা তওয়াফ ইত্যাদি বহু কিছুই বর্তমানে এই হজের মতই ছিলো। তখন আরবের গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ, মারামারি সংঘর্ষ লেগেই থাকতো। এই গোত্রগুলি হজের সময় মক্কায় একে অন্যের মুখোমুখি হলেও তাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়ে হজ যাতে পণ্ড না হয় সেজন্য সমাজপতিরা নিয়ম করে দিয়েছিলেন যে হজের মাসে সমস্ত রকম বিবাদ, ঝগড়া হারাম হবে। সমস্ত আরবের মোশরেকরা ঐ নিয়ম মেনে নিয়েছিলো। হজের সময় চরম শত্রুরাও একে অন্যের প্রতি হাত উঠাতো না, কিন্তু হজ শেষে, হজের মাস শেষ হয়ে গেলেই তারা আবার যুদ্ধ, সংঘর্ষ শুরু করে দিতো। হজকে আল্লাহ ও তাঁর রসুল জারি রাখলেন মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও শৃঙ্খলার বন্ধন ও কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে। তাই বিশ্বনবী তার হজের ভাষণে উম্মাহর নিজেদের মধ্যে মারামারি অর্থাৎ অনৈক্যকে পরিষ্কার ভাষায় কুফর বলে ঘোষণা দিলেন।
বর্তমানের হজকে মোশরেকদের হজের সঙ্গে একবার তুলনা করুন। মোশরেকরা যেমন গোত্রে গোত্রে বিভক্ত ছিলো আজ এই উম্মাহ তেমনি বহু ভৌগোলিক রাষ্ট্রে (Nation States) বিভক্ত। ঐ গোত্রগুলি যেমন নিজেদের মধ্যে মারামারি ও যুদ্ধ করতো এই ভৌগোলিক রাষ্ট্রগুলির ‘মুসলিমরা’ ঠিক তেমনি মারামারি করে। মোশরেকরা যেমন হজের মাসে মক্কায় মহা শত্রুকেও কিছু বলতো না বর্তমানেও ভৌগোলিক রাষ্ট্রে বিশ্বাসী মুসলিমরাও হজের সময় ‘শত্রু’ মুখোমুখি হলে একে অপরকে আক্রমণ করে না। কিন্তু হজ থেকে যার যার দেশে ফিরে যেয়েই তারা আগের মত নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে দেয়। তাহলে আল্লাহর রসুলের আগমনের পূর্বের হজের সঙ্গে বর্তমানের হজের তফাৎ কোথায়? হ্যাঁ, একটা তফাৎ অবশ্যই আছে। হজের মাসে পূর্ণ যুদ্ধ বিরতি মোশরেকরা অলংঘনীয়ভাবে মেনে চলতো, হজে যেয়ে মোশরেকরা যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছে এমন ঘটনা পাওয়া যায় নি। কিন্তু বর্তমানের ‘মুসলিমরা’ হজের অতটুকু সম্মানও রাখে নি। (সম্পাদনা: মুস্তাফিজ শিহাব, সহকারী সাহিত্য সম্পাদক, দৈনিক বজ্রশক্তি)