সম্পাদনা: আদিবা ইসলাম
জ্ঞানে-গুণে, প্রজ্ঞায় যেসব মহিলা সাহাবি উম্মতের জন্য “পথিকৃৎ” হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, উম্মে সুলাইম (রা.) সেসব সম্মানিতাদের অন্যতম। তাঁদের সার্বিক অনুসরণ আমাদের জীবনকে সৌভাগ্যম-িত করবে। কারণ রসুল (সা.) বলেন, আল্লাহ কোন কথাকে কাজ ছাড়া এবং কোন কথা ও কাজকে নিয়ত ছাড়া এবং কোনো কথা, কাজ ও নিয়তকে সুন্নাত অনুযায়ী না হওয়া পর্যন্ত কবুল করেন না (কুরতুবি)।
উম্মে সুলাইম (রা.) মদিনার খাজরাজ গোত্রের সম্ভ্রান্ত শাখা আদি বিন নাজ্জারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন। তাঁর পিতার নাম মিলহান ইবন খালিদ এবং মাতার নাম মুলাইকা বিনতে মালিক। উম্মে সুলাইম তাঁর ডাক নাম। আসল নাম সম্পর্কে কেউ বলেন সাহলা, রুমাইলা, মুলাইকা, আর রুমাইসা। তার জীবন ছিল ঘটনাবহুল আর প্রতিটি ঘটনা থেকেই আমরা খুঁজে পাই শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত।
দীন গ্রহণ চর্চায় উম্মে সুলাইম ছিলেন অগ্রগামী। মদিনার কতিপয় ভাগ্যবান সাহাবি যখন মক্কায় রসুল (সা.)-এর কাছে প্রথম আকাবার শপথ করে ফিরে গিয়ে ইসলামের চর্চা শুরু করেন তখন উম্মে সুলাইম (রা.) দীনুল হক কবুল করতে এক মুহূর্তও দেরি করেননি। সুতরাং তিনি আনসারদের সাবিকুনাল আউয়ালুন অর্থাৎ প্রাথমিক যুগের মো’মেনদের মধ্যে পরিগণিত হন।
রাসুলাল্লাহর প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অতুলনীয়। তাঁর ইসলাম গ্রহণ করার কারণে প্রথম স্বামী মালিক তাকে ও সন্তানকে ফেলে সিরিয়ায় দেশান্তরী হয় এবং মারা যায়। এ সম্পর্কে তার পুত্র আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, উম্মে সুলাইম (রা.) তাঁর স্বামীকে বলেন, “আজ আমি এমন একটি খবর নিয়ে এসেছি যা তোমার পছন্দ নয়।” মালিক বললেন: “তুমি তো সব সময় এই বেদুঈনের কাছ থেকে আমার অপছন্দনীয় বার্তাই এনে থাক।” স্বামীর কথার প্রতিবাদ করে তিনি বললেন, “হ্যাঁ, তিনি বেদুঈন। তবে আল্লাহ তাকে মনোনীত করে নবী বানিয়েছেন।” মালিক জানতে চাইলো, “তা আজ কী খবর আনলে, শুনি।” বললেন, “মদ হারাম ঘোষিত হয়েছে।” মালিক বললো, “তোমার ও আমার সম্পর্ক এখানেই শেষ হলো।” এভাবেই আল্লাহকে হুকুমদাতা হিসাবে মেনে নেবার জন্য উম্মে সুলাইমকে (রা.) বিবাহিত জীবনে বিচ্ছেদ টানতে হলো। কী কঠিন ত্যাগ! নবী (সা.) এর সেই হাদিসের তিনি মূর্ত প্রতীক ছিলেন যেখানে বলা হয়েছে, “তোমাদের কেউই মো’মেন হতে পারবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না তার নিকট তার পিতা, সন্তানাদি ও সমস্ত মানুষ অপেক্ষা আমিই অধিকতর প্রিয় হবো (বুখারী, মুসলিম)।
প্রথম স্বামীর মৃত্যুতে উম্মে সুলাইম বিধবা হলে আবু তালহা আনন্দিত হলেন। কারণ উম্মে সুলাইম ছিলেন জ্ঞান-বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও চরিত্রে নেত্রীস্থানীয়। আবু তালহার মতো ধনশালী, মর্যাদাবান, স্বাস্থ্যবান ও জ্ঞানী ব্যক্তি এমন নারীকেই সঙ্গীনি হিসেবে পেতে চাইবেন সেটাই স্বাভাবিক। তিনি দ্রুত প্রস্তাব নিয়ে যাবার পথে শুনলেন, উম্মে সুলাইম পিতৃধর্ম পৌত্তলিকতা পরিত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তার বাড়িতে পৌঁছে তার পুত্র আনাস (রা.) উপস্থিতিতে প্রস্তাব পেশ করলে তিনি উত্তরে বললেন, “আবু তালহা। আপনার মতো ব্যক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা যায় না। কিন্তু যেহেতু আপনি একজন কাফির এবং আমি একজন মুসলমান সে জন্য আমি আপনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারি না।”
তারপর আরো কিছু আলোচনার পর তিনি বললেন, আবু তালহা! একবার কি চিন্তা করে দেখেছেন যে, আল্লাহকে ছাড়া আপনি যে দেবতার পূজা অর্চনা করছেন, তা মাটি থেকে উৎপাদিত একটি বৃক্ষের অংশ ছাড়া আর কিছুই নয়? আবু তালহা বললো, “হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন।”
উম্মে সুলাইম বললেন, “আপনার কি এখনো লজ্জা হচ্ছে না?” আপনি এমন একটি কাষ্ঠফলকের পূজা করে যাচ্ছেন। যার একাংশকে আপনি নিজের জন্য প্রভু হিসেবে তৈরি করে নিয়েছেন। আর অপরাংশকে অন্য কেউ রান্নার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে। আবু তালহা, আপনি যদি ইসলাম গ্রহণ করেন, তাহলে আপনাকে আমি স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত। আবু তালহা বলল, “কে আমাকে ইসলামে দীক্ষিত করবে? উম্মে সুলাইম বললেন, “আমিই এ কাজের জন্য যথেষ্ট।”
আবু তালহা, “কীভাবে?”
উম্মে সুলাইম বললেন, “সত্যের সাক্ষ্য দিন এবং বলুন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই এবং এও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রসুল। তারপর বাড়িতে ফিরে মূর্তিকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেলুন!”
আবু তালহা ইসলাম গ্রহণ করলে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বিয়ে হয়। এ ঘটনা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার হয় যে পরিবার গঠনের জন্য আদর্শগত মিল জরুরি। নিছক প্রথা ও আনন্দের জন্য ইসলামে বিয়ের বিধান আসেনি। মদিনার মুসলিম রমনীরা বলেছিলেন, “উম্মে সুলাইমকে দেয়া আবু তালহার মোহরের মতো এত উত্তম মোহর আর আমরা দেখিনি। তার মোহর ছিল ইসলাম। তিনি বুঝেছিলেন সকল কল্যাণের মূল জ্ঞান।”
রসুলাল্লাহ (সা.) মাঝে মাঝে বিভিন্ন সাহাবিদের বাড়িতে বেড়াতে যেতেন। তিনি যাঁদের বাড়িতে যেতেন তাঁরা যেন আকাশের চাঁদ পেতেন। নবীর প্রতি উম্মে সুলাইমের (রা.) ভালোবাসা এত প্রবল ছিল যে রসুলাল্লাহ (সা.) কখনও দুপুরে তাঁর ঘরে বিশ্রাম নিতে গেলে গরমের প্রচ-তায় যখন তাঁর কপালে ঘাম জমে থাকতো উম্মে সুলাইম সেই ঘামগুলো সযতনে শিশিতে তুলে রাখতেন। সন্তর্পণে সংরক্ষণ করতেন মাথা থেকে ঝরে পড়া চুলগুলো পর্যন্ত।
নবীজী একদিন তৃষ্ণার্ত। ডাকলেন উম্মে সুলাইমকে!
:উম্মে সুলাইম, পানি দাও!
উম্মে সুলাইম (রা.) মশক থেকে পানি ঢালতে শুরু করলেন। নবীজী বাধা দিয়ে বললেন, “ঢালতে হবে না। পুরো মশকটাই আমার কাছে দাও!” মশক তুলে দিলেন নবীজীর খেদমতে। নবীজী মশকের মুখে মুখ রেখে পানি পান করলেন। রসুলাল্লাহ চলে যাবার পর উম্মে সুলাইম মশকের মুখটি কেটে নিজের কাছে রেখে দিলেন। প্রিয়তম নবীর পবিত্র স্পর্শে ধন্য এই অমর স্মৃতিই তো জীবনের শ্রেষ্ঠ সংগ্রহ!
বিখ্যাত সাহাবি আনাস (রা.) এই উম্মে সুলাইমেরই আদরের দুলাল। আনাসের মাথার চুলগুলো বেশ বড় হয়ে পড়েছে। ভাবছিলেন কেটে ফেলবেন। মাকে জানালেন সেই ইচ্ছের কথা! মা মমতাভরা কন্ঠে বললেন: “না বাবা! চুলগুলো কেটো না। কারণ তোমার এই চুলগুলোয় রসুলাল্লাহ হাত বুলিয়েছন কতবার।”
জীবনের শেষ সময় যখন উপস্থিত তখন তিনি একটি অসিয়তপত্র লেখালেন। তাতে এও লেখালেন- “প্রিয়তম নবী (সা.) এর সুরভিত যে ঘামের বিন্দুগুলো আমি শিশির মধ্যে সংরক্ষণ করে রেখেছি, আমার কবরের ভেতরে ওই শিশিটি রেখে দিও।” রসুলের জন্য উম্মে সুলাইমের ভালোবাসা ছিল জীবনব্যাপী!
উম্মে সুলাইম রসুল (সা.) এর অনেক হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি কোনো দীনি বিষয় জানার জন্য রসুলাল্লাহকে প্রশ্ন করতে লজ্জা পেতেন না।
উম্মে সুলাইম তার ছেলে আনাসকে (রা.) শৈশবেই তওহীদের শিক্ষা দেওয়া শুরু করেন। ১০ বছরের পুত্রকে নিয়ে তিনি রসুল (সা.) এর কাছে হাজির হয়ে আবেদন জানালেন, “হে আল্লাহর রসুল (সা.)! আমার মাতা পিতা আপনার জন্য কোরবান হোক। এ আমার পুত্র আনাস। আমার আন্তরিক কামনা হলো সে আপনার খিদমত করুক। রসুলাল্লাহর সংস্পর্শে থাকার দরুন আনাস (রা.) অনেক বেশি সংখ্যক হাদিস বর্ণনা করেন। যেমন- নবী (সা.) বলছেন, “হে আমার প্রিয় বালক! তোমার পক্ষে সম্ভব হলে সকাল ও সন্ধ্যা এমনভাবে অতিবাহিত করবে যে, তোমাদের মনে কারো জন্য কোন মালিন্য থাকবে না।” তারপর বললেন, “হে প্রিয় বালক! জনগণের প্রতি এরূপ ভালবাসা পোষণ আমার নীতি আমার আদর্শ। আর যে ব্যক্তি আমার আদর্শকে ভালোবাসে, সে যেন ঠিক আমাকেই ভালোবাসলো। আর যে আমাকে ভালোবাসলেন, সে বেহেশতে আমারই সাথী হবে (তিরমিযী)”।
আনাস (রা.) বলতেন, “আল্লাহ আমার মাকে উত্তম প্রতিদান দিন। তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে আমার প্রতিপালন ও প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।” মুসলিম নারীরা তখন সন্তান প্রতিপালনে এমনি দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতেন। যার ফলে সন্তানরা খাঁটি ও সাবের মো’মেনের চরিত্র লাভ করেছিল। একবার তার মা তাকে নবীজীর নিকট নিয়ে গিয়ে বললেন, “ইয়া রসুলাল্লাহ! আপনার এই ছোট্ট খাদেমটির জন্য একটু দোয়া করুন। রসুল (সা.) দোয়া করলেন, “হে, আল্লাহ! তুমি তার অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে সমৃদ্ধি দান কর। তাকে দীর্ঘজীবী কর এবং তার গুনাহ মাফ করে দাও।”
আবু তালহার (রা.) সংসারে উম্মে সুলাইমের (রা.) একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। তার নাম রাখা হয় আবু উমায়ের। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে আবু উমায়ের শিশু অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করে। ধৈর্যশীলতা ও আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কল অবলম্বনের ক্ষেত্রে উম্মে সুলাইম (রা.) যে মানব ইতিহাসের এক অসামান্য নারী, তার প্রমাণ মেলে শিশুপুত্র আবু উমায়েরের মৃত্যুতে। সন্তানের মৃত্যুতেও উম্মতে মোহাম্মদীর এক নারী কীভাবে আল্লাহর প্রতি নির্ভর করে সবর অবলম্বন করেছিলেন লক্ষ করুন। শিশুটির মৃত্যুর সময় উম্মে সুলাইমের (রা.) স্বামী আবু তালহা (রা.) ঘরের বাইরে ছিলেন। উম্মে সুলাইম (রা.) চুপচাপ তাকে গোসল দিয়ে কাফন পরিয়ে একদিকে রেখে সবাইকে বলে দিলেন, আবু তালহা বাড়িতে ফিরতেই এই হৃদয়বিদারক খবর যেন কেউ না দেয়। দিলে তিনি মারাত্মক ব্যথিত হবেন। রাতে তিনি বাড়িতে ফিরলে উম্মে সুলাইম তাঁকে খেতে দিলেন। অন্যান্য দিনের মতোই তিনি বিছানায় শুয়ে পড়লে উম্মে সুলাইম (রা.) বললেন, “ধরো যদি তোমাকে কিছু ধার দেয়া হয়, তারপর ফিরিয়ে নেয়া হয়, তাহলে তা কি তোমার কাছে অসহ্য মনে হবে?”
আবু তালহা বললেন, “অবশ্যই নয়।” তিনি বললেন, “তাহলে শোনো। তোমার পুত্র আবু উমায়ের আমাদের কাছে আল্লাহর আমানত ছিল। আল্লাহ তাকে ফিরিয়ে নিয়েছেন। এখন তোমার ধৈর্য ধরা উচিত।” সন্তানের শোকে আহাজারি করা ছিল মায়ের জন্য খুবই স্বাভাবিক, সেখানে মা উম্মে সুলাইমই (রা.) তারা স্বামীকে অভূতপূর্ব উপায়ে ধৈর্য ধারণের শিক্ষা দিলেন। হুজুর (সা.) সকালে তাঁর ধৈর্য ও সন্তুষ্টির প্রশংসা করলেন ও দেখা করলেন। তিনি যেন তাদের অন্তর্ভুক্ত যাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণের চেষ্টা করবে আল্লাহ তাকে ধৈর্যের শক্তি প্রদান করবেন। আর ধৈর্য হতে অধিক উত্তম ও ব্যাপক কল্যাণকর বস্তু আর কিছুই কাউকে দান করা হয়নি (বুখারী, মুসলিম)।”
মদিনায় তখন রসুলকে কেন্দ্র করে একটি জাতি গড়ে উঠছে। প্রতিদিন নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে, নতুন নতুন মানুষ ইসলামে দীক্ষিত হচ্ছে। একের পর এক যুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছে। হতদরিদ্র সেই জাতিটি এ ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে বিরাট অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। একবার রসুল (সা.) নিরুপায় হয়ে সাহাবিদের এক ব্যক্তি সম্পর্কে বললেন, “এমন কেউ কি আছে যে আল্লাহর এই বান্দাকে মেহমান বানাবে?” উম্মে সুলাইমের (রা.) আবু তালহা তাকে বাড়ি নিয়ে এলেন এবং জানতে পারলেন বাচ্চাদের জন্য সামান্য খাবার শুধু রয়েছে। আবু তালহা (রা.) বললেন, “কোন অসুবিধা নেই। বাচ্চাদের ভুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও। তারা ঘুমিয়ে পড়লে আমরা তাদের খাবার মেহমানের সামনে রেখে দেব। তুমি বাতি ঠিক করার অসিলায় তা নিভিয়ে দেবে। অন্ধকারে মেহমান খেয়ে নেবে এবং আমরাও এমনি এমনি মুখ চালাতে থাকবো। এভাবে পুরো পরিবার মেহমানকে খাইয়ে নিজেরা অভুক্ত রইলেন। হুজুর (সা.) তাদের এই বলে সুসংবাদ দিলেন যে, “রাতে মেহমানের সঙ্গে তোমাদের আচরণ আল্লাহ খুব পছন্দ করেছেন।” আল্লাহর দীনের জন্য স্বামী স্ত্রীর এই স্বতঃস্ফূর্ত কোরবানি কেবল প্রকৃত মো’মেনদের পক্ষেই সম্ভব। কারণ ঘরে খাবার না থাকা সত্ত্বেও মেহমান নিয়ে আসা, অতঃপর নিজেরা না খেয়ে সন্তানদেরকে স্বেচ্ছায় ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুম পাড়িয়ে মেহমানদারী করা কোনো সাধারণ ত্যাগস্বীকার নয়।
নারীদের সাধারণ দুর্বলতা এই যে, কথার আমানতদারিতা রক্ষায় তারা সচেতন নয়। একবার আনাস (রা.) বাড়িতে ফিরতে দেরি হওয়ায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “এত দেরি হলো কেন?” তিনি জবাব দিলেন, “রসুলাল্লাহর (সা.) একটি গোপন কাজে গিয়েছিলাম।” মা মনে করলেন। ছেলে হয়তো সত্য গোপন করছে। এ জন্য জানতে চাইলেন, “কি কাজ?” আনাস জবাব দিলেন- “একটি গোপন কথা, কাউকে বলা যাবে না।” মা বললেন, “তাহলে গোপনই রাখ, কারও কাছে প্রকাশ করো না।”
অনেক ঘটনা পাওয়া যায় উম্মে সুলাইম (রা.)-এর মহানুভবতার। তিনি ছাগল পালতেন এবং ছাগলের দুধ থেকে ঘি প্রস্তুত করে রসুল (সা.) এর বাসায় পাঠিয়েছেন। পঞ্চম হিজরীতে নবী (সা.) এর যখন যয়নব বিনতে জাহাসের (রা.) সাথে বিয়ে সম্পাদিত হলো তখন উম্মে সুলাইম (রা.) ছাগলের দুধ থেকে “মালিদাহ” (অর্থাৎ ঘি) বানিয়ে এক বড় পাত্র ভরে উপহার হিসাবে পাঠালেন।
একদিন আবু তালহা (রা.) বাড়িতে এসে উম্মে সুলাইমকে বললেন, “রসুল (সা.) অভুক্ত রয়েছেন। কিছু খাবার পাঠিয়ে দাও।” উম্মে সুলাইম (রা.) আনাস (রা.) কে দিয়ে কিছু রুটি পাঠালেন। রসুল (সা.) না খেয়ে সকল সাহাবাদের নিয়ে আবু তালহার (রা.) বাড়িতে চলে এলেন। আবু তালহা (রা.) চিন্তায় পড়ে গেলেন যে, “এত মানুষের জন্য খাবার যথেষ্ট হবে না।” উম্মে সুলাইমকে (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, “সকলেই যাতে খাবার খেতে পারে সে ব্যাপারে কী করা যায়?” তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে জবাব দিলেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ এবং আল্লাহর রসুল ভালো জানেন। অতঃপর যে খাবার ছিল তা সামনে হাজির করলেন। আল্লাহপাক তাতে এত বরকত দিলেন যে, সবাই পেটপুরে খাবার খেলেন।
ওহুদ, খায়বার এবং হুনাইন ছাড়াও উম্মে সুলাইম (রা.) অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি মশক ভরে পানি আনতেন। আহতদের পানি পান করাতেন, ছাতু গুলিয়ে দিতেন, তীর উঠিয়ে দিতেন এবং প্রয়োজনে চিকিৎসার সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা করতেন।
হুনাইনের যুদ্ধে তিনি খঞ্জর হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রসুল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন: “খঞ্জর দিয়ে কী করবে? তিনি আরজ করলেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ! কোনো মুশরিক নিকটে এলে তার পেট ফেঁড়ে ফেলবো।”
বিস্তৃত জীবন পরিক্রমা থেকে স্বল্পপরিসরে যে আলোকচ্ছটা বিচ্ছুরিত হয়েছে তার কয়েকটি এখানে সাজিয়ে দেয়া হলো:
- দীন গ্রহণ ও চর্চায় ছিলেন অগ্রগামী
- শেষ নবীর প্রতি ভালোবাসা ছিল সবার উপরে
- শরক বেদাতের মূলোৎপাটনে অনন্য ভূমিকা
- তিনি বুঝে ছিলেন সকল কল্যাণের মূল জ্ঞান
- সন্তান প্রতিপালনে অনন্য আদর্শ
- ধৈর্যের মূর্তপ্রতীক উম্মে সুলাইম (রা.)
- নিজে না খেয়ে মেহমানদারী
- গোপনীয়তা রক্ষায় সুরক্ষাপ্রাচীর
- আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কল
- জেহাদে নিবেদিতপ্রাণ মোজাহেদা
- আল্লাহর পথে সার্বক্ষণিক আহ্বানকারী
- জীবনসঙ্গীকে দীনের পথে সর্বোত্তম সাহায্যকারী। আল্লামা ইবনে আছির (রা.) তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, তিনি সমসাময়িক যুগে অন্যতম জ্ঞানী মহিলা ছিলেন।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন যে-নবী (সা.) বলেছেন, “আমার উম্মতের সবাই জান্নাতে যাবে, যে অস্বীকার করেছে সে বাদে।” জিজ্ঞেস করা হলো, “কে অস্বীকার করেছে, হে রসুল (সা.)?” উত্তরে তিনি বললেন, “যে আমার অনুসরণ করলো, সেই বেহেশতে যাবে আর যে ব্যক্তি অনুসরণ করলো না, সেই অস্বীকার করলো।”
উম্মে সুলাইম (রা.) ছিলেন যথাযথই রসুল (সা.) এর অনুসরণকারী। সহীহ মুসলিমে আছে, নবী (সা.) মেরাজের ঘটনা বলতে গিয়ে বলেন, “আমি জান্নাতে গেলাম। সেখানে কিছু শব্দ শুনলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কে? লোকজন বললো, আনাসের মা গামিসাহ বিনতে মিলহান (উম্মে সুলাইম)।”
[সম্পাদনা: আদিবা ইসলাম, এইচ এসসি (১ম বর্ষ) কবি নজরুল সরকারি কলেজ, ঢাকা]