হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম
রসুলাল্লাহর বিদায়ের পর সেই সাম্যের প্রকৃত ইসলাম, সেই ঐক্যের ইসলাম, সেই প্রগতির ইসলাম, সেই মুক্তির ইসলাম ধীরে ধীরে আমরা হারিয়েছি। কীভাবে হারিয়েছি সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। সেটা আমাদের বই পত্রে লিখেছি। কথা হচ্ছে এখন কী করণীয়? এই তেরো শ বছরে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে করতে করতে এই উম্মাহর ভারসাম্য নষ্ট করা হয়েছে। প্রতিটা ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করেছে। যেমন মেয়েদের সম্পর্কে। সিরাতুল মুস্তাকীম মানে সহজ-সরল, ভারসাম্যযুক্ত, Straight, Balanced । কোর’আনে আল্লাহ মো’মেনদেরকে উম্মতে ওয়াসাতা বা ভারসাম্যপূর্ণ জাতি বলে আখ্যায়িত করেছেন। এদিকেও না, ওইদিকেও না, বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করা হয়েছে। খাও – কিন্তু পরিমিতভাবে। আল্লাহর রসুল বলেছেন, পেটকে তিন ভাগের এক ভাগ কর, এক ভাগ খাও, এক ভাগে পানি খাও, এক ভাগ খালি রাখ। তাহলে তুমি সুস্থ থাকবে। শুকর খেয়ো না, রক্ত খেয়ো না। আল্লাহর নামে জবাই হয় নাই, এইগুলি খেয়ো না। তবে উপায় না থাকলে খেতে পারো, তবে বাড়াবাড়ি করো না। বাড়াবাড়ি না করলে আল্লাহ ক্ষমাশীল। পোশাক পড়তে বলেছেন, বাড়াবাড়ি করতে না করা হয়েছে। প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে কুর’আনের ‘লা ইকরা হা ফিদ্দীন।’ ‘দীন নিয়ে জবরদস্তি করো না, বাড়াবাড়ি করো না’ এই নীতি আল্লাহর রসুল অনুসরণ করেছেন। আমাদের এই তেরো শ বছরে অতিবিশ্লেষণ আর বাড়াবাড়ি করে এই একদল অতি প-িত ইসলামের ভারসাম্য নষ্ট করেছে।
নারী-পুরুষকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। একজন আরেক জনের পরিপূরক। মা হাওয়া-বাবা আদম। আল্লাহ নিজ হাতে বাবা আদমকে বানালেন। নিজের রুহ ফুঁকে দিলেন। বাবা আদম থেকে মাকে বানালেন। মমতাময়ী মা, করুণাময়ী মা। মা আদর দিয়ে, যত্ন দিয়ে, মমতা দিয়ে বাবার সংসারকে আগলে রাখবেন, প্রশান্তিময় করবেন। বাবা-মা, বাবা কষ্ট করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করবেন, পরিবারকে তিনি খাওয়াবেন, পরিচালিত করবেন। এই বাবা-মা, নারী-পুরুষ, দুইজনের সমন্বয়ে পরিবার। এমন বহু পরিবারের সমন্বয়ে সমাজ। বহু সমাজের সমন্বয়ে রাষ্ট্র। গোড়ায় গেলে সেই দুই জনের, নারী ও পুরুষের সমন্বয়ে রাষ্ট্র। আইয়্যামে জাহেলিয়াতের নারীরা ছিল অসম্মানিত। মেয়ে শিশুদেরকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। তাদেরকে ব্যভিচারে লিপ্ত করা হতো, উলঙ্গ হয়ে নৃত্য করানো হতো। এই নারীদের ইজ্জত রসুলাল্লাহ পুনরুদ্ধার করলেন। তাদেরকে শালীন পোশাক পরিয়ে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এমন কি রণাঙ্গণেও নিয়ে গেলেন। নারী সর্বত্র তার ন্যায্য অধিকার বুঝে পেল। সেই সমাজের মানুষগুলো মদ খেয়ে চুর হয়ে পড়ে থাকত। রসুলুল্লাহ সমাজ থেকে মাদকাসক্তি দূর করলেন। তারা পরস্পরে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় লিপ্ত থাকত। তারা খুনাখুনি করত। তাদের পেটে ভাত ছিল না। গায়ে পোশাক ছিল না। অশ্লীলতায় ভরা ছিল তাদের কাব্য। একদিকে রোমান, আরেকদিকে পারস্য। জ্ঞান-বিজ্ঞানে এই আরবজাতি ছিল উপেক্ষিত, অবজ্ঞাত, শিক্ষাহীন, দীক্ষাহীন। আল্লাহর রসুল তাদেরকে তওহীদের উপরে আগে ঐক্যবদ্ধ করলেন। আগে ভাই বানালেন। সেটা কীভাবে? আপনারা বলুন তো, একশ’টা তসবির দানানে একত্র রাখে কীসে? একটি সুতা। এটাই হলো ঐক্যসূত্র। সুতা কেটে দিলে দানাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। আল্লাহ রসুল আগে ওই আরবের, দাঙ্গা-হাঙ্গামায় লিপ্ত, পারস্পরিক শত্রুতায় নিমজ্জিত ঐ সমাজের মানুষগুলোকে, স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক মানুষগুলোকে তওহীদের সুতার মধ্যে আগে ঐক্যবদ্ধ করলেন। তারা এতদিন ইবলিসের দাসত্ব করত, রসুল তাদেরকে আল্লাহর দাসত্বের মধ্যে আনলেন। ফলে সমাজের মানুষগুলো ভাই হয়ে গেল। ফলটা কী হল – সমাজ পাল্টে গেল। মানুষগুলিও পাল্টে গেল। সেই মানুষগুলির নামের শেষে আমরা এখন বলি ‘রাদিয়াল্লাহু আনহু ওয়ারাদু আনহুম।’ আবু বকর (রা.), ওমর (রা.), ওসমান (রা.)। আল্লাহ অশ্লীলতা পছন্দ করে না। তিনি নারীদেরকে শালীন পোশাক পরিয়ে কি তাদেরকে বাক্সবন্দী করেছিলেন? তিনি কি এই ফতোয়াবাজি করেছেন, এই মেয়েরা ঘর থেকে বের হয়ো না, তোমাদেরকে পরপুরুষ দেখলে ঈমান চলে যাবে? বললে তিনি কী করে মেয়েদেরকে সমাজের সর্বত্র বিচরণ করার অধিকার দিলেন? পরে বহু জাল হাদিস আর সেখান থেকে তৈরি ফতোয়ার জাল বিস্তার করে নারীদেরকে বাক্সবন্দী করা হয়েছে যেটা আমার রসুলের সমগ্র কর্মজীবনের নীতির পরিপন্থী। আমার রসুল মেয়েদেরকে ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে তিনি যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে গেলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেল মেয়েরা, বাজার ব্যবস্থাপনায় মেয়েরা, হাসপাতাল পরিচালনায় মেয়েরা, জাতীয়, আন্তর্জাতিক, সামরিক সকল কাজে নারীরা। নারী স্বাধীনতার নিদর্শন স্থাপিত হলো। পৃথিবী দেখল নারী স্বাধীনতা কাকে বলে!
আজকে লক্ষ লক্ষ নারী বেইজ্জত হচ্ছে, নিজেদের ইজ্জত রক্ষা করতে পারছে না, মাটি রক্ষা করতে পারছে না। কিন্তু উম্মতে মোহাম্মদী নারীরা নিজেকে রক্ষা করেছেন। রসুলকে পর্যন্ত রক্ষা করেছেন। ওহুদের ময়দানে সাহাবীরা যখন ব্যাপক আক্রমণের মুখে পিছপা হলেন, সেই কঠিন মূহূর্তে নারীরা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। আমার রসুল বলছেন, ডানে উম্মে আম্মারা, বামে উম্মে আম্মারা, সামনে উম্মে আম্মারা, পিছনে উম্মে আম্মারা। সেই নারীরা জীবনের বাজি রেখে আমার রসুলকে হেফাজত করলেন, মদীনার মাটিকে হেফাজত করলেন, পুরো জাতিকে রক্ষা করলেন। আজ শত শত বছর ধরে আমার লক্ষ লক্ষ নারী বেইজ্জত হচ্ছে। তারা নিজেদেরকেও রক্ষা করতে পারছে না। হে নারীরা, আপনারা উম্মতে মোহাম্মদীর নারী হন। আমি আপনাদেরকে বলতে চাই, কারও ওয়াজের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আল্লাহর রসুল কী করেছেন সেদিকে তাকান। না হলে আপনার ঈমান হাইজ্যাক করা হবে। আর যদি উম্মতে মোহাম্মদীর সেই নারী হতে পারেন জাতি বাঁচবে, ইজ্জত বাঁচবে, আপনারা বাঁচবেন।
আল্লাহর রসুল জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে চলে গেলেন আল্লাহর কাছে। যাওয়ার সময় কি তিনি বলে যান নি যে, তোমরা ঐক্য নষ্ট করবে না? আমরা কিন্তু ঐক্য নষ্ট করেছি, পথভ্রষ্ট হয়েছি। শিয়া হয়েছি, সুন্নী হয়েছি, শাফেয়ী হয়েছি, হাম্বলী হয়েছি। আমাদের সুলতানরা ভোগ-বিলাসে মত্ত হলেন। এদিকে কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটল। রসুলুল্লাহর কলিজার টুকরা হোসাইনকে হত্যা করা হল। সেই থেকে শুরু হল নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ। ঐক্য ধ্বংস হয়ে আমরা দুর্বল হয়ে পড়লাম। এরপরে আমরা ব্রিটিশের গোলাম হলাম। ব্রিটিশরা আমাদের শোষণ করেছে তিনশো’ বছর। আল্লাহর হুকুম বাদ দিয়ে তাদের হুকুম চালু করে দিয়েছে। আজকে আমাদের সমাজে এই যে রাজনীতি, স্বার্থের রাজনীতি, হানাহানির রাজনীতি- এটা আল্লাহর রসুল শিখায় নাই, ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদীদের রেখে যাওয়া সংস্কৃতি এটা। আজকে সিরিয়া গণকবর হয়েছে এ রাজনীতির ফলে। সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো জোট করেছে। বিরোধী দলকে অস্ত্র দিয়েছে আমেরিকা, ব্রিটেন। এরপর আসাদ সরকার বেদিশা হয়ে রাশিয়াকে আহ্বান করেছে। এইবার রাশিয়া সরকারকে দিয়েছে অস্ত্র। বিনামূল্যে দেয় নি, চড়ামূল্যে নিয়েছে, খনিজসম্পদ চুক্তির মাধ্যমে নিয়েছে। তারা পক্ষ নিয়েছে সরকারের আর আমেরিকা-ব্রিটেন পক্ষ নিয়েছে বিরোধী দলের। আজকে সিরিয়া কার – আসাদ সরকারের? মুসলমানের? সিরিয়ানদের? কারোই না। সেই মাটি আমেরিকা-রাশিয়ার যুদ্ধের লীলাভূমি। সুতরাং এ হচ্ছে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার শেষ পরিণতি। আমরাও সেই রাজনৈতিক দাঙ্গার মধ্যেই বিগত ৪৭ বছর পার করলাম। এ লক্ষণ ভালো নয়। একদল ক্ষমতায় যাওয়ার পরের দিন থেকে শুরু করে দেয় ষড়যন্ত্র, হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও, খুন-রাহাজানি। কোন কিছু করতেই বাদ রাখে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাঁচার কোনো উপায় নেই আমাদের। আমাদের দুনিয়াও শেষ, আখিরাতও শেষ। আমি আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, আমি সাধারণ গোনাহ্গার মানুষ। আসুন, আজকে ঐক্যবদ্ধ হোন আল্লাহর রসুলের প্রকৃত ইসলামে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মোহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ।’ এ কথার ভিত্তিতে সবাই ঐক্যবদ্ধ হন। কোনো দল নই, মত নই, পথ নই আমরা সবাই এক আল্লাহর প্রতিনিধি। আমাদের সবার ভিতরে আল্লাহর রুহ্ রয়েছে। আমরা সবাই ভাই ভাই। আমরা সবাই তাঁর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানতে পারি না।
[১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখ সোমবার ঢাকার উত্তর বাড্ডায় অনুষ্ঠিত একটি আলোচনা সভায় হেযবুত তওহীদের এমাম জনাব হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম কর্তৃক প্রদত্ত ভাষণের খ-াংশ। সম্পাদনায় মো. রিয়াদুল হাসান। বক্তব্যের পরবর্তী অংশ দেখুন আগামীকাল।]