মোখলেছুর রহমান সুমন
খবরে প্রকাশ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে হত্যার হুমকি দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএস। বলা হয়ে থাকে, বিশ্বের পঞ্চম অর্থনৈতিক পরাশক্তি ভারত। আগামী বিশ্বের সম্ভাব্য নেতৃত্বদানকারী দেশগুলোর সংক্ষিপ্ত তালিকায় সবাই ভারতকে স্থান দিচ্ছেন। সোয়াশ’ কোটিরও বেশি মানুষের বাস যে ভারতে, সেই ভারতের জনগণের নিরঙ্কুশ জনসমর্থন পেয়ে ক্ষমতায় এসেছেন নরেন্দ্র মোদি। যেই মোদিকে সমীহ করতে বাধ্য হয়েছে চির বৈরী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও, স্বয়ং ব্রিটেনের রাণী হাত মিলিয়েছেন যে নরেন্দ্র মোদির সাথে, সেই মোদিকে হত্যার হুমকি! চাট্টেখানি কথা নয়। এত সাহস তারা কোথায় পায় জানি না। তবে তাদের এই হম্বিতম্ভি আজকে নতুন নয়। তারা ধর্মের নামে একে একে সব ধ্বংস করে চলেছে। তারা ‘মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী’। শহীদ হও, মরো আর মারো। ভাঙ মন্দির, ভাঙ মসজিদ, ভাঙ গীর্জা, প্যাগোডা, ভাঙ প্রতœতত্ত্ব নিদর্শন। কোনো সমস্যা নেই। সবই চলছে আল্লাহর নামে। নিন্দুকেরা অবশ্য বলে থাকে, এই আইএস যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টি। যুক্তরাষ্ট্র মুসলিমদের নিঃশেষ করার জন্য গভীর ষড়যন্ত্র করে যেমন তালেবান, আল-কায়দা সৃষ্টি করেছিল, তেমনিভাবে আইএস নামক এই দানবও তারাই সৃষ্টি করেছে। এখন সেই দানব লম্ফঝম্ফ দিচ্ছে। কতটুকু লম্ফঝম্ফ দিতে পারবে সেটাও নাকি তাদের হিসাব করা আছে। সময় মতো তার ঘাড় মটকে ধরবে।
যাই হোক, আমাদের দেশেও খুনোখুনি হয়, হচ্ছে। তার অনেকগুলোতে নাম চালিয়ে দেওয়া হয় আইএসের। চাঞ্চল্যকর কিছু ঘটলেই রুটিন ওয়ার্কের মতো একজন ইহুদি মহিলার পরিচালিত ওয়েবসাইটে তাৎক্ষণিক প্রচারিত হয়, এটা আইএসের কাজ, তারা এর দায় স্বীকার করেছে। নরেন্দ্র মোদিকে হত্যা করার ঘোষণা এমনই কোনো গুজব কিনা আমরা জানি না। এর আগে ২০২০ সালের মধ্যে ভারত দখল করার ঘোষণাও দিয়েছিল তারা। জানা গেছে, আইএসের এমন উপর্যুপরি হুমকি ধমকির প্রেক্ষাপটে ভারতেও ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ রব ওঠে গেছে। ‘হিন্দু সোয়াভিমান’ নামের একটি সংগঠন আট বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৩০ বছরের তাগড়া জোয়ানদের একত্রিত করে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, দিল্লীর উপকণ্ঠ থেকে শুরু করে উত্তরাখাণ্ডের সীমান্ত পর্যন্ত বিভিন্ন শিবিরে প্রায় ১৫ হাজার লোককে তারা ইতোমধ্যে ‘সৈনিক’ হিসেবে প্রশিক্ষণ দিয়েছে বলে জানা গেছে। প্রতিদিন আরো শত শত লোক তাদের এই প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলোতে এসে যোগ দিচ্ছে। গাজিয়াবাদ জেলায় একটি মন্দিরে সংগঠনটির প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। শিবিরগুলোতে আগতদের তলোয়ার থেকে শুরু করে আগ্নেয়াস্ত্র পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘ধর্মসেনা’রূপে গড়ে তোলা হচ্ছে। তাদেরকে গীতার বাণী শুনিয়ে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। নিন্দুকদের মুখে ছাই, আইএস যদি ‘মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী’ জিকির তুলে ধর্মরক্ষার নাম করে ধ্বংস ডেকে আনতে পারে, তবে হিন্দুদের কি দোষ? গীতার বাণী শুনিয়ে, ধর্মরক্ষার স্বার্থে, পুনর্জন্মের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যুবকদের হৃদয় থেকে মৃত্যুভয় দূর করার প্রচেষ্টা তাদের পুরোহিত-পণ্ডিতরাও কেন করবেন না? এখানে অবশ্য ‘ধর্মসেনা’রা যতই আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রশিক্ষণ নিক তারা ‘জঙ্গি’ আখ্যা পাবে না। কারণ পশ্চিমাদের বন্দুকের নিশানা এখনো এদিকে তাক করা হয়নি।
এদিকে নতুন আতঙ্ক হয়ে রণভূমে পদার্পণ করেছেন ডোনল্ড ট্রাম্প। সমালোচকেরা বলে থাকেন, লোকটি ‘ক্ষ্যাপাটে’। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ তার অস্থি-মজ্জায় মিশে আছে। অথচ প্রেসিডেন্ট পদে লড়তে মার্কিন রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন পাওয়ার দৌঁড়ে তিনিই সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছেন বলে মনে করা হচ্ছে। প্রভাবশালী একেকজন ব্যক্তি ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন। এতে অবশ্য আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ ডোনল্ড ট্রাম্পরা আমাদের গণতন্ত্র শিখিয়েছে। আমরা গণতন্ত্র শিখেছি এই ট্রাম্পদের পিতৃপুরুষদের কাছে, ‘of the people, for the people and by the people’। যদিও ট্রাম্পদের পূর্বপুরুষেরাও জোরজবরদস্তি করেই আমেরিকা দখল করেছিল। মাটি খুড়ে সোনা বের করে আনার উদ্দেশ্যে সেখানে গিয়ে শেষ পর্যন্ত স্থায়িভাবে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। জাহাজ ভর্তি করে দলে দলে লোক ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে আমেরিকায় যেতে লাগলো। বসতি স্থাপনকে নির্বিঘ্ন করার জন্য সেখানকার আদি অধিবাসীদের মাথাপ্রতি পুরস্কার ঘোষণা করা হলো। ‘রেড ইন্ডিয়ান’দের কাটা মস্তক স্তুপীকৃত হতে থাকল। আদিবাসীদের যত গোত্র ছিল সবাইকে প্রায় নির্বংশ করে দিয়ে তারা গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নির্ধারণ করল। সেই ট্রাম্পরা গত কয়েক শতাব্দী ধরে বিশ্ববাসীকে মানবতা, মানবাধিকার আর গণতন্ত্র শিখিয়ে আসছে। আমরাও তাদের কাছ থেকেই এগুলো শিখেছি। তারা আমাদের গালি দিত, আমরা ধর্মবিদ্বেষী, মৌলবাদী, কট্টরপন্থী। এখন দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্পরাও মৌলবাদীসুলভ কথাবার্তার চর্চা করছে। তারা তাদের দেশে মুসলিমদের স্থান দিতে চাচ্ছে না। কারণ মুসলিমরা সন্ত্রাসী, তারা জঙ্গি। যদিও আমেরিকার সর্বশেষ ৩০০ চাঞ্চল্যকর সন্ত্রাসী ঘটনার মাত্র চার থেকে পাঁচটি ঘটনা ঘটেছে মুসলিমদের হাতে। বাকি সব ঘটনা তাদের সন্ত্রাসীরাই ঘটিয়েছে। এখন এই ঘটনাগুলো তারা তাদের গণতন্ত্র থেকে শিখলো নাকি ক্রিস্টানিটি থেকে শিখলো সেই প্রশ্ন কিন্তু অবান্তর। কারণ তাদের গায়ে ইসলামের গন্ধ নেই।
এরই মধ্যে বোকো হারাম, আশ-শাবাব উত্তর আফ্রিকায় ত্রাসের রাজত্ব করছে। তারা একবার সেনাবাহিনীর উপর হামলা করে, একবার খ্রিস্টানদের উপর হামলা করে। এই হামলাগুলোর নৈতিক যুক্তিটুকুও বিবেচনার দাবি রাখে। তারা বলে থাকে, এই সেনাবাহিনী তাদের সাবেক শাসক ফরাসিদের দালাল। আজও এই সেনাবাহিনী ঔপনিবেশিক আমলের ন্যায় প্রভুদের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে বলে তাদের অভিযোগ। সেই হিসেবে তারা নিপীড়িত, হাজার হাজার বছরের নির্যাতনের ক্ষত এখনো তারা শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে। তারা আজও না খেয়ে মরছে, কঙ্কালসার হয়ে পড়ে থাকছে, গরুর প্রস্রাব খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। সেই আফ্রিকার বিক্ষুব্ধ মানুষগুলো বন্দুক হাতে নিয়ে হামলা করার মধ্যে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। তাদের কাছে জীবন কি আর মৃত্যু কি? ওদের উপরে ইবোলা ভাইরাস টেস্ট করতে কোনো বাধা নেই। এরা তো রীতিমতো গিনিপিগ। সেই আফ্রিকান দাস জাতি আজ হবে বোকো হারাম, আগামীকাল আশ-শাবাব, পরশু অমুক, পরদিন তমুক। এতে আশ্চর্য হওয়ার যেমন কিছু নেই, খুব বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ারও কারণ নেই। কারণ ক্রীতদাস জাতি আর কতদূর ত্রাস ছড়াবে? সময় মতো তাদের গলা টিপে ধরতে কোনো বেগই পেতে হবে না। সুতরাং তাদের কথা বাদ। এদিকে তালেবান। আফগানিস্তানের মাটি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। নিজ দেশ থেকে তালেবানদের বিতাড়িত করা হয়েছে। আজ তারা পাকিস্তানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়েছে। তাদের কাছে শিক্ষক কি, শিক্ষার্থী কি, আর নারী, শিশু, বৃদ্ধ কি? সব তাদের সামনে এক। তাদেরকে মানবতার কথা বলে আর ধর্মের কথা বলে কোনো লাভ নেই। মরো, মারো, যুদ্ধ করো, যা পাও ছিনিয়ে আন, এভাবে যতদিন ভাগ্যে আছে বেঁচে থাক, এটাই বোকো হারাম, আশ-শাবাব, তালেবানদের শেষ কথা। কারণ এরচেয়ে উৎকৃষ্ট জীবন তারা কখনো পায়নি, আর পাওয়ার আশাও করে না। ডোনল্ড ট্রাম্প বা তার পূর্বসূরীরা কখনো তাদের সেই সুযোগ দেয়নি, আর দেবেও না। এ হলো পরিস্থিতি।
আমাদের দেশের গণতন্ত্র নিয়েও দু’টো কথা বলতে হয়। গত চার যুগেরও বেশি সময় ধরে আমরা এদেশে গণতন্ত্র দেখেছি বা দেখার চেষ্টা করেছি। নব্বইয়ে গণতন্ত্র ফেরানোর জন্য দুর্বার আন্দোলন হলো। নূর হোসেন শহীদ হলেন, ডাক্তার মিলন শহীদ হলেন। গণতন্ত্রের জন্য এত রক্ত, এত বিসর্জন। যাকে হটিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার জন্য এত আত্মত্যাগ, এত চেষ্টা-প্রচেষ্টা হলো, এত রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস হলো, তিনিই আবার সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন। তার দল প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তিনিও মন্ত্রীর সমমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনিও কোথাও গেলে হাজার হাজার লোক একত্রিত হয়। সেখানে তিনি ‘গণতন্ত্র গণতন্ত্র’ বলে চিৎকার করেন। তো সবকিছু গণতন্ত্রের নামেই হচ্ছে। বিরোধী দলকে দমিয়ে রাখার জন্য দলটির নেতাকর্মীদের মেরে, পিটিয়ে, জেলে ভরে, রিমান্ডে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করা হচ্ছে গণতন্ত্রের নামে। আবার এতদিনকার বিরোধী দল ও বাংলাদেশে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় সরকার পরিচালনাকারী রাজনৈতিক দলটিও যাত্রীবাহী বাস এমনকি সবজি, কবুতর, মুরগীর বাচ্চা, গরুবাহী ট্রাকে আগুন দিচ্ছে, রেল লাইন উপড়ে ফেলছে, মানুষকে পুড়িয়ে কাবাব বানাচ্ছে। এগুলোও কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য, জনস্বার্থে, জনগণের অধিকার আদায়ের জন্যই করা হচ্ছে। ওই যে, .. of the people, for the people and by the people’। সাবাশ গণতন্ত্র, সাবাশ আইএস, সাবাশ ধর্মসেনা, সাবাশ ডোনল্ড ট্রাম্প। ওদিকে স্টিফেন হকিং মিনতি করে বলেছেন, তোমরা মহাবিশ্বের অন্য কোথাও বসতি স্থাপনের আগ পর্যন্ত সতর্ক থাক। বড় কোনো যুদ্ধ-টুদ্ধ বাধিয়ে, পারমাণবিক বোমা ফাটিয়ে, কিংবা জিনগত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখনই ধ্বংস ডেকে আনিও না। যদিও জানি তোমরা পৃথিবীটা ধ্বংস করবে, তবু আপাতত ধৈর্য ধর। কোথায় থাকবে, কিভাবে থাকবে সেটা আগে বের কর, সব ঠিকঠাক কর। তারপর পৃথিবীর যা করার করিও। সাবাশ মহাবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। আমরা আমজনতা, গতর খাটা পাবলিক, খুব বেশি হলে সকাল-সন্ধ্যা ‘আপিস করি’। আমরা দুনিয়ার ভাল-মন্দ দেখলেই কি লাভ, আর না দেখলেই বা কি ক্ষতি? কেবল হাততালিটুকু দিয়ে দাঙ্গাবাজদের উৎসাহ-অনুপ্রেরণা দিতে পারি এই যা। এর বাইরে কিছু করার সামর্থ্য কি আর আমাদের আছে? শত শত বছরের গোলামি আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, শিরায় শিরায় গোলামসুলভ আচরণ, চিন্তাভাবনাকে স্থায়িভাবে গেঁড়ে দিয়েছে। আর আমাদের ধর্মগুরু, পণ্ডিত, শিক্ষকেরাও আমাদের নির্বিবাদ ভালো মানুষ হতে শিখিয়েছেন। পৃথিবীতে কি হচ্ছে, কি ঘটছে তা দেখে আমাদের কি কাজ? এত দুনিয়া দুনিয়া করে শেষে পরকালটা হারাবো নাকি? আমরা এত বোকা নই। সুতরাং দরজা, জানালাগুলো বন্ধ কর, দৃষ্টিকে সংযত রাখ, আল্লাহ-বিল্লা করে কোনো রকম মরতে পারলেই বাঁচি। ওদিকে যা হবার হোক, আল্লাহ ভরসা।