বর্ণিল আয়োজনে অনুষ্ঠিত হলো হেযবুত তওহীদের কেন্দ্রীয় আমির সম্মেলন। এবারের সম্মেলনটি ছিল সবদিক দিয়েই তাৎপর্যপূর্ণ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অস্থিরতা, ক্রমাগত অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের এমন এক সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে কেন্দ্র থেকে কী বার্তা দেওয়া হবে- তা জানতে সবার দৃষ্টি ছিল হেযবুত তওহীদের এমামের দিকে। সম্মেলনে তাঁর উপস্থিতিই উজ্জীবিত করে তুলে মাঠ পর্যায়ের নেতাদের। সেই প্রাণচাঞ্চল্য প্রসারিত হবে তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের মাঝেও এমন আশাবাদ প্রকাশ করেন সম্মেলনে উপস্থিত সদস্যগণ।
গত শুক্রবার রাজধানীর গেণ্ডারিয়ায় ‘মেয়র সাঈদ খোকন কমিউনিটি সেন্টারে’ এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সারাদেশ থেকে আসা জেলা-উপজেলা পর্যায়ের আমির, নবগঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, অতিথি ও শুভানুধ্যায়ীরা এতে অংশগ্রহণ করেন। এ সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘আসন্ন দুর্ভিক্ষ ও রাজনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলায় করণীয়’। সম্মেলনে প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করেন হেযবুত তওহীদের এমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম। তিনি তাঁর বক্তব্যে নতুন সভ্যতার আগমনী বার্তা দিয়ে নেতাকর্মীদেরকে এই নবসভ্যতা প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আগামীর বিশ্বব্যবস্থায় হেযবুত তওহীদ জাতির একমাত্র আস্থার প্রতীক উল্লেখ করে সবাইকে নেতৃত্বের গুণাবলী সম্পন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ার উপর গুরুত্বারোপ করেন।
সকাল ৯ টায় পবিত্র কোর’আন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর কণ্ঠশিল্পী নাজমুল আলম শান্তুর কণ্ঠে হেযবুত তওহীদের দলীয় সঙ্গীত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা “আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান” পরিবেশন করা হয়। পরে হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা এমামুয্যামান মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর জীবনীর উপর একটি ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। এরপর তওহীদ প্রকাশনের কার্যক্রমের উপর ও খুলনা-১ বিভাগের কার্যক্রমের উপর একটি সংক্ষিপ্ত ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। এ পর্যায়ে সকাল ১০টায় প্রধান অতিথি হেযবুত তওহীদের এমাম অনুষ্ঠানস্থলে এসে পৌঁছান। এসময় মুহুর্মুহু করতালি ও স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয় পুরো সম্মেলন স্থল।
হেযবুত তওহীদের ঢাকা মহানগরীর আমির ডা. মাহবুব আলম মাহফুজের উদ্বোধনী বক্তব্যের মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের পর হেযবুত তওহীদের এমাম মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন। এসময় তাঁকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান বিভাগীয় আমির ও কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকগণ। এ পর্যায়ে নবগঠিত কমিটির নতুন সম্পাদক ও নতুন জেলা আমিরদের নাম ঘোষণা করা হয় এবং তাদের হাতে মনোনয়নপত্র তুলে দেওয়া হয়। পরে তাদের সাথে সংক্ষিপ্ত ফটোসেশন পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সকলের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সকাল দশটা ৩৭ মিনিটে হেযবুত তওহীদের এমাম তার মূল্যবান বক্তব্য প্রদান শুরু করেন। বক্তব্যের শুরুতেই তিনি আন্দোলনের জন্য জীবন উৎসর্গকৃত শহীদদের কথা স্মরণ করেন।
হেযবুত তওহীদের এমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম বলেন, দায়িত্বশীলদের রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। আমরা মানবজাতিকে যে ক্ষুধা-দারিদ্র্যহীন, ন্যায়পূর্ণ সমাজের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি সেটা প্রতিষ্ঠা করতে আপনাদের জীবন সম্পদ উৎসর্গ করার মানসিকতা থাকতে হবে। জীবন দিতে প্রস্তুত হলে না খেয়ে মরতে হবে না। ইসলাম একটা জীবনদর্শন। হেযবুত তওহীদ শুধু দোয়া কালাম শিক্ষা দিতে আসেনি। হেযবুত তওহীদ এসেছে মানবজাতিকে ঘোর সঙ্কটের অমানিশা থেকে মুক্তি দিতে, শান্তিপূর্ণ সমাজ উপহার দিতে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করতে।
চলতি বছরের শুরুতে (২২ জানুয়ারি) হেযবুত তওহীদের কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল যার প্রতিপাদ্য ছিল “ব্যর্থ বিশ্বব্যবস্থা: যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টির বিকল্প নেই”। কিন্তু বছর শেষ না হতেই আরেকটি সম্মেলন করার কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে সারা বিশ্বে একটা অস্থিতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে দেশপ্রধানরা খাদ্য সঙ্কট তথা দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছেন। পাশাপাশি অনেক রাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্রের মহড়া শুরু করে দিয়েছেন। যার ফলে সারা বিশ্বের মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এছাড়াও আগামী বছরের শুরুতে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সময় হয়েছে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার। এখন দেরী করার সময় নেই।’ এ কারণেই বছর শেষ হওয়ার অপেক্ষা না করেই এবারের সম্মেলন অক্টোবরেই আয়োজন করা হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
হেযবুত তওহীদের এমাম বলেন, মানবজাতির সামনে আসন্ন এই দুর্ভিক্ষ এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সঙ্কট সমাধানের পথ আমরা তুলে ধরছি। সর্বপ্রথম মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে জাতি হবে একটা, নেতা হবে একজন, আনুগত্য করতে হবে একজনের। কোনভাবেই ঐক্য নষ্ট করা যাবে না। বিভেদপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণেই আজকে বর্তমানের এ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তারা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারবে না, এটা গত পঞ্চাশ বছরে প্রমাণিত হয়েছে। তাদের কাছে সেই আদর্শই নাই। সে আদর্শ আল্লাহ দিয়েছেন হেযবুত তওহীদকে। তাই মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য আপনাদের বেরিয়ে পড়তে হবে। তিনি বলেন, ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর তাদের শৃঙ্খলিত হতে হবে। এই শৃঙ্খলা ব্যক্তিগত ও জাতীয় সর্ব পর্যায়ে হতে হবে। ফসল উৎপাদনে সমন্বয়হীনতা, সুদ ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, পুঁজিবাদী সিস্টেম, অদূরদর্শী প্রকল্প গ্রহণের ফলে আজকে দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি। এসব কিছুর মূলেই রয়েছে শৃঙ্খলার অভাব। আমাদের এই শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
তিনি আরো বলেন, নেতার হুকুম অক্ষরে অক্ষরে পালন করা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। আজকে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে কৃচ্ছ্যতার নীতি অনুসরণ করতে বলছেন, কিন্তু সরকারের আমলা-রাজনীতিবিদরা দুর্নীতি করে টাকার পাহাড় বানাচ্ছে। কানাডায় বাড়ি-গাড়ি করে সেখানে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই জনগণ এখন বিভ্রান্ত, কার কথা তারা শুনবে। আল্লাহ তার রসুলকে (সা.) যে আনুগত্য শিক্ষা দিয়ে গিয়েছিলেন সেই আনুগত্য মানবজীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। এবং সর্বশেষ হচ্ছে দাজ্জালের তৈরি জীবনব্যবস্থা থেকে হেযরত করে আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থায় ফিরে আসতে হবে। তবেই আমরা এই সঙ্কটের মোকাবেলা করতে পারবো, দুর্ভিক্ষের হাত থেকে বাঁচতে পারবো।
তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আজকের এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে অন্য কোন তন্ত্র-মন্ত্রে কাজ হবে না। এই সঙ্কট থেকে বাঁচতে আল্লাহ পথ দিয়েছেন। রসুল (সা.) সেই পথে হেঁটে হেছেন। আমরা সেটা তুলে ধরছি। আমাদের এই প্রস্তাব গ্রহণ করুন। আমাদের ক্ষমতা লাগবে না, মন্ত্রিত্ব লাগবে না। আমরা চাই বাংলাদেশের মানুষ দুর্ভিক্ষের হাত থেকে বাঁচুক, বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। তিনি বিকল্প প্রস্তাব দিয়ে বলেন, আপনারা সরকার যদি সেটা না করতে পারেন তবে আমরা মাঠে নামবো। আমরা জনগণের দ্বারে দ্বারে যাবো। আমাদের কোন অর্থ লাগবে না, বাড়ি-গাড়ি লাগবে না। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে যারা অপপ্রচার করে, হুজুগ তোলে, গুজব ছড়ায়, হামলার উস্কানি দেয়, হত্যার হুমকি দেয়, আমাদের এই মানবতার কল্যাণকামী কাজে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে তাদের আইনের আওতায় আনুন। জাতিকে দুর্ভিক্ষের হাত থেকে বাঁচাতে আমরা মাঠে নামবো কিন্তু সরকারের আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
ওলামায়ে কেরামগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, জনগণকে বিভ্রান্ত করবেন না। তাদের প্রকৃত ইসলাম জানার অধিকার রয়েছে। আপনারা আমাদের কথা শুনুন, আমরা কী বলতে চাই। আমরা আপনাদের বিরুদ্ধে লাগি নাই। আমরা আপনাদের ক্ষতির জন্য আসিনি। আমরা পুরো মানবজাতির শান্তির দূত হিসেবে এসেছি। আপনাদের মধ্যে গুটিকয়েক মানুষের স্বার্থে আঘাত লাগার ফলে আপনারা আমাদের বিরুদ্ধারচরণ করছেন। আমাদের এই মহৎ কাজে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবেন না। আমরা ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে এসেছি, আমাদের ইহুদি খ্রিষ্টান বলে অপপ্রচার করবেন না। আপনাদের এই বিভ্রান্তি, মিথ্যা, অহঙ্কার বেশিদিন চলবে না। বাংলার মানুষ একদিন সত্য জানবে। তারা জেগে উঠবে। তখন এসব অপপ্রচারকারীরা তাদের সম্মানের জায়গা থেকে অপমানের সাথে বিতাড়িত হবে।
সম্মেলনে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন হেযবুত তওহীদের উপদেষ্টামণ্ডলীর প্রধান খাদিজা খাতুন। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় কমিটির নারী বিষয়ক সম্পাদক ও শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক রূফায়দাহ পন্নী, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক উম্মুত তিজান মাখদুমা পন্নী, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগীয় আমির মশিউর রহমান, চট্টগ্রাম বিভাগীয় আমির মো. নিজাম উদ্দিন। অনুষ্ঠানস্থলে একাধিক প্রজেক্টরের মাধ্যমে হেযবুত তওহীদের বিভিন্ন কার্যক্রমের ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা এমামুয্যামান মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর পারিবারিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্বলিত একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এছাড়াও তওহীদ প্রকাশনের পথচলা, খুলনা-১ বিভাগের কার্যক্রম, দুর্ভিক্ষের প্রভাব এবং অ্যাটম বোমা ধংসযজ্ঞ ও শহীদ সুজন হত্যার বিচারের দাবিতে সারাদেশের প্রশাসনকে স্মারকলিপি প্রদান ও মানববন্ধনের উপর নির্মিত ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। এছাড়াও শহীদ সুজনের স্ত্রীর একটি ভিডিও বার্তা অনুষ্ঠানে প্রচার করা হয়। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে সংগঠনের বিভিন্ন কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখায় ১১ জন সদস্য, তিনটি শাখা ও তিনটি বিভাগকে পুরষ্কৃত করা হয়। অনুষ্ঠানের মধ্যাহ্ন বিরতির সময় মাটি মিউজিকের শিল্পীবৃন্দ জাগরণমূলক সঙ্গীত পরিবেশন করেন।