হেযবুত তওহীদ বাংলাদেশের একটি অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংস্কারমূলক আন্দোলন। এ আন্দোলনটি যিনি প্রতিষ্ঠা করেন মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী, তিনি অত্যন্ত অভিজাত একটি পরিবারের সন্তান। সুলতানি যুগে তাঁর পূর্বপুরুষরা বাংলা সালতানাতের সুলতান, মুঘল যুগে ছিলেন আতিয়া পরগনার সুবেদার আর ব্রিটিশ যুগে ছিলেন করটিয়ার জমিদার। বাংলাদেশের মুসলিম নব-জাগরণ, রাজনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসারে তাঁর পূর্ব-পুরুষদের ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। তিনি সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে, মানবতার কল্যাণে দেশপ্রেম ও ঈমানী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৯৫ সালে এই আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেন। আন্দোলন প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি তাঁর সমস্ত সম্পদ এই কাজে ব্যয় করে যান। এ আন্দোলনের সদস্যরাও নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে আন্দোলনের ব্যয়ভার বহন করেন। যারা আন্দোলনের সদস্য নয়, তাদের থেকে কোনো দান বা অনুদান গ্রহণ করা হয় না।
হেযবুত তওহীদের মূল বক্তব্য হচ্ছে- সমগ্র মানবজাতি প্রকৃতপক্ষে এক পরিবার, এক বাবা-মা আদম হাওয়ার সন্তান। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের ভাষ্যমতেও মানবজাতি এক পিতামাতা থেকে আগত। যেমন: সনাতন ধর্মগ্রন্থে এই আদি পিতামাতাকে বলা হয়েছে মনু ও শতরূপা, বাইবেলে বলা হয়েছে অ্যাডাম ও ইভ, ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে আদম ও হাওয়া। এই এক জোড়া দম্পতি, একটি পরিবার থেকেই পুরো মানবজাতির সৃষ্টি। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে আমরা সবাই আদিতে গিয়ে এক। সৃষ্টিগত ও প্রকৃতিগতভাবে আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। তেমনি সব ধর্মমতেও আমাদের স্রষ্টা একজন যদিও তাঁকে আমরা একেক ধর্মে একেক নামে আহ্বান করি। কেউ বলে আল্লাহ, কেউ ঈশ্বর, কেউ ভগবান, কেউ গড, কেউ জিহোভা, কেউ এলি। আমাদের মধ্যে সাদা-কালো, লম্বা-খাটো, আরবীয়, চীনা, বাঙালি, ভারতীয় ইত্যাদি নানা জাতিগত, ভাষাগত, ধর্মগত পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু এগুলো আমাদের মূল পরিচয় নয়। মূল পরিচয় আমরা সবাই মানুষ, আমরা এক জাতি, একই স্রষ্টার সৃষ্টি, একই পিতামাতা আদম হাওয়ার সন্তান। মানবজাতির মধ্যে এই চেতনার সঞ্চার করতে, তাদের অর্ন্তনিহিত পরিচয়কে উদ্ভাসিত করতে এবং তাদের মধ্যে ঐক্য চেতনা সৃষ্টি করার জন্য “সকল ধর্মের মর্মকথা-সবার ঊর্ধ্বে মানবতা” এই শ্লোগান নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে অরাজনৈতিক আন্দোলন হেযবুত তওহীদ।
শুধু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নয়, যাবতীয় উগ্রবাদ, ধর্মীয় গোড়ামি, হুজুগ, গুজব, উন্মাদনা, ফতোয়াবাজি, অপরাজনীতি, নারীবিদ্বেষ, ধর্মব্যবসা ইত্যাদির বিরুদ্ধে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা তুলে ধরছে হেযবুত তওহীদ। এ লক্ষ্যে গত তিন দশক ধরে মাঠে ময়দানে এ আন্দোলনের নিবেদিত প্রাণ সদস্য-সদস্যারা সর্বতোভাবে কাজ করছে। শান্তিপূর্ণভাবে জনসভা, সেমিনার, র্যালি, প্রকাশনা সামগ্রী প্রচার, পোস্টারিং, ডিজিটাল কন্টেন্ট প্রচার ও পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে আমরা আমাদের বক্তব্য প্রচার করছি। বাংলাদেশে বসবাসরত সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভিতরকার দূরত্ব মোচন করে সম্প্রীতি স্থাপনের লক্ষ্যে আমরা হাজার হাজার সর্বধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। এসব অনুষ্ঠানে সকল ধর্মের ধর্মগুরু ও নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেছেন। আমাদের সঙ্গে তারাও একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। এ কাজ করতে গিয়ে আমাদেরকে একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে যে, একটি ইসলামিক সংগঠন ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজ করবে। তারা অন্য ধর্মের মানুষদের সঙ্গে এত সভা করছে কেন?
এর জবাব দিচ্ছি। দীর্ঘদিন থেকে একটি কট্টরপন্থী শ্রেণি ধর্মীয় সমাবেশে উগ্রবাদী, যুক্তি ও বিজ্ঞানবিরোধী, নারীবিদ্বেষী, সাম্প্রদায়িক ঘৃণাসূচক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। তারা চায় মোল্লাতান্ত্রিক দেশ। এই চাওয়া থেকেই বারবার সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়ে ও বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়েছে, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, গুরুত্বহীন ইস্যুতে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে রাষ্ট্রের ও মানুষের সম্পদ ধ্বংস করা হয়েছে, পিটিয়ে পুড়িয়ে নির্মমভাবে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। যে কোনো ইস্যু পেলেই এই উগ্র গোষ্ঠীটি ভিন্নমতের মানুষকে কাফের, মুরতাদ, মালাউন, ভারতের দালাল, ইসরাইলের দালাল, নাস্তিকের দালাল বলে ফতোয়া দিয়ে সহিংস কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে তারপর সেটাকে ধর্মপ্রাণ তওহীদী জনতার প্রতিরোধ বলে চালিয়ে দিয়েছে। মানুষের ধর্মীয় চেতনাকে তারা তাদের গোষ্ঠীগত স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার বানিয়ে নিয়েছে। এভাবে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশে ২৪ হাজারের বেশি সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে। ২০১২-২০২১ পর্যন্ত ৯ বছরে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ৩ হাজার ৬৭৯টি হামলা হয়েছে (তথ্য: মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র-আসক)। একইভাবে ২০১২ সালে ফেসবুকে গুজব রটিয়ে রামুর ১২টি বৌদ্ধ বিহারে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে দুষ্কৃতিকারীরা। এদেশে উগ্রবাদীরা ২০১৬ সালে রাতের বেলায় ঢাকার গুলশানের মত এলাকায় হোটেলে বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জন মানুষকে জবাই করে হত্যা করেছে। বলা বাহুল্য যে, এ সকল কর্মকাণ্ড ইসলামের মূল শিক্ষা ও আদর্শের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সাংঘর্ষিক।
এ চিত্র শুধু আমাদের দেশের নয়। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (ঘঈজই) অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ভারতে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৮০০ থেকে ১,০০০ টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্স ২০২২ রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে নাইজেরিয়াতে প্রায় ১০,০০০ লোক সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় নিহত হয়েছে। জাতিসংঘের মতে, ২০০৩ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ইরাকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় আনুমানিক ২,৫০,০০০ লোক নিহত হয়েছে। এদিকে মিয়ানমারে ২০১৭ সালের পর থেকে রাখাইন বৌদ্ধদের হাতে প্রায় ৫০,০০০ রোহিঙ্গা মুসলমান নিহত হয়েছে এবং ১০ লক্ষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
আমরা বিশ্বাস করি, যারা উগ্রবাদ লালন করে তারা প্রকৃত ধার্মিক নয়। এরা করুণাময় আল্লাহর প্রতিনিধি নয়। এরা যেমন মোহাম্মদ (সা.) এর অনুসারী নয়, তেমনি যিশু, কৃষ্ণ বা বুদ্ধের অনুসারীও নয়। তাদের ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লাভবান হচ্ছে ইসলামবিরোধী গোষ্ঠী যারা ইসলামকে ‘সন্ত্রাসের ধর্ম’ হিসাবে প্রচারণা চালিয়ে ইসলামভীতি সৃষ্টির সুযোগ পাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানের পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে।
অথচ সকল ধর্মই সাম্প্রদায়িক হিংসা-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে কথা বলে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের কথা বলে। স্রষ্টা ধর্ম প্রেরণ করেছেন মানুষের শান্তির জন্য। তাই তিনি এমন কোনো বিধান দিতে পারেন না যা দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি করবে। আমরা মনে করি, ধর্মগুলোর মধ্যে কোন কোন বিষয়ে মিল আছে সেগুলো খুঁজে বের করে যদি সামনে আনা যায় তাহলে এই বিভক্তির দেওয়াল থাকবে না। ধর্মের অপব্যাখ্যাই এ দেওয়াল সৃষ্টি করেছে। সকল ধর্মের মৌলিক বিশ্বাসগুলোও প্রায় এক। সব ধর্মেই পরকালের কথা বলা হয়েছে। ভালো কাজের বিনিময়ে স্বর্গ ও মন্দকাজের বিনিময়ে নরকবাসের কথা বলা হয়েছে। বিভিন্ন ধর্মে ন্যায়-অন্যায়ের যে মানদণ্ড দেওয়া আছে সেগুলোও একই ধরনের। সব ধর্মই মিথ্যাচার, চুরি, ব্যভিচার, দুর্বলের উপর অত্যাচার, শোষণকে নিষিদ্ধ করে। তাহলে ধর্ম নিয়ে আমাদের মধ্যে বিভেদগুলো কোথায়? সেগুলো সবই বাহ্যিক অনুষ্ঠান ও আচার-বিচার নিয়ে। সেগুলো ধর্মের প্রাণ নয়। অথচ সেগুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি করেই আমরা আমাদের সকলের ধর্মের মূল শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছি। সকল প্রকার বিভেদ মিটিয়ে এক জাতিভুক্ত হওয়াই ইসলামের শিক্ষা। আল্লাহ নবী করিম (সা.) কে নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘বল, ‘হে আহলে কিতাব! এমন এক কথার দিকে এসো, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই, তা এই যে, আমরা আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো আনুগত্য করব না এবং কোন কিছুকে তাঁর অংশীদার করব না এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে আমাদের মধ্যে কেউ কাউকে রব হিসেবে গ্রহণ করব না।’ (সুরা ইমরান ১০৮)।
আল্লাহ সকল সম্প্রদায়ের ঐক্য চাইলেও একটি ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী তাদের মধ্যে বিভেদ জিইয়ে রাখতে চায়। তারা ধর্মগুরুর আসনে বসে নিজেদেরকে সৃষ্টিকর্তার খাস এজেন্ট বলে মনে করে, নিজেদেরকে ঈশ্বরের জায়গায় বসাতে চায়। মুসলমান সমাজে এরা নিজেদের বলে নায়েবে নবী এবং হিন্দু সমাজে এরা নিজেদেরকে ব্রাহ্মণ হিসাবে পরমপুরুষের মুখ থেকে উদ্ভূত ও সমস্ত সৃষ্টির প্রভু বলে থাকে। অন্যান্য ধর্মগুলোতেও এই যাজক শ্রেণিটি পূজা ও উপাসনার জায়গায় স্থান নিয়েছে। তারাই ঈশ্বরের প্রতিভূ, তাদের মুখ দিয়েই ঈশ্বর কথা বলেন, তাদের সেবা করলেই ঈশ্বরের তুষ্টিলাভ হবে। তারা নিজেদের এই অবস্থানকে টিকিয়ে রাখতে ভক্তশ্রেণির সামনে নিজেদের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব আরো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করে। তাদের হাতে ধর্মের কল। এর শক্তি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য নানা সময়ে তারা ভিন্ন ধর্মের বিরুদ্ধে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। তারা ওয়াজ মাহফিলে বসে দেবদেবীদের নিয়ে কটূক্তি করে, শ্রীকৃষ্ণের চরিত্র হনন করে, ভিন্ন ধর্মের উপাসনালয় ও প্রতিমা ভাঙাকে জেহাদ বলে ফতোয়া দেয়। অথচ আল্লাহর স্পষ্ট হুকুম, ‘আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদেরকে তারা ডাকে তোমরা তাদেরকে গালি দিও না, কেননা তারা তাদের অজ্ঞতাপ্রসূত শত্রুতার বশবর্তী হয়ে আল্লাহকে গালি দেবে (সুরা আন’আম ১০৮)।
একইভাবে হিন্দু খ্রিষ্টান বৌদ্ধদের মধ্যেও বহু উগ্র গোষ্ঠী আছে যারা আল্লাহ রসুলকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে। এ ধরনের হুমকি-পাল্টা হুমকি আর গালাগালির মত অসভ্যতা কোনো ধর্মেরই শিক্ষা নয়। ধর্মব্যবসায়ী, উগ্রবাদী গোষ্ঠীর এসব ফতোয়ায় প্রভাবিত হয়ে হিংস্র ও উন্মত্ত হয়ে ওঠে তাদেরই কিছু অন্ধ অনুসারী। তাদের না আছে যুক্তিবোধ, না আছে নিজ বা ভিন্ন ধর্মের মহামানবদের শিক্ষা সম্পর্কে জ্ঞান। তাদের ধর্মীয় জ্ঞান শোনা কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ। স্বামীজি কী বলেছে, হুজুর কী বলেছে, ফাদার কী বলেছে এটা শুনেই তারা ‘ধর্ম গেল, ধর্ম গেল’ জিগির তুলে ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠে; ভিন্ন ধর্মের অনুসারী ও ধর্মগুরুদের চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে, উপাসনালয় ভাঙচুর করে। এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছে মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে। তাই অজ্ঞতা দূর করা ছাড়া এই হানাহানি ও বিদ্বেষ বন্ধ করার কোনো পন্থা নেই। এজন্যই গৌতম বুদ্ধ বলেছেন- অবিদ্যা বড় পাপ, অবিদ্যা থেকেই যাবতীয় দুঃখের সৃষ্টি। অবিদ্যা অর্থ অজ্ঞতা, ভুল ধারণা, ভুল জ্ঞান। আর সক্রেটিস বলেছেন, জ্ঞানই পূণ্য যা বুদ্ধের কথারই প্রতিধ্বনি।
আমরা বিশ্বাস করি, এই মাটি, বায়ু, পানি সবকিছুর উপর ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের অধিকার রয়েছে। কেউ তাদের এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। একটা সময় ছিল যখন এদেশে হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে বাস করত। তাদের মধ্যে কোনো বিদ্বেষ ছিল না। রাজনৈতিক স্বার্থে তাদের এই সম্প্রীতি ধ্বংস করেছে ব্রিটিশ শাসকেরা। তারা ভারতবর্ষের হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টির নীতি গ্রহণ করে যার নাম ডিভাইড এন্ড রুল, যেন এই দুই সম্প্রদায় এক হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে না পারে। শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করতে তারা এদেশে অশ্লীলতা, মাদক, অপ-সংস্কৃতি, রাজনৈতিক দলাদলি সৃষ্টি করেছে।
এখনকার বাস্তবতা হচ্ছে, পূজার সময় সরকার পূজা মণ্ডপে শত শত পুলিশ মোতায়েন করে। একই অবস্থা ভারতে। ঈদের জামাতেও শত শত পুলিশকে পাহারা দিতে হয়। এটা কি কোনো উৎসবের পরিবেশ? পাহারা দিয়ে তো এই অবস্থার পরিবর্তন করা যাবে না। সরকারের কাছে শক্তি আছে, তারা শক্তি প্রয়োগ করে উগ্রবাদের মোকাবেলা করতে চাচ্ছে, নতুন নতুন আইন বানাচ্ছে, দাঙ্গাবাজদের ধরে এনে ফাঁসি বা জেল দিচ্ছে। আমাদের কথা হচ্ছে, শুধু শক্তি প্রয়োগ করে এই সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের মোকাবেলা করা যাবে না। এজন্য সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ দূর করতে হবে, আর সেজন্য লাগবে ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা। ধর্মের নামে যেসব ভ্রান্ত ধারণা তাদেরকে দেওয়া হয়েছে সেগুলোকে ভুল প্রমাণ করতে হবে এবং ধর্মের প্রকৃত শিক্ষায় তাদেরকে শিক্ষিত করতে হবে। এই আদর্শ ও শিক্ষা বিস্তারের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন সকল ধর্মের যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের এ বিষয়ে একমত হওয়া যে, আমরা সম্প্রীতি গড়তে চাই, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ আর চাই না। এজন্য বিদ্বেষমূলক বিতর্ক থামিয়ে ঐক্যের সম্ভাবনাগুলো খুঁজে বের করতে হবে। আমরা চাই সবাই উন্মুক্তভাবে কথা বলুক, একটি সিদ্ধান্তে আসুক। তাহলেই সাম্প্রদায়িক ঐক্যের বিপরীতে যে সব শয়তানি শক্তি আছে তারা কোণঠাসা হবে। আমরা হিন্দু-বৌদ্ধ, আদিবাসী এবং অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দিকে সৌহার্দ্যরে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি। ইসলাম আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছে। রসুলাল্লাহ মদিনার ইহুদি, মুসলিম, পৌত্তলিক সবাইকে নিয়ে একটি জাতীয় নিরাপত্তা চুক্তি প্রণয়ন করেছিলেন যা ঐতিহাসিক মদিনা সনদ নামে খ্যাত। বিশ্বের ইতিহাসে সেটাই ছিল প্রথম লিখিত সন্ধিচুক্তি ও সংবিধান।
আমরা ঐক্যবদ্ধ না হলে তার সুযোগ নেবে পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো। তাদের কোনো ধর্ম নাই, মানবতা নাই, ন্যায়-অন্যায় নাই। তারা কোনো ধর্মে বিশ্বাসী না, কোনো ঈশ্বরে বিশ্বাসী না, কোনো কেতাবে বিশ্বাসী না। ধর্মগ্রন্থের কথা তাদের কাছে মূল্যহীন। তারা চায় ক্ষমতা ও ভোগবিলাস। এজন্য বাকি পৃথিবীর সম্পদ সাপটে নিয়ে তারা নিজেদের দেশে জমা করছে। এংগাস মেডিসনের হিসাব অনুযায়ী অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত জিডিপির ক্ষেত্রে ভারত ছিল এক বৃহত্তম অর্থনীতি, যার অর্ধেক মান মুঘল বাংলা থেকে এসেছিল। কিন্তু ব্রিটিশরা যখন চলে যায়, তখন ভারতবর্ষের তিন কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা গেছে। তাদের সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির ফলে বর্তমানে মাত্র ১০% ধনীর হাতে বিশ্বের ৮২% সম্পদ জমা আছে। বিপরীতে, বৈশ্বিক জনসংখ্যার নিচের ৫০% মানুষের কাছে বিশ্বের মোট সম্পদের ১% এরও কম রয়েছে। এই সম্পদ দিয়ে তারা মারণাস্ত্র বানাচ্ছে, তারা জাতিতে জাতিতে, ধর্মে ধর্মে, গোত্রে গোত্রে সংঘাত লাগিয়ে যাচ্ছে, আর সেখানে অস্ত্রব্যবসা করে যাচ্ছে। এটি তাদের জাতীয় আয়ের প্রধান উৎস। তারা যেন আমাদের দেশকে ইরাক, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, লিবিয়া, সুদান, বসনিয়া, চেচনিয়ার মত যুদ্ধভূমিতে পরিণত করতে না পারে, সেজন্য এখানে রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার, ধর্মীয় উগ্রবাদের বিস্তার রোধ করা অপরিহার্য। আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছাড়া উগ্রবাদ মোকাবেলা করা অসম্ভব। এজন্য সকল ধর্মের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের একটি প্লাটফর্মে আসতে হবে, একসঙ্গে কাজ করতে হবে।