রিয়াদুল হাসান
জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসবাদ সা¤্রাজ্যবাদের চাইতে মাদকও কম জাতিবিনাশী নয়। মাদকদ্রব্য অসংখ্য জীবন ধ্বংস করে এবং সামাজিক ক্ষতির কারণ হয়। মাদকদ্রব্যের ব্যবসায় এবং এর প্রতিক্রিয়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বহু শতাব্দী ধরে মাদকদ্রব্য গ্রহণ জীবনের জন্য একটি বাস্তবতা এবং গত ৫ দশকে এতে আসক্তির পরিমাণ ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশ্বে অবৈধ মাদক হিসেবে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ওপিয়ামজাত দ্রব্যাদি তৈরি হয় মূলত পপি নামের একটি গাছের নির্যাস থেকে। ১৯৯৬ সালের এক পরিসংখ্যান অনুসারে ওই সময় গোটা বিশ্বে পপিচাষের জমির পরিমাণ প্রায় ২,৮০,০০০ হেক্টরে সম্প্রসারিত হয়েছিল। ওপিয়ামজাত মাদকের প্রায় ৯০ শতাংশ আসে দুটি প্রধান উৎপাদন এলাকা গোল্ডেন ক্রিসেন্ট (আফগানিস্তান, ইরান, পাকিস্তান) এবং গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল (লাওস, মায়ানমার, থাইল্যান্ড) থেকে। World Drug Report ২০১১ মোতাবেক বিশ্বের সর্বাধিক মাদক উৎপাদনকারী দেশ আফগানিস্তান। ওপিয়ামজাত মাদকের ৯৩% বাজার আফগানিস্তানের দখলে। এই বাজারের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ছিল সাম্প্রাতিক আফগান যুদ্ধের অন্যতম কারণ, আর অসিলা ছিল জঙ্গিবাদ। বিশ্বের মধ্যে মাদকের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, নেদারল্যান্ড, স্পেন, মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ক্যানাডা ইত্যাদি উন্নত দেশগুলো। উপমহাদেশের মাদকব্যবসায় বাংলাদেশ মাদক চোরাকারবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
অবৈধ মাদকের ব্যবহার এবং অপরাধ হাত ধরাধরি করে চলে। মাদক ব্যবহারকারীরা তাদের নেশা মেটানোর জন্য মাদকদ্রব্য পেতে আক্ষরিক অর্থেই যে কোনো অপকর্ম করতে পারে। মাদক গ্রহণকারীরা প্রায়শই যে সমস্ত অপরাধ করে থাকে সেগুলি হচ্ছে: পকেটকাটা, চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, দেহব্যবসা, অযথা ঝামেলা বাধানো এবং মাদকদ্রব্য বিক্রয়। এরা মাদকের প্রভাবে অনেক অপরাধ করে থাকে। দেশে নেশা আসক্তের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে অপরাধ প্রবণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে ক্ষমতায় আসার পর মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে হত্যা করা হয়েছে ২০ হাজার মানুষকে।
২০১৮ সনে মাদক কারবারীদের বিরুদ্ধে একই প্রকারের যুদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল আমাদের সরকারও। কিন্তু এক্ষেত্রে তথ্য, শিক্ষা, সমাজকল্যাণ, স্বাস্থ্য, যুব ও ক্রীড়া, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং তাদের অধীনস্থ বিভাগসমূহ সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। তারা মাদকদ্রব্যের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ে তোলার জন্য দেশব্যাপী মাঝে মাঝে র্যালি, সেমিনার ও আলোচনাসভা অনুষ্ঠান করছে। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার প্রতিবছর চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়ছে। বাংলাদেশ মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রদত্ত পরিসংখ্যান মোতাবেক কেবল ২০১৭ সনে বাংলাদেশের সকল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক উদ্ধারকৃত ইয়াবা ট্যাবলেটের সংখ্যা হচ্ছে ৪,০০,৭৯,৪৪৩ পিস (চার কোটি উনাশি হাজার চারশত তেতাল্লিশ পিস)। এগুলো জন্য ১,৩২,৮৮৩ জন আসামির বিরুদ্ধে মোট ১,০৬,৫৩৬ টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আর বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের একটি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে কমপক্ষে ৭০ লাখ মানুষ সরাসরি মাদকাসক্ত। এদের মধ্যে ৮৬ ভাগ পুরুষ, ১৩ ভাগ নারী। এক লাখেরও বেশি মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রভাবশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী এবং শিশু-কিশোররাও জড়িত মাদক ব্যবসার সঙ্গে।
অথচ আজ থেকে সেই ১৪শ’ বছর আগে সেই আরব্য জাহেলিয়াতের যুগে আল্লাহর রসুল কেবল তিরস্কার, জুতাপেটা, বেত্রাঘাতের মতো লঘু শাস্তি দিয়ে মাদকমুক্ত সমাজ গড়ে তুলেছিলেন। আল্লাহর হুকুম কানে আসামাত্র ঘরে রক্ষিত যাবতীয় মাদকদ্রব্য রাস্তায় নিক্ষেপ করেছিল সেই জাতির লোকেরা। আবু বকর (রা.), ওমর (রা), ওসমান (রা.) ও আলী (রা.) এর খেলাফতকালে মদ্যপানকারীকে ৪০টি বেত্রাঘাত করার ইতিহাস পাওয়া যায়। ওমর (রা.) অবশ্য কোনো কোনো মদ্যপায়ীকে তার অপরাধের গুরুত্ববিচারে ৮০টি পর্যন্ত বেত্রাঘাত করেছেন। একজন ব্যক্তিকেও মৃত্যুদ- দেওয়া হয় নি। কিন্তু আজ গণহারে মৃত্যুদ- দিয়ে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- করেও বহু দেশ মাদকনিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে। আল্লাহর রসুল যে শিক্ষা দিয়ে এমন একটি আত্মনিয়ন্ত্রণে সক্ষম চরিত্রসম্পন্ন জাতি সৃষ্টি করেছিলেন সেই আদর্শ এখন মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। সেটা হচ্ছে আল্লাহর হুকুমের পক্ষে জাতিকে আগে ঐক্যবদ্ধ করা। তাহলে আল্লাহর হুকুম ও ঐক্যবদ্ধ জাতির নেতার একটি হুকুমই জাতির গতিপথ পাল্টে দিতে সক্ষম হবে।
বিশ্বনবী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন দাজ্জাল আসবে। যারা তাকে রব বলে মেনে নিবে তাদেরকে দাজ্জাল তার তৈরি জান্নাতে রাখবে যা হবে প্রকৃতপক্ষে জাহান্নাম। আজ সমগ্র বিশ্বের মানুষ দাজ্জাল তথা পাশ্চাত্যের আত্মাহীন বস্তুবাদী সভ্যতার বশ্যতা মেনে নিয়েছে, তাকে জাতীয় জীবনের প্রভু বলে স্বীকার করে নিয়েছে, ফলে দাজ্জালের জান্নাত নামক জাহান্নামের আগুন অর্থাৎ অন্যায়, অশান্তি, অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাত ইত্যাদি আজ তাদেরকে ঘিরে ধরেছে। এখন পুনরায় মানুষ যদি সম্মিলিতভাবে এই সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ছাড়া আর কারও সার্বভৌমত্ব মানবে না অর্থাৎ যাবতীয় ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবে, তবেই মানুষের মুক্তি মিলবে, অন্যথা এইভাবেই তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে মানুষ কেবল দেহ নয়, তার একটি আত্মাও আছে। তেমনি ইহকালই সবকিছু নয়, পরকালও আছে। যারা তাদের ইহজীবনকে সত্য ও সুন্দরে সুশোভিত করে রাখবে, তাদের পরকালও হবে শান্তিময়। আর ইহকাল অন্যায়-অশান্তিপূর্ণ হলে পরকালও হবে অশান্তিপূর্ণ।