নারীদেরও পুরুষদের মতোই যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও সাহস রয়েছে। কোন সভ্য জাতি নারীদের অবহেলা করে সভ্যতার শিখরে উঠতে পারেনি। ওটা প্রাকৃতিক নিয়ম নয়। তাই যত নবী রাসুল জগতে এসেছেন সকলেই পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরকেও এগিয়ে নেওয়ার উপায় বাতলে দিয়েছেন। এজন্য কোর’আনসহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে মানবসভ্যতার অতীত গৌরবগাঁথা বর্ণনা করতে গিয়ে নারীদের ত্যাগ, মাহাত্ম্য ও সংগ্রামের কাহিনীও তুলে ধরা হয়েছে।
আমাদের অর্ধেক জনগোষ্ঠীই ‘অবলা’ নারী। পরহেজগার নারীর যে ছবি আমাদের সামনে শত শত বছর ধরে তুলে ধরা হয়েছে সে মোতাবেক চলতে হলে নারীদেরকে পর্দার অন্তরালে বন্দী না হয়ে উপায় নেই। তাদেরকে শেখানো হয়েছে, তারা থাকবে ঘরে। সেখানে থেকে তারা নামাজ-কালাম পড়বে, কোর’আন পড়বে আর স্বামী সন্তানের দেখাশোনা করবে, আসবাবপত্র পাহারা দেবে। উপনিবেশ যুগে মুসলিমদের ভূখণ্ডগুলোতে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করে সেখানে খ্রিষ্টানদের তৈরি করা বিকৃত একটি ইসলাম শেখানো হয়েছে। সেই ‘ইসলাম’- এর সিলেবাসও খ্রিষ্টান পণ্ডিতদেরই (Orientalist) তৈরি করা। এই ষড়যন্ত্রমূলক শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্যই ছিল মুসলিম জনগোষ্ঠীকে শক্তিহীন করে ফেলা। গোটা জাতির অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীদেরকে তারা আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, জাতীয়, সামরিক কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার জন্য ঐ বিকৃত পর্দাপ্রথাকে আরো বেশি করে উৎসাহিত করেছে। ফলে মুসলিম নারীদের কর্মক্ষেত্র হয়ে গেছে শুধুই গৃহকোণ। সেখানে কাজকর্ম চালাতে উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন পড়ে না, তাই নারীদেরকে শিক্ষার অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হলো। কার্যত নারীর শিক্ষিত হওয়া-না হওয়ার মধ্যে ব্যবহারিক অঙ্গনে বিশেষ কোনো পার্থক্য রইল না।
আজকে ইসলাম বলতেই আমাদের সামনে কিছু পোশাক ভেসে ওঠে, কোনো জীবনব্যবস্থা বা বিশেষ চরিত্রগুণ নয়। ইসলাম কী আসলেও আমাদেরকে পোশাকের নামে বাড়াবাড়ি করা শেখায়? ইসলাম কি সঙ্গীতকে হারাম করে? পুরুষের পাশাপাশি সামাজিক সকল কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে? নারীদের সামর্থ্য, প্রতিভা, সাহসিকতা ও জ্ঞানকে অস্বীকার করে? আসুন এবার আমরা যাই ধর্মের দিকে। আমরা বর্তমানে ধর্মের যে চিত্রটা দেখতে পাচ্ছি, এটা কিন্তু ধর্মের আসল চেহারা নয়। এই মুসলিমদের মধ্যে এখন লক্ষাধিক ভাগ। কোন ভাগটি সঠিক? কোনটি ইসলামের আসল চেহারা?
আজ থেকে ১৪ শ’ বছর আগে আরবে সেই অজ্ঞতার যুগে বহু মেয়ে শিশুকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। আর যারা দেখতে শুনতে একটু ভালো ছিল তাদেরকে ঐ সমাজে নর্তকী হিসাবে ব্যবহার করা হতো। তারা স্বীকারই করত না যে মেয়েদেরও প্রতিভা আছে জ্ঞান-বুদ্ধি আছে, সর্বক্ষেত্রে সক্রিয় হয়ে অবদান রাখার যোগ্যতা আছে।
মানবসমাজের এই দুরবস্থা থেকে আখেরী নবী হুজুরে করিম (দ.) ভাবতে লাগলে কীভাবে মানুষের মুক্তি সম্ভব। আল্লাহ তাঁকে যথাসময়ে পথ দেখালেন। আল্লাহ বললেন মানুষকে তওহীদের উপর- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (এক আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম মানি না) এই কথার উপর মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে। এই কথার উপর ধীরে ধীরে আরবের মানুষগুলো ঐক্যবদ্ধ হলো। ধীরে ধীরে সমাজের প্রাচীন সব মূল্যবোধ পাল্টে যেতে লাগলো। নারীরা ভোগ্যপণ্য থেকে আবার মানুষ হিসাবে বিবেচিত হতে লাগলো।
আমরা যারা ইসলাম ধর্মবিশ্বাসী, আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, একজন নারী যদি ধর্ষিতা হয় আমাদের ঘরের পর্দানশিন নারীর পর্দার কোনো মূল্য থাকে না। আজ যে অচেনা নারী ধর্ষিতা হয়েছে, সেও কারো আপনজন। আমি যদি তার ধর্ষিতা হওয়ার সংবাদে নির্বিকার থাকি তো কাল আমার আপন কোনো নারীও ধর্ষিতা হবে। তখন অন্যরা নির্বিকার থাকবে। ক্ষুধার জ্বালায় বা পরিস্থিতিতে পড়ে এই সমাজের একজন নারীও যদি ইজ্জত বিক্রি করতে বাধ্য হয় সেখানে আমি ঘরে বসে বসে জিকির করলে কোনো সওয়াব হবে না। এটা স্বার্থপরতা, এটা আত্মকেন্দ্রিকতা, এটা আল্লাহর এবাদত না। এটা যদি আল্লাহর এবাদত হতো তাহলে রসুলাল্লাহও হেরাগুহায় বসে জিকির করে, নামাজ-রোজা করে জিন্দেগি পার করে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তাঁর সমগ্র নব্যুয়তি জীবন অতিবাহিত করেছেন মানবসমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে। তিনি স্বীয় কাজের দ্বারা শিক্ষা দিয়ে গেছেন মানবজাতিকে যে, যখন মানবতা ভূ-লুণ্ঠিত তখন মানবাধিকার সমুন্নত করাই আসল এবাদত। একটি নির্যাতিতা নারীর চিঠি পেয়ে সিন্ধুবিজয় করেছিলেন কিশোর সেনাপতি মোহাম্মদ বিন কাসেম। সকল ধর্মেরই এই এক উদ্দেশ্য। কিন্তু ধর্মগুলোর সেই আসল চেহারা, মূল উদ্দেশ্য আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। আমাদের কাজ হবে সেই আসল রূপটিকেই আবার মানুষের সামনে তুলে ধরা, যেন ধর্মের নাম করে আর কেউ কোনো স্বার্থসিদ্ধি করতে না পারে, অন্যায়ভাবে কাউকে অবদমিত করে রাখতে না পারে। এই কাজে নারী ও পুরুষ উভয়কেই সমান ভূমিকা রাখতে হবে।
ইসলামের মূলবাণী “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”- এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ ছাড়া আর কারো হুকুম মানবো না। কোন মওলানা, কোন পীর, কোন আল্লামা কী বললেন সেটা আমরা দেখবো না, বরং দেখব আল্লাহ কী বলেছেন আর রসুলাল্লাহ কী করেছেন। তিনি ইসলামগ্রহণকারী নারীদেরকে তাঁর উম্মাহর মধ্যে কী মর্যাদা দিলেন, কী কাজে নিয়োজিত করলেন সেটাই আমাদেরকে বিবেচনা করতে হবে। প্রথমে তিনি জাহেলি যুগের অশ্লীল কর্মকাণ্ড থেকে নারীদেরকে মুক্ত করে তাদেরকে শালীনতা শিক্ষা দিলেন। ভোগের সামগ্রী নারী সমাজে তখন সম্মানিতা হলো, শ্রদ্ধার পাত্রী হলো। শালীনতা শিখিয়ে কিন্তু তিনি তাদেরকে ঘরের মধ্যে বসিয়ে রাখেন নি, তাদেরকে বলেন নি যে, পরপুরুষ তোমাকে দেখলে তুমি জাহান্নামে যাবে। বরং তিনি তাদেরকে গৃহকোণ থেকে বের করে আনলেন। তাদেরকে একটি বিরাট ও মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ঐক্যবদ্ধ করলেন। তাদেরকে পরচর্চা, পরশ্রীকাতরতা, নীচুতা, হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে ঐক্যবদ্ধ থাকার গুণাবলী শিক্ষা দিলেন, তাদেরকে যুদ্ধ করতে শেখালেন, তলোয়ার চালনা, বল্লম চালনা, ঘোড়া ছোটানো শেখালেন। নারী প্রগতির এক বিস্ময়কর অধ্যায় তিনি রচনা করলেন। সেই আইয়ামে জাহেলিয়াতের অবজ্ঞাত অবহেলিত উপেক্ষিত অত্যাচারিত নারীরা যেন একটা ঝড়ের সৃষ্টি করে দিল। তারা চিন্তার ক্ষুদ্রতা ও দৈন্য থেকে মুক্ত হলো, পরচর্চা ভুলে তারা ছুটলো জেহাদের ময়দানে। যুদ্ধের মাঠে তারা শত্রুপক্ষের বাহিনীর মধ্যে তাণ্ডব ঘটিয়ে দিলেন। পুরুষরা যেখানে কুলিয়ে উঠতে পারেন নি, সেখানে পর্যন্ত মেয়েরা অসম সাহসিকতার সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনলেন। এমন কি তারা রসুলকে পর্যন্ত বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন। ওহুদের মাঠে রসুল যখন কাফেরদের তীরে জর্জরিত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, অনেক সাহাবী যখন শহীদ হয়ে যান তখন উম্মে আম্মারা তলোয়ার হাতে এমনভাবে রসুলের চারপাশে লড়াই চালিয়েছেন যে, রসুল বলেছেন সেদিন যেদিকেই তাকাই শুধু উম্মে আম্মরাকেই দেখেছি। ডানে উম্মে আম্মারা- বামে উম্মে আম্মারা।
খাওলা বিনতে আজওয়ার দুর্ধর্ষ রোমান সৈন্যদেরকে পরাজিত করে আপন ভাইকে মুক্ত করে নিয়ে এসেছেন। সেই নারীদেরকে রসুল বাজার ব্যবস্থাপনার কাজে লাগিয়ে দিলেন। তলোয়ার নিয়ে মেয়েরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে দেখতো কেউ দ্রব্যে ভেজাল দেয় কিনা। হাসপাতালের সব কাজে মেয়েরা। তারা আহতদেরকে চিকিৎসা করত। সেবা করত, শহীদদের দাফন করতেন। হাসপাতালের প্রধানও ছিলেন একজন মেয়ে। জুম্মার নামাজে মেয়েরা অংশ গ্রহণ করত। রাত্রে বেলার নামাজেও তারা মসজিদে যেত। এভাবে জীবনের প্রত্যেকটা কাজে মেয়েদের অংশগ্রহণ আল্লাহর রসুল নিশ্চিত করলেন। তিনি যখন নিজ বাড়িতে বা মসজিদে বসে আলোচনা করতেন তখন তাঁর ও নারীদের মধ্যে কোনো পর্দা টাঙানো থাকতো না। তারা সামনা সামনি বসে বসে আলোচনা শুনতেন। প্রয়োজনীয় প্রশ্ন করে নিতেন।
সেই ইসলাম আজ এমন হলো কীভাবে? মেয়েরা নামাজে যেতে পারবে না, সেনাবাহিনীতে যাবে না, তারা পর্দার আড়ালে থাকবে। এই মতকে প্রতিষ্ঠার জন্য বর্তমানে অসংখ্য জাল হাদিস, কেচ্ছাকাহিনী চালু করা হয়েছে। সেগুলো বেশি বেশি ওয়াজ মাহফিল করে, তালিম করে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এভাবে নারী ও পুরুষের সম্মিলিতভাবে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করার সকল পথই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কেউ তাদেরকে প্রশ্ন করছে না যে, তাহলে রসুল কী করে মেয়েদের নিয়ে আলোচনা সভা করলেন, তাদেরকে যুদ্ধে নিয়ে গেলেন আর কী করেই বা এক জামাতে নামাজ পড়ালেন। রসুলাল্লাহর স্ত্রী আম্মা আয়েশা দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিলেন। তিনি উটের যুদ্ধে দশ হাজার সৈন্যকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কেউ কি তখন বলেছে যে নারী নেতৃত্ব হারাম? নারীদের এই সব কীর্তির কথা ইতিহাসে নেই। এজন্যই কথাই নজরুল লিখে গেছেন, কত মাথা দিল হৃদয় উপাড়ি কত বোন দিল সেবা/বীরের স্মৃতিস্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
আজকে ধর্মব্যবসায়ীরা নারীদের বাক্সবন্দী করেছে। অন্যদিকে পশ্চিমা সভ্যতা নারীদের অশ্লীলতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। উভয়টাই হচ্ছে বাড়াবাড়ি। এই বাড়াবাড়িকে মিটিয়ে দিয়ে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনাই হচ্ছে উম্মতে মোহাম্মদীর লক্ষ্য।