হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

কোরবানি কখন কবুল হবে?

[লেখক: শিক্ষাবিদ। যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৭১১৫৭১৫৮১

When will the sacrifice be accepted?

আরবি  ‘র্কুব’ শব্দ থেকে ‘কোরবান’ শব্দটি এসেছে যার অর্থ- নিকটবর্তী হওয়া, কাছে যাওয়া, সান্নিধ্য অর্জন করা, নৈকট্য লাভ করা, উৎসর্গ করা, বিশেষ ঘনিষ্ঠ হওয়া, খুব প্রিয় হওয়া, ভালোবাসার পাত্র হওয়া ইত্যাদি। নিজের প্রিয় কোনো জিনিসকে স্বেচ্ছায় আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্যের প্রত্যাশায় আল্লাহর রাহে বিলিয়ে দেওয়াই কোরবানি। যে বা যারা এই কোরবানি করবে তারা হবে ‘মোকাররাবুন’। আল্লাহর একান্ত প্রিয়, ঘনিষ্ঠতম কিছু সংখ্যক বান্দাকে তিনি পবিত্র কোর’আনে উল্লেখ করেছেন ‘মোর্কারাবুন’ বলে (ওয়াকেয়া- ১১)। এই কোরবানি হতে পারে পার্থিব কোনো সম্পদ বা নিজের অমূল্য জীবন অথবা অন্য যে কোনো প্রিয় কিছু। আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের জীবন ও সম্পদ কোরবানি করা, বিলিয়ে দেওয়া মো’মেন হবার পূর্বশর্ত। (সুরা হুজুরাত- ১৫)। মহান আল্লাহ সুরা তওবার ১১১ নাম্বার আয়াতে বলেছেন, “আমি মো’মেনদের জীবন ও সম্পদ কিনে নিয়েছি জান্নাতের বিনিময়ে।” এই আয়াত থেকেও বোঝা যায় ঈমান আনার পর জান্নাতে যাবার শর্ত হলো আল্লাহর রাস্তায় জীবন ও সম্পদ কোরবানি করা। এই কোরবানি করবার বিশেষ কোনো সময় নেই। জীবনের প্রতিটা ক্ষণেই আমরা যেন নিজেদের সম্পদ ও কর্ম দিয়ে দীনের খেদমত করতে পারি সেই প্রচেষ্টাই আমাদের করা উচিত। কিন্তু জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে সামর্থ্যবান ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় যে পশু জবাই করে তাকেই আমরা কোরবানি বলে জানি।

কোরবানির ইতিহাস:
কেবল শেষ ইসলাম নয়, পূর্বের সব ঐশ্বরিক ধর্মেই আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় পশু কোরবানি করার হুকুম ছিল। আল্লাহ বলেন, “আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানির নিয়ম দিয়েছি। তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণস্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলির উপর যেন তাহারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ, সুতরাং তাহারই নিকট আত্মসমর্পণ করো এবং সুসংবাদ দাও বিনীতগণকে (সুরা হজ- ৩৪)।” এই আয়াত থেকে এটা সুস্পষ্ট হয় যে, অতীতের সকল দীনে আল্লাহ পশু কোরবানি করার নিয়ম বেঁধে দিয়েছিলেন। এছাড়াও আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে বলেছেন, “আদমের দুই পুত্রের বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথভাবে শোনাও। যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল তখন একজনের কোরবানি কবুল হল এবং অন্যজনের কবুল হল না। সে বলল, ‘আমি তোমাকে হত্যা করবই।’ অপরজন বলল, ‘আল্লাহ তো একমাত্র মুত্তাকীদের কোরবানি কবুল করেন।’ (সুরা মায়েদা- ২৭)।” ইবনে কাসির বর্ণনা করেছেন যে, “হাবিল একটি ভেড়া এবং তার ভাই কাবিল তার ফসলের কিছু অংশ স্রষ্টার উদ্দেশ্যে নিবেদন করে। আল্লাহর নির্ধারিত পদ্ধতি ছিল যে আগুন আকাশ থেকে নেমে আসবে এবং গ্রহণযোগ্য কোরবানি গ্রহণ করবে। তদনুসারে, আগুন নেমে আসে এবং হাবিলের জবেহকৃত পশুটির কোরবানি গ্রহণ করে। অন্যদিকে কাবিলের ফসল কোরবানি প্রত্যাখ্যাত হয়। কাবিল এই ঘটনায় ঈর্ষাণি¦ত হয় ও সামাজিকভাবে অপমানবোধ করে, এর ফলে তার ভাই হাবিলকে সে হত্যা করে, যা মানব ইতিহাসের প্রথম হত্যাকাণ্ড হিসেবে পরিগণিত। কাবিল তার কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হওয়ায় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেননি।” এই ঘটনা থেকে আমরা জানতে পারলাম যে, পশু কোরবানির এই রীতি আমাদের আদি পিতা আদম (আ.) এর দীনেও প্রচলিত ছিল। আমরা সনাতন ধর্মসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বহু ধর্মে পশু বলি দেবার একটা রীতি দেখি। জাহেলিয়াতের যুগে মক্কার লোকেরা যে পৌত্তলিকতার ধর্ম অনুসরণ করত সেখানেও পশু কোরবানির প্রচলন ছিল। কেননা সেটা ছিল ইব্রাহীম ও ইসমাইল (আ.) এর ধর্মেরই বিকৃত রূপ। রসুলাল্লাহও (সা.) পশু কোরবানির এই আমলকে হযরত ইবরাহিম (আ.) এর সুন্নাহ হিসাবে পালন করেছেন। যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)! এ কোরবানি কী? মহানবী (সা.) এরশাদ করলেন, তোমাদের পিতা হযরত ইবরাহিমের (আ.) সুন্নত (সহিহ আবু দাউদ)। সুতরাং কোরবানির ইতিহাসে ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.) এর ঘটনাটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং শিক্ষণীয়। কাজেই এই ঘটনাটি আমাদের উপলব্ধি করতে হবে।

মহান আল্লাহ বলেন, “অতঃপর সে (ইসমাইল) যখন তাহার পিতার সঙ্গে কাজ করার মতো বয়সে উপনীত হল তখন ইবরাহিম বলল, ‘বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি যবেহ করছি, এখন তোমার অভিমত কী?’ সে বলল, ‘হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তা পালন করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।’ যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইবরাহিম তার পুত্রকে কাত করে শায়িত করল, তখন আমি তাকে আহ্বান করে বললাম, ‘হে ইবরাহিম! ‘তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করলে!- এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয় ইহা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাহাকে মুক্ত করলাম এক কোরবানির (দুম্বা) বিনিময়ে। আমি ইহা পরবর্তীদের স্মরণে রেখেছি।” (সুরা সাফ্ফাত: ১০২-১০৮)।

মানব ইতিহাসে এমন নিদর্শন আর দ্বিতীয়টি নেই যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের প্রিয় পুত্রকে নিজ হাতে কোরবানি করার চেষ্টা এবং পুত্রও কোনো রকম আপত্তি না করে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ধৈর্য ধারণ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া। এই শ্রেষ্ঠ কোরবানির জন্য তাঁর উপাধী হয়েছে ইবরাহিম খলিলুল্লাহ (আল্লাহর বন্ধু) আর ইসমাইল যাবিউল্লাহ (আল্লাহর রাস্তায় যবেহ হয়েছেন যিনি)। আর পুরস্কার স্বরূপ মহান আল্লাহ তাঁদের বংশধারাতেই পাঠিয়েছেন মানবজাতির মুকুটমণি, সকল নবী-রসুলদের সরদার, সমগ্র মানবজাতির শিক্ষক, সমগ্র জগতের জন্য রহমত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মোহাম্মাদুর রসুলাল্লাহ (সা.)-কে এবং ইবরাহিমকে (আ.) করেছেন মুসলিম মিল্লাতের পিতা। কোরবানির এই অসাধারণ নিদর্শন যেন মানবজাতি স্মরণে রাখে ও নিজের জীবন-সম্পদ, স্ত্রী-পুত্র-পরিজন আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করে- এজন্যই মহান আল্লাহ পশু কোরবানিসহ ইবরাহিম (আ.) জীবনের অনেক ঘটনাকেই পবিত্র হজের অনুষ্ঠানে রূপকভাবে স্মরণ করানোর জন্য হজের আনুষ্ঠানিকতা হিসাবে ঠিক করে দিয়েছেন।

কোরবানির ঈদে পশু জবাই:
হজ ইসলামের অন্যতম একটি ফরজ বিধান । এই হজের একটি অংশ হলো পশু কোরবানি করা। আল্লাহ বলেন, “এই সমস্ত আন‘আমে (চতুষ্পদ জন্তু) তোমাদের জন্য নানাবিধ উপকার রহিয়াছে এক নির্দিষ্ট কালের জন্য; অতঃপর উহাদের কোরবানির স্থান প্রাচীন গৃহের নিকট (সুরা হজ- ৩৩)”। মূলত হাজীদের মধ্যে সকল সমর্থ্য ব্যক্তির জন্য পশু কোরবানি বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু রসুলাল্লাহ (সা.) ও খুলাফায়ে রাশেদার যুগে যারা হজ করতে যেতে পারত না তাদের অনেকে হাজীদের সাথে সংহতি প্রকাশ করার জন্য, ঐকমত্য প্রকাশ করার জন্য সামর্থ্য অনুসারে নিজ স্থানেই পশু কোরবানি করে দরিদ্র ও আত্মীয়বর্গের মাঝে গোস্ত বিতরণ করতেন। আমরা যে পশু কোরবানি দেই সেটার প্রচলন মূলত এখান থেকেই। রসুলাল্লাহ (সা.) নিজেও হজে না গেলেও পশু কোরবানি করতেন।

কোরবানি হোক অর্থবহ:
আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে কোরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য ঠিক করে দিয়ে বলেছেন, “বল, আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে (আন’আম- ১৬২)”। ভোগ আত্মাকে কলুষিত করে। কোরবানির শিক্ষাই হলো ত্যাগের মাধ্যমে নিজেকে, আত্মাকে পবিত্র করা। মানুষের জীবনে ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর যেকোনো কিছু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করা  হলো কোরবানি। আমরা যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চাই তাহলে পৃথিবী থেকে যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ-রক্তপাত এক কথায় যাবতীয় অশান্তি দূর করে ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করতে হবে, এই সংগ্রামে নিজেদের জীবন ও সম্পদ কোরবানি করতে হবে। এই কাজটিই করে গেছেন নবী-রসুলগণ এবং মো’মেন মোজাহেদগণ। এই একই কাজ করার জন্য ইবরাহিম (আ) কে আগুনের লেলিহান শিখায় নিক্ষেপ করা  হয়েছিল, বহু নবীকে হত্যা করা  হয়েছে, কোনো নবীকে করাত দিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত চিরে ফেলা হয়েছে, কোনো নবীর উম্মতকে ফুটন্ত তেলের কড়াইতে ফেলে দেওয়া  হয়েছে। যুগে যুগে ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছে হাজারো মো’মেনের জীবন, যারা বেঁচে আছেন সত্যনিষ্ঠ মানুষদের হৃদয়ের মণিকোঠায়। কিন্তু বর্তমানে কোরবানির প্রকৃত আকিদা বিকৃত হয়ে যাওয়ার কারণে আমরা বুঝতে অক্ষম যে, কোনটি আল্লাহর পথে প্রকৃত কোরবানি আর কোনটি কেবল পশু জবেহ। কোরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে বর্তমানে ধার্মিকগণ পুরোপুরিভাবে বেখেয়াল। প্রত্যেক কাজেরই লক্ষ্য থাকতে হবে সঠিক। উদ্দেশ্যবিহীন কোনো কিছুরই কোনো মূল্য থাকে না।

আমাদের বুঝতে হবে যে, পশু কোরবানির এই প্রথা মূলত আমাদের এক মহান শিক্ষা দেবার জন্যই দেওয়া হয়েছে। আমরা যেন এর মাধ্যমে ইবরাহিম (আ.) এর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জীবন-সম্পদ কোরবানি করার প্রেরণা লাভ করতে পারি। আল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহ তো একমাত্র মুত্তাকীদের কোরবানি কবুল করেন।’ (সুরা মায়েদা- ২৭)। অর্থাৎ যারা লোক দেখানোর জন্য, শুনাম অর্জন করার জন্য বা উদরপূর্তি করার জন্য পশু জবাই দেবে তাদের কোরবানি আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না।

কোরবানি কবুল হবে মোমেনদের যারা মোখলেছ, যারা সহি নিয়তে আল্লাহ এবং তাঁর রসুলের (সা.) প্রতি ঈমান আনবে দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করবে। যাদের সংগ্রামের উদ্দেশ্য হবে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, মানবতার কল্যাণ। যাদের দুনিয়াবী কেনো স্বার্থ থাকবে না। এমন মোমেন, মোখলেছ, সত্যনিষ্ঠ বান্দার জন্যই কোরবানি এবং তাদের কোরবানি কবুল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

মহান আল্লাহ আরও বলেন, “এবং উষ্ট্রকে করিয়াছি আল্লহার নিদর্শনগুলির অন্যতম; তোমাদের জন্য উহাতে কল্যাণ রহিয়াছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান অবস্থায় উহাদের উপর তোমরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো। যখন উহারা কাত হইয়া পড়িয়া যায় তখন তোমরা উহা হইতে আহার করো এবং আহার করাও ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকে (যে অভাবীরা গোস্ত চাইতে আসে না)  ও যাচ্ঞাকারী অভাবগ্রস্তকে (যে অভাবীরা গোস্ত চাইতে আসে); এইভাবে আমি উহাদেরকে তোমাদের অধীন করিয়া দিয়াছি যাহাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। কখনোই আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না উহাদের গোস্ত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এইভাবে তিনি উহাদেরকে তোমাদের অধীন করিয়া দিয়াছে যাহাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো এই জন্য যে, তিনি তোমাদেরকে পথপ্রদর্শন করিয়াছেন; সুতরাং তুমি সুসংবাদ দাও সৎকর্মপরায়ণদেরকে। (সুরা হজ- ৩৬-৩৭)।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...