শাকিলা আলম
হেযবুত তওহীদের মেয়েরা কেন রাস্তায় বই বিক্রি করে, পত্রিকা বিক্রি করে, কেন তারা সভা সমাবেশে অংশ নেয়- এই প্রশ্নের কোনো ধরনের তাত্ত্বিক বা শাস্ত্রীয় আলোচনায় না গিয়ে বাহ্য দৃষ্টিতে বোঝার মতো উত্তরে বলতে হয়, মুসলমানসহ গোটা মানবজাতি আজ যে হুমকির মুখে রয়েছে, সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর আগ্রাসী নীলনকশায় গোটা পৃথিবীকে ধ্বংসে তাদর যে আয়োজন চলছে, এদের হাতে কারো ভবিষ্যতই নিরাপদ নয়- এই বিষয়টা হেযবুত তওহীদের ছেলে-মেয়ে সকলেই সমানভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে। তারা আরো বুঝেছে, নারীরা এ অবস্থায় ঘরের ভেতর কালো বোরখা প্যাচিয়েও আত্মরক্ষা করতে পারবে না। আ-া-বাচ্চাসহ সবাইকে মরতে হবে অথবা ধর্ষিত হতে হবে, দেশ থেকে বিতাড়িত হবে। দ্বিতীয়ত, ধরা যাক সেই ধরনের আগ্রাসন থেকে কোনো উপায়ে আমরা বেঁচেই গেলাম। তারপরও কিন্তু বিপদ কেটে যাচ্ছে না। বর্তমানে আমরা আভ্যন্তরীণভাবে এমন এক বাজে সিস্টেমের মধ্যে পড়ে গেছি যে, এমনিতেই আমাদের নিরাপদ থাকা সম্ভব নয়। ঘর থেকে বেরোলে আমাদের ফিরে আসার নিশ্চয়তা নেই। ঘরের ভেতর বেডরুমেও আমাদের নিরাপত্তা নেই। আমরা রাজনৈতিক বিভেদে পড়ে একে অপরের শত্রুতে পরিণত হয়েছি। ফলে আমরা পালাক্রমে একদল অপর দলকে বিনাশের চেষ্টায় আছি।
দেশবাসী বা গোটা মানবজাতির যখন এই অবস্থা তখন কে নারী আর কে পুরুষ সেটা ভাবার সময় নেই। প্রত্যেকের দায়িত্ব হয়ে পড়েছে যার যার অবস্থান থেকে এ অবস্থা উত্তরণে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া। পুরুষের পাশাপাশি হেযবুত তওহীদের নারীরা সেটাই করছে। যারা নারীদেরকে সহ্য করতে অভ্যস্ত নয় তাদের চোখে অবশ্য হেযবুত তওহীদের পুরুষদের কোনো অবদানই চোখে পড়ে না। তারা মনে করে হেযবুত তওহীদ কেবল একটি নারী সর্বস্ব দল। এ ধরনের মানুষের ভাবনা নিয়ে ভেবে অবশ্য লাভ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, নারীরাই বা কেন মাঠে ঘাটে পুরুষের পাশাপাশি বেরিয়ে পড়লো?
যারা মানবজাতির বিপদ আঁচ করতে পারেনি, দাজ্জালকে চেনেনি, যারা ধর্মীয় উপাসনালয়ের চার দেয়ালের ভেতর থেকে নিজেদের দৃষ্টি বাইরে পর্যন্ত বিস্তৃত করতে পারেনি, তারা মসজিদ- মাদ্রাসা কিংবা হুজরার জানালা দিয়ে মুখ বের করে নারীরা কেন মাঠেঘাটে সেই প্রশ্ন তুলতেই পারে। কিন্তু বাস্তব জগতের সাথে সম্পর্ক রাখেন তারা এই প্রশ্ন না করে এই আত্মত্যাগী নারীদেরকে ধন্যবাদ জানাতে বাধ্য হবেন। সেলুট জানাবেন। তারা বুঝতে সক্ষম হবেন এই নারীরা নিজেদেরকে অন্যের সামনে প্রদর্শন করতে বের হননি, তারা বের হয়েছেন এই মুহূর্তে নিজেদের ঈমানী দায়িত্ব পালনের মহান ব্রত নিয়ে। যে নারীরা পথে নেমেছেন তারা মনে করছেন তারা এক বিশাল সংগ্রামে অংশ নিচ্ছেন। এদের মাঝে সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরা যেমন রয়েছেন, রয়েছেন বয়স্ক নারীরাও। রাস্তায় বের হলে সব ধরনের টিটকিরি, মানুষের বাঁকা দৃষ্টি ও উপেক্ষা সহ্য করার মানসিকতা নিয়েই তারা নেমেছেন। যদি এ কাজকে তারা নিজেদের কর্তব্য বলে জ্ঞান না করতেন তবে প্রচুর অর্থ কেন, কোনো কিছুর বিনিময়েই তাদেরকে মাঠে নামানো যেত না। অন্যদিকে যারা প্রশ্ন তুলছেন ‘নারীরা’ কেন মাঠেঘাটে- মূলত সেই অংশটারই মাঠে থাকার কথা ছিল। কিন্তু তারা মাঠে-ঘাটে নেই। তারা যদি মাঠে থাকত তবে আজকে মানবজাতির এই হাল হতো না এবং নারীদেরকেও মাঠে নামতে হতো না। যেহেতু তারা নিজেদের দায়িত্ব পালনে মাঠে নেই সেহেতু তাদের এই প্রশ্ন করাও মানায় না।
এই যে সঙ্কটের মুহূর্ত, এই যে বিপদের ক্ষণ, এটা একটা যুগসন্ধির কাল, একটা স্পর্শকাতর সময়। এ ধরনের যুগসন্ধিক্ষণে ভুল সিদ্ধান্ত নিলে সেই ভুলের মাশুল আর দেওয়া সম্ভব হয় না। কথায় আছে, সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়। শাস্ত্রকানারা পর্দার কথা তুলবে। তারা নারীদেরকে ঘরে আবদ্ধ থাকার কথা বলবে। নাকমুখ, হাতমোজা, পা মোজা পরে বসে থাকার কথা বলবে। কিন্তু এসবের পরেও কি তারা নারীদের সুরক্ষিত থাকার গ্যারান্টি দিতে পারবে? না, পারবে না। তারা যদি মুখে মুখে রক্ষা করার দাবিও করে, তবুও তাদেরকে বিশ্বাস করতে নেই। তারা স্বভাবে ঘরকুনো কাপুরুষ, অন্তর্মুখী। তাদের চরিত্র বীরের চরিত্র নয়। ইরাকেও তাদের চাইতে ভালো ধার্মিক ছিল, সিরিয়ায়ও ছিল। ইরাকের নারীরা, সিরিয়ার নারীরা আমাদের দেশের নারীদের থেকেও অনেক বেশি পর্দানশিন ছিল। কিন্তু তাদের পুরুষরা তাদেরকে রক্ষা করতে পারেনি। এরাও পারবে না। সুতরাং নারীদের চিন্তা নারীদেরকেই করতে হবে। আজকে গুটিশুটি হয়ে ঘরে বসে থাকলে কাল ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাবে। সিরিয়া, লেবাননের অধিবাসীরা যেমন পালিয়ে বাঁচার জন্য বাধ্য হয়েছে ভূমধ্যসাগরে ছোট ছোট নৌকায় উঠতে, ডুবে মরতে, ইউরোপের দেশগুলোতে অমানবিক জীবনযাপ করতে, তেমনি আমাদের নারীদেরকেও বঙ্গোপসাগরে নামতে হতে পারে। সুতরাং ঘর থেকে যেহেতু বের হতেই হবে, বের না হলে ঘর থেকে জোর করে বের করা হবে সেহেতু আগেই বেরিয়ে যদি বাঁচা যায়, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে জাগানো যায় তবে সমস্যা কোথায়?
নারীদের ভয় কাঠমোল্লাদের ফতোয়ার, কোর’আন থেকে পর্দার আয়াত শোনানোর? আয়াত শোনাক ভালো কথা। কিন্তু তাদের ব্যাখ্যায় কান না দিলেও চলবে। কোর’আনের আয়াত অনুযায়ী নারীদের বাইরের জনসমাগমে চলায় নিষেধাজ্ঞা নেই। শ্লীল পোশাক পরে তারা বাইরে যেতে পারে। রসুলাল্লাহর জীবদ্দশায় এবং তার পরেও নারীরা যুদ্ধের ময়দানে দ্বিতীয় সারিতে প্রস্তুত থাকতেন, শত্রুদেরকে তাঁবুর খুঁটি দিয়ে পেটাতেন। কোনো কারণে মুসলিম সৈন্যরা পিছু হটলে তাদেরকে আঘাতের ভয় দেখিয়ে আবার ময়দানে ফেরত পাঠাতেন। ইসলামের ইতিহাসে যুদ্ধের ময়দানে নারীদের এমন এমন ভূমিকা রয়েছে যেগুলো জানলে কোনোভাবেই মনে হবে না যে- ইসলাম কেবল নারীকে অন্তঃপুরের বাসিন্দা বানানোর কথা বলে। তবে এর মানেই এই নয় যে জাহেলিয়াতের মতো এখন নারীদেরকে বেহায়াপনায় জড়াতে হবে। আল্লাহ অশ্লীলতা ও বেহায়াপনাকে নিষেধ করেছেন। তবে দীনের পথে সংগ্রামে তিনি নিষেধাজ্ঞা দেননি। সেখানে নারী-পুরুষ সকলের প্রতি দায়িত্বের কথা তুলে ধরেছেন। তাছাড়া বুঝতে হবে এটা স্বাভাবিক সময় নয়, এটা জরুরি সময়, অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্নের সময়। এই মুহূর্তে পর্দার নামে বাড়াবাড়ি করা অনুচিত। তারপরও যদি এই মহৎ সংগ্রামে নেমে একটু এদিক সেদিক যদি হয়েও যায়, তবে অবশ্যই আল্লাহ ক্ষমাশীল, গাফুরুর রহিম।
অগ্রগামী নারীদের কটূক্তিকারীদেকে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত, ইসলামের প্রত্যেকটা বিধানের একটা সময় থাকে, পরিপ্রেক্ষিত থাকে। এমনকি মানুষের তৈরি বিধানেও জরুরি অবস্থায় সংবিধানের আইন অকার্যকর থাকে। মৌলিক অধিকারও সীমিত রাখা হয়। শুধু মুসলমান জাতি নয়, গোটা মানবজাতিই আজ সেই জরুরি অবস্থা, যুগসন্ধিক্ষণের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তাহলে নারীরা কেন ঘরে বসে থেকে আত্মহননের পথ বেছে নেবে? কেন তাদের কথার কারণে চেষ্টা-প্রচেষ্টা পরিত্যাগ করে জাতির অর্ধেক শক্তি হ্রাস করবে? এখন সেই সময় যখন নারী এবং পুরুষ উভয়ের সম্মিলিত সংগ্রাম চলবে, সর্বশক্তি দিয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এই মুহূর্তে এটায় সকলের ঈমানী দায়িত্ব।