মুস্তাফিজ শিহাব
ব্রিটিশরা যখন ভারতবর্ষকে শাসন করা শুরু করল তখন তারা এ দেশের মানুষদের শুধু শারীরিকভাবেই শাসন করেনি। তারা এদেশের মানুষের মন ও মস্তিস্কের ভিতরেও তাদের প্রভাব ঢুকিয়ে দিয়েছে। সেই প্রভাব আজও আমাদের সমাজে বিদ্যমান। এখনো আমাদের মধ্যে ব্রিটিশদের ঢুকিয়ে দেয়া সেই মন-মানসিকতা রয়েছে এবং আমরা এখনো সেই মানসিকতাকে লালন করে যাচ্ছি। বিদেশী কিছু হলেই আমরা সেখানে সত্য মিথ্যার যাচাই করি না। ‘তারা কী আর ভেজাল দিতে পারে। তারা কী আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের মতো!’ এ ধরনের চিন্তা আমাদের মস্তিস্কে গেঁথে গিয়েছে। কিন্তু আমাদের এই মানসিকতা তৈরি করার পেছনে তারাই একমাত্র কারণ। ব্রিটিশ প্রণিত শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত একজন ব্যক্তি এতটাই স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক যে সে নিজ স্বার্থের জন্য দেশকেও বিক্রি করে দিতে পারে। সবাই এরকম না হলেও এদের সংখ্যাই আমাদের দেশে বেশি। নৈতিক অবক্ষয় আমাদের প্রতিটি মানুষকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে যে আমাদের চোখে যা কিছু বিদেশী তাই উত্তম। খাবার তাদেরটা ভালো, পোশাক তাদেরটা, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস তাও তাদেরটা, পড়ালেখার মান তাদেরটা ভালো, রাজনৈতিক সিস্টেম তাদেরটা ভালো। পরোক্ষভাবে আমরা আজও তাদের দাসেই পরিণত হয়ে রয়েছি। কেমন ছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষগণ? ইতিহাস থেকে দেখতে পাই আমাদের পূর্বপুরুষগণ ছিলেন নৈতিক শিক্ষার দিক থেকে আদর্শ। তারা সত্য কথা বলতেন, তারা ছিলেন নির্ভেজাল এবং দেশ ও জাতির প্রতি সমর্পিত। তারা কখনো বিদেশী পন্যের পথ চেয়ে বসে থাকতো না। তারা নিজেরাই নিজেদের চাহিদা মতো পন্য উৎপাদন করে নিত।
একটি উদাহারণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। “ আসাম এবং রংপুর জেলায় একপ্রকার রেশম হয়, স্থানীয় ভাষায় তাহাকে ‘এন্ডি’ বলে। এন্ডি রেশনের পোকা প্রতিপালন ও তাহার গুটি হইতে সুতা কাটা অতি সহজসাধ্য কার্য। এই শিল্প তদ্দেশবাসিনী রমণীদের মাঝে একচেটিয়া ছিল। তাহারা এ উহার বাড়ি দেখা করিতে যাইবার সময় টেকো হাতে লইয়া সুতা কাটিতে কাটিতে বেড়াইতে যাইত। এন্ডি কাপড় বেশ গরম ও দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়। ইহা ফ্লানেল হইতে কোন অংশে নুন্য নহে, অথচ ফ্লানেল অপেক্ষা দীর্ঘস্থায়ী। একখানি এন্ডি কাপড় অবাধে ৪০ (চল্লিশ) বৎসর টেকে। ৪/৫ খানি এন্ডি চাদর থাকিলে লেপ, কম্বল, কাঁথা কিছুই প্রয়োজন হয় না। ফলকথা, সেকালে রমণীগণ হাসিয়া খেলিয়া বস্ত্র-সমস্যা পূরণ করিত (চাষার দুক্ষু, বেগম রোকেয়া সাখওয়াত হোসেন)।” আমরা নিজেরাই নিজেদের চাহিদা মেটাতে সক্ষম ছিলাম। এছাড়াও আমাদের সমৃদ্ধ ও শিক্ষার মান বোঝার জন্য ব্রিটিশ রাজনৈতিক লর্ড মেকলে ১৮৩৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যে বক্তব্য দেন তার অংশবিশেষ তুলে ধরছি। “I have traveled across the length and breadth of India and I have not seen one person who is a beggar, who is a thief. Such wealth I have seen in this country, such high moral values, people of such caliber, that I do not think we would ever conquer this country, unless we break the very backbone of this nation, which is her spiritual and cultural heritage, and, therefore, I propose that we replace her old and ancient education system, her culture, for if the Indians think that all that is foreign and English is good and greater than their own, they will lose their self-esteem, their native self-culture and they will become what we want them, a truly dominated nation. অর্থাৎ “আমি ভারতের এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরে বেড়িয়েছি কিন্তু একটি ভিক্ষুকও আমার চোখে পড়েনি, একটি চোরও আমি দেখতে পাইনি। এ দেশে সম্পদের এত প্রাচুর্য এবং এদেশের মানুষগুলো এতটাই যোগ্যতাসম্পন্ন ও উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী যে এদেশকে আমরা কখনই পদানত করতে পারব না যদি না তাদের মেরুদ-টি ভেঙ্গে ফেলতে পারি। এদেশের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যই হচ্ছে সেই মেরুদ-। এ কারণে আমার প্রস্তাব হচ্ছে, আমরা এখানকার প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা, সংস্কৃতিকে এমন একটি শিক্ষা ও সংস্কৃতি দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যাতে প্রতিটি ভারতীয় নাগরিক ভাবতে শেখে যে, যা কিছু বিদেশি ও ইংরেজদের তৈরি তাই ভালো ও নিজেদের দেশের থেকে উৎকৃষ্টতর। এভাবে নিজেদের উপরে শ্রদ্ধা হারাবে, তাদের দেশজ সংস্কৃতি হারাবে এবং এমন একটি দাসজাতিতে পরিণত হবে ঠিক যেমনটি আমরা চাই।” তার এই বক্তব্য থেকে একদিকে যেমন আমাদের ভারতবর্ষের নৈতিক প্রাচুর্য বোঝা যায় অপরদিকে ব্রিটিশদের ঘৃণ্য চক্রান্তও উপলব্ধিতে আসে। এরকম আরো অনেক দৃষ্টান্ত আমরা ইতিহাস খুঁজলেই পাব।
ব্রিটিশদের প্রণীত শিক্ষানীতির ফলে আমাদের মধ্যকার নীতি নৈতিকতা ধ্বংস হয়েছে এবং তাদের শিখানো শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমরা হয়েছি অনুকরণপ্রিয়। আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের অন্ধ অনুকরণ করছি। তাদেরকে অন্ধ অনুকরণ করার ফলে আমরা এখন পর্যন্ত তাদের তৈরি করা নীতিই ব্যবহার করে আসছি। পণ্য ব্যবহার করার মতো ছোট গ-ি থেকে শুরু করে দেশ পরিচালনা করার মতো বৃহৎ ব্যাপারেও আমরা তাদেরই মুখাপেক্ষী। ব্রিটিশরা চলে গিয়েছে ৭১ বছর আগে, পাকিস্তান থেকে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি ৪৭ বছর আগে কিন্তু এতদিনেও আমরা আমাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে পারিনি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কথাই ধরুন। ব্রিটিশরা আমাদের উপর যে কামলা তৈরির শিক্ষাব্যবস্থা চাপিয়ে দিল সেই শিক্ষাব্যবস্থা আমরা আজও বজায় রেখেছি এবং আমাদের এ কারণে হতে হচ্ছে ভুক্তভোগী।
ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে ব্যবসার উদ্দেশ্যে এসেছিল কিন্তু পরবর্তীতে তারা শাসন ও শোষণ শুরু করে। এরই ধারবাহিকতায় এত বিশাল দেশকে পরিচালিত করার জন্য তাদের প্রয়োজন ছিল জনশক্তির। কিন্তু পরিচালনা করার জন্য এত লোক ব্রিটেন থেকে আনা সম্ভব ছিল না। এর ফলেই তারা কেরানী তৈরির শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। এই নীতিতে শুধুমাত্র কেরানী তৈরি হবে আর কিছুই নয়। আমাদের দেশের বর্তমান যে বেকারত্ব সমস্যা তার পিছনেও এই শিক্ষাব্যবস্থাই দায়ী। এই শিক্ষাব্যবস্থায় বাস্তবধর্মী কোনো শিক্ষা তাদের দেয়া হয় না এরফলে তারা স্বাধীনভাবে কোনো কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেনা। তাদের কাজ করার ক্ষেত্রই হচ্ছে কেরানী গীরী। কিন্তু এত কেরানীর তো প্রয়োজন নেই আর সেই কারণেই বেকারদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও শিক্ষাব্যবস্থায় এই তথাকথিত শিক্ষিতদের মধ্যে বাস্তবধর্মী কোনো কিছু না শেখানো হলেও তাদের মধ্যে দম্ভ ও অহংকার ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে যে তারা শিক্ষিত। শ্রমজীবি মানুষের মত নি¤œমানের কাজ করলে ইজ্জত থাকে না। এরফলে ডিগ্রিধারী বিশাল একটি শ্রেণি আজ বেকার হয়ে পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
অতএব আমাদের এখন এই ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা প্রতিনিয়ত যে অনুকরণধর্মী কাজ করে যাচ্ছি সেই অনুকরণধর্মী কাজ বন্ধ করতে হবে। ব্রিটিশদের অনুকরণ করে করে আমরা এতদিনে বস্তুগত উন্নতি ছাড়া আর কোনো দিকেই এগোতে পারিনি এবং ভবিষ্যতেও পারব না। ‘যা কিছু বিদেশি তা-ই উত্তম’ এই নীতি থেকে যদি আমরা বেড়িয়ে আসতে না পারি তবে অচিরেই আমাদের ধ্বংস অনিবার্য।
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, facebook/glasnikmira13)