মুস্তাফিজ শিহাব
বর্তমান মুসলিমদের মধ্যে একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে যে মুসলিমের ঘরে যারা জন্মগ্রহণ করেন তারা জন্মগতভাবেই মুসলমান। যেহেতু জন্মগতভাবেই তারা মুসলমান তাই নামাজ, রোজা, হজ করলে, সৎপথে জীবনযাপন করলেই অর্থাৎ আমল করলেই তারা আল্লাহর মো’মেন বান্দা অর্থাৎ উত্তম মুসলিমে পরিণত হবেন। যারা উত্তম মুসলিম হবেন তাদের জন্যই মূলত জান্নাত।
কিন্তু তাদের এই ধারণা ভুল। জন্মগতভাবে একজন মানুষ মুসলিম হয়ে জন্মায় না। মুসলিম শব্দটি এসেছে তসলিম থেকে যার অর্থ পালন করা, মেনে চলা। অর্থাৎ যারা আল্লাহর হুকুমকে জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে মেনে চলবে তারাই মূলত মুসলিম। কিন্তু মুসলিম হওয়ার পূর্বে আপনাকে মো’মেন হতে হবে কারণ আল্লাহর যে সকল হুকুম মেনে আপনি মুসলিম হবেন তা শুধুমাত্র মো’মেনদের জন্য ফরজ অর্থাৎ অবশ্য কর্তব্য।
তাহলে আসুন আমরা মো’মেন ও মুসলিম এই দুটি বিষয় সম্পর্কে একটু জেনে নেই। অনেকেরই ধারণা মো’মেন ও মুসলিম একই জিনিস কিন্তু এ ধারণাও সঠিক নয়। আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে বলেছেন, “হে মো’মেনগণ, তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না (সুরা ইমরান ১০২)।” এ আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট যে মো’মেন ও মুসলিম একই বিষয় নয়, যদি হতো তাহলে মহান আল্লাহ কখনই মো’মেনদের মুসলিম হবার নির্দেশ দিতেন না। এই একটি আয়াত থেকে আর একটি বিষয়ও স্পষ্ট যে আগে মো’মেন হতে হবে এরপর মুসলিম।
তাহলে মো’মেন হওয়ার উপায় কী? মহান আল্লাহ পবিত্র কোর’আনের বিভিন্ন জায়গায় মো’মেনের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন কিন্তু মো’মেনের সংজ্ঞা দিয়েছেন শুধু একটি আয়াতে। সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াতে বলেন, “তারাই মো’মেন যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের উপর ঈমান আনে ও কোন সন্দেহ পোষণ না করে আল্লাহর রাস্তায় জীবন ও সম্পদ দিয়ে সংগ্রাম করে।” এ সংজ্ঞায় আল্লাহ দুটো বিষয়কে অঙ্গীভূত করেছেন। প্রথমটি হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের উপর ঈমান আনা ও পরেরটি হচ্ছে আল্লাহর রাস্তায় জীবন সম্পদ বাজি রেখে সর্বাত্মক সংগ্রাম করা।
প্রথম অংশ অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রসুলের উপর ঈমান আনার মাধ্যমে বুঝানো হয়েছে কলেমার উপর ঈমান আনা। কলেমা অর্থাৎ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসুলাল্লাহ এ কথার উপর ঈমান আনা। বর্তমানে এ কলেমার ভুল অনুবাদ করা হয়। ইলাহার স্থলে বাংলা যেখানে হবে হুকুমদাতা সেখানে মাবুদ বা উপাস্য করা হয়। কিন্তু ইলাহ ও মাবুদ উভয়ই আরবী শব্দ ও একটি আরবী শব্দের বাংলা অনুবাদে আরেকটি আরবী শব্দ ব্যবহার করা সমীচীন নয়। কলেমার উপর বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহকে জীবনের সর্বস্তরে হুকুমদাতা হিসেবে মেনে নেয়ার অঙ্গীকার করে। ব্যক্তিজীবন, সামাজিকজীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন অর্থাৎ সার্বিক জীবনে যেখানে যেখানে আল্লাহর হুকুম রয়েছে সেখানে সেখানে আল্লাহর হুকুম ছাড়া আর কারো হুকুম মানবে না। কিন্তু বর্তমানে আমরা, শুধু আমরা নই গোটা মুসলিম জাতিই, আল্লাহর হুকুম সমূহ শুধু ব্যক্তিজীবনে মানছি কিন্তু রাষ্ট্রজীবন ও সামাজিক জীবনে মানুষের তৈরি তন্ত্র-মন্ত্র মেনে চলছি। এর ফলে আমরা আল্লাহর সাথে স্পষ্ট শিরক করছি যেই শিরকের গুনাহ আল্লাহ মাফ করবেন না বলে তিনি সে কথা কোর’আনে বেশ কিছু জায়গায় স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। কলেমার শেষের অংশ হচ্ছে আল্লাহর রসুলকে শেষ নবী ও রসুল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া।
দ্বিতীয় অংশে জীবন ও সম্পদ দিয়ে সর্বাত্মক সংগ্রাম অর্থাৎ জেহাদ করার কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যার ফলে অনেকেই জেহাদকে সন্ত্রাসের সাথে গুলিয়ে ফেলেন। ইসলামের সঠিক আকিদা না থাকার ফলে এ ধরনের ভুল হয়। আবার অনেকে ঘরে বসে নিজের নফসের বিরুদ্ধে জেহাদ করাকে বড় জেহাদ মনে করেন কিন্তু সুরা ফোরকানের ৫২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন যে যারা ন্যায়ের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করবেন তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ করাই হবে বড় জেহাদ। এ সংগ্রাম কোন নির্দিষ্ট ধর্ম, গোত্র বা বিশেষ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয়, এ সংগ্রাম তাদের সকলের বিরুদ্ধে যারা ন্যায়ের বিপক্ষে অন্যায়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। এ সংগ্রাম লেখনী দ্বারা হতে পারে, বক্তব্য দ্বারা হতে পারে। এর চূড়ান্ত পর্যায় হচ্ছে যুদ্ধ যা করার এখতিয়ার শুধু রাষ্ট্রের রয়েছে, কোনো ব্যক্তি, আন্দোলন বা গোষ্ঠীর নেই। যদি আল্লাহর সত্যদীন অর্থাৎ ইসলাম প্রতিষ্ঠিত না থাকে তবে তা প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক সংগ্রাম করতে হবে আর যদি তা প্রতিষ্ঠিত হয় তবে তা রক্ষার জন্য সংগ্রাম বজায় রাখতে হবে। সর্বাত্মক সংগ্রাম করা মো’মেনের জন্য অত্যাবশ্যক।
আল্লাহর রসুল এই কালেমার ডাকের মাধ্যমে একদল মানুষকে জাহেলিয়্যাত থেকে মো’মেনে পরিণত করলেন। এরপর তাঁর গোটা তেইশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম, অটল অধ্যাবসয়ের মাধ্যমে এই মো’মেনদের নিয়ে গঠন করলেন একটি ঐক্যবদ্ধ উম্মাহ, যে উম্মাহর দায়িত্বই ছিল সমগ্র দুনিয়ায় আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করা। এই উম্মাহই হচ্ছে উম্মতে মোহাম্মদী। সেই উম্মাহর বিনাশ কোন পথে তাও মহান আল্লাহ বলে দিলেন, “যদি তোমরা আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রামে বের না হও তাহলে তিনি তোমাদের কঠিন শাস্তি দিবেন এবং তোমাদের উপরে অন্য জাতি চাপিয়ে দেবেন (সুরা তওবা ৩৯)।” কিন্তু মহান আল্লাহর এই কঠোর আদেশ সে জাতি ভুলে গেলো এবং অভ্যন্তরীণ বিবাদে লিপ্ত হয়ে নিজেদের ঐক্যকে বিনষ্ট করে ফেললো। আল্লাহ ঐক্য বিনষ্টের কুফলও বলে দিলেন, “তোমরা নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবে না, তাহলে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হয়ে যাবে (সুরা আনফাল ৪৬)।” এছাড়াও ঐক্য বিনষ্ট করাকে আল্লাহর রসুল কুফর বলেছেন (হাদিস- আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রা.) থেকে মুসলিম, মেশকাত)। জাতি তাঁর মূল দায়িত্ব অর্থাৎ মো’মেনের মূল কাজ জেহাদ, দীন প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক সংগ্রামকে ভুলে গিয়ে ভোগ বিলাসে লিপ্ত হলো। তখনই উম্মাহ আর জাতিগতভাবে মো’মেন রইলো না।
মো’মেন না হওয়ার ফলে আল্লাহ এই উম্মাহ থেকে তাঁর অভিভাকত্ব উঠিয়ে নিলেন এবং তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা করলেন। আল্লাহর শাস্তি হুট করে আসে না। তিনি শাস্তি দেয়ার আগে সঠিক পথে ফিরে আসার সময় দেন, অবকাশ দেন। সেই সময়টিও এ জাতি পেয়েছিল কিন্তু আকিদা ভুলে যাওয়ার ফলে জাতি পুনরায় নিজেদের আসল কর্তব্য ধারণ করতে ব্যর্থ হয়। এরই ফলশ্রুতিতে মহান আল্লাহ এই জাতিকে ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের অধীন করে দিলেন এবং তারা এসে আল্লাহর বিধানগুলোকে বাদ দিয়ে নিজেদের তৈরি তন্ত্র-মন্ত্র এ জাতির উপর চাপিয়ে দিলো। আমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলাম থেকে বের হয়ে কার্যত কাফের মোশরেকে পরিণত হলাম।
অতএব আমাদের এখন সর্বপ্রথম ঐক্যবদ্ধ হয়ে পুনরায় আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ করতে হবে। আমরা ব্যক্তিগতভাবে যে আমলগুলো করে যাচ্ছি সেগুলো মো’মেনদের জন্য ফরজ অতএব মো’মেন হওয়ার পর আমাদের সে সকল আমল কাজে দিবে, আমাদের জান্নাতের স্তর বাড়াতে সহায়তা করবে। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে, অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে যখন আল্লাহর বিধান চলে না তখন আমাদের সুন্নাতী লেবাস, খাওয়ার পর নিমক খাওয়া, ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমল করা ইত্যাদি সকল কাজ অর্থহীন। তাই ব্যক্তিগতভাবে লেবাস ধারণ করে প্রচলিত ইসলাম পালন করার সময় এখন নয়, এখন সময় হচ্ছে শত ত্যাগ করে হলেও আল্লাহর রসুলের প্রকৃত ইসলামকে দুনিয়ায় পুনঃ প্রতিষ্ঠা করে শান্তি, ন্যায় ও সুবিচার নিশ্চিত করা।
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, facebook/glasnikmira13)