মো. মশিউর রহমান:
মাদকে বুঁদ হয়ে যাচ্ছে তরুণ প্রজন্ম, আর সেই সাথে ক্ষয়ে যাচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ প্রাণশক্তি। মাদকের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন হচ্ছে, টিভি অনুষ্ঠান হচ্ছে, পত্র-পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে, ওয়াজ-নসিহতে ধর্মীয় উপদেশবাণী প্রচার করা হচ্ছে। সামাজিক, পারিবারিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মাদক কী কী ক্ষতি বয়ে আনে সেগুলো তরুণ প্রজন্মকে শেখানোর চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই যেন মাদকের সর্বনাশা বিস্তার রুদ্ধ হবার নয়। সমস্ত শুভ প্রচেষ্টাই ব্যর্থতার অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশ হয়ে উঠছে মাদকের অভয়ারণ্য। ইতোমধ্যেই তরুণ প্রজন্মের বড় একটি অংশ মাদকের খপ্পরে পড়ে গেছে। বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি, সামাজিক অস্থিরতা। একবার মাদকাসক্ত হলেই আর রক্ষা নেই। মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে না শাস্তি দিয়ে ফেরানো যায়, না বুঝিয়ে ফেরানো যায়। মাদকের টাকা যোগাড় করতে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও রক্তপাতে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও অহরহ ঘটছে, যার কোনো সুরাহা খুঁজে পাওয়া এক প্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনিতেই বহুবিধ সঙ্কটে জর্জরিত আমাদের সমাজ। এর মধ্যে কিছু আছে ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্কট, কিছু পারিবারিক জীবনের সঙ্কট, কিছু সামাজিক জীবনের সঙ্কট, আবার কিছু রাজনৈতিক অঙ্গনের সঙ্কট।কিন্তু ‘মাদক’ এমন এক সঙ্কট হয়ে দাঁড়িয়েছে যা কেবল ব্যক্তিগত বা সামাজিক বা পারিবারিক বা রাজনৈতিক বৃত্তেই সীমাবদ্ধ নেই, একইসাথে এই ব্যাধি আমাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র- সবকিছুকেই ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে। অতীতে অধঃপতিত হওয়া সমাজ ও সভ্যতাগুলোর ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তাদের পতনের অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে মাদক। আমাদের সমাজেও যেন ওই আলামত প্রকট হয়ে উঠছে।
মানুষকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন অসম্ভব মেধা, চিন্তাশক্তি ও সৃজনশীল ক্ষমতা দিয়ে। মানুষ ভাববে তার নিজের সত্ত্বাকে নিয়ে, সমাজ নিয়ে, রাষ্ট্র নিয়ে, বিশ্ব নিয়ে। তাকে কেন সৃষ্টি করা হয়েছে, পৃথিবীতে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য কী, তার জীবনের সার্থকতা কোথায় ইত্যাদি জেনে সে তার সত্ত্বাকে উৎসর্গ করবে জগতের কল্যাণের জন্য। তার জীবন হবে প্রচণ্ড গতিশীল, পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল। মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা অর্থাৎ স্রষ্টার দেওয়া জ্ঞান-বুদ্ধি-শক্তি ব্যবহার করে সে তার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলবে দুর্দান্ত গতিতে। কিন্তু যখন কোনো সমাজ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, ওই সমাজের মানুষগুলো তাদের জীবনের লক্ষ্য হারিয়ে ফেলে। তারা বেঁচে থাকে পশুর মত। সমাজ হয়ে পড়ে স্থবির, অনুৎপাদনশীল ও চলৎশক্তিহীন। মাকড়শার জালে আটকা পড়া পতঙ্গের ন্যায় কেবল মৃত্যুর দিন গোণা ছাড়া মাদকাসক্ত ব্যক্তি ও জাতি দিয়ে বড় কোনো লক্ষ্য অর্জিত হয় না। মাদকে আসক্ত দেহ, মন ও মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়, চিন্তাশক্তি লোপ পায়। তারা হয়ে পড়ে সমাজের বোঝা। ওই বোঝা নিয়ে কোনো জাতিই খুব বেশিদূর অগ্রসর হতে পারে না।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে মাদকটি ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছে গেছে সেটা হচ্ছে ইয়াবা। কোটি কোটি ইয়াবা ট্যাবলেট ছড়িয়ে আছে দেশব্যাপী, রাজধানী থেকে প্রত্যঞ্চ গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত গড়ে উঠেছে শক্তিশালী ইয়াবার সিন্ডিকেট। এই মাদকের পাচার, পরিবহন ও সরবরাহের সাথে জড়িয়ে আছে দেশের ভেতরের ও বাইরের প্রভাবশালী মহল। গত পাঁচ বছর ৩ মাসে সারা দেশে ৭ কোটি ২ লাখ ২৮ হাজার ৬৩৫ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট কেবল জব্দই হয়েছে। (তথ্যসূত্র: যুগান্তর) বিপুল পরিমাণ এই ইয়াবা ছাড়াও গত সোয়া ৫ বছরে হাজার হাজার কেজি হেরোইন, আফিম, গাঁজা, কোকেন, বিয়ার, ক্যান, বিদেশি মদ, ফেনসিডিল, দেশি মদ ও নেশাজাতীয় ট্যাবলেট-ইনজেকশন জব্দ করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশ, র্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অন্যান্য বাহিনী বিভিন্ন সময় এসব মাদকদ্রব্য উদ্ধার করে। এতেই বোঝা যায় প্রতি বছর কী ভয়াবহ পরিমাণ মাদক দেশে প্রবেশ করছে ও তরুণ প্রজন্মের হাতে হাতে পৌঁছে যাচ্ছে।
মাদকের বিস্তার কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না?
মাদকের বিরুদ্ধে এত প্রচার-প্রচারণা ও আইনী পদক্ষেপ সত্তে¡ও মাদকের ভয়াবহ বিস্তার রোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই মাদকের সাথে সম্পৃক্ত, মাদকব্যবসায়ী ও মাদকসেবীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, আদালতে চালান দেওয়া হচ্ছে। গত ৫ বছরে সারা দেশে ৩ লাখের বেশি মাদকের মামলা হয়েছে। এই সময়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৬৭৫ জন মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ী। র্যাব গ্রেফতার করেছে ১৯ হাজার ৪৭৬ জনকে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন ২০ হাজার ৪০৭ জন মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবী। বাকিরা গ্রেফতার হয়েছেন বিজিবিসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অন্য ইউনিটের হাতে। কিন্তু এত গ্রেফতার, মামলা ও ধর-পাকড়েও যখন কিছু হচ্ছে না, ক্রমেই মাদকে ছেয়ে যাচ্ছে সারা দেশ, এমনি বাস্তবতায় আমাদের সরকার শুরু করেছে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ শীর্ষক এই অভিযানের একদিকে রয়েছে সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকবিরোধী জনগণ আর অন্যদিকে হলো মাদকব্যবসায়ী, চোরাকারবারী ও মাদক সেবনকারীরা। ইতোমধ্যেই তাতে শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। কিন্তু এ যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত মাদকসঙ্কটে সাময়িক নিয়ন্ত্রণ এলেও পুরোপুরি সমাজ থেকে মাদক নির্মূল হয়ে যাবে এমন দাবি হয়ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও করবেন না। এই তো চলতি বছরের শুরুতেই পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বললেন, ‘মাদক নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না।’ এর কারণ হিসেবে তিনি দুইটি বিষয়কে সামনে আনেন। প্রথমত মাদক একটি আসক্তি। জেল-জরিমানা করে আসক্তি দূর করা যায় না। দ্বিতীয়ত, মাদক আসছে প্রতিবেশী দেশ থেকে। প্রায় একশ’ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে। এছাড়াও মাছের নৌকায়, সবজির নৌকায় মাদক চলে আসে। এটা প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আসলে শুধু বাংলাদেশ দিয়ে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এটা প্রমাণিত সত্য যে, শুধু শক্তি প্রয়োগ করে সমাজ থেকে মাদক নির্মূল করা কোথাও সম্ভব হয়নি বা হচ্ছে না।
দেশে দেশে মাদকবিরোধী যুদ্ধ
প্রায় ৫০ বছর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন শুরু করেছিলেন মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সেই যুদ্ধ গত প্রায় ৫ দশকে আরও বিভিন্ন দেশে বিস্তার লাভ করে। কিন্তু এই মাদকবিরোধী যুদ্ধে কখনই কাক্সিক্ষত সফলতা আসে নি। ২০১১ সালে গ্লোবাল কমিশন অন ড্রাগ পলিসি মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, বিশ্বের মাদকবিরোধী যুদ্ধগুলো ব্যর্থ হয়েছে এবং এই ব্যর্থতা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তি ও সমাজের বিপর্যয় ডেকে এনেছে। মাদকের বিরুদ্ধে ও মাদকের কারণে কলম্বিয়ায় গত তিন দশকের যুদ্ধে দেশটিতে যত সংখ্যক মানুষ নিহত হয়েছেন তা অন্য কোনও দেশে ঘটেনি। ১৯৯০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত দেশটিতে মাদক সংশ্লিষ্ট হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা সাড়ে চার লাখ ছাড়িয়েছে। কিন্তু এত প্রাণহানির পরেও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, ওই অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। এদিকে মেক্সিকোতে ২০০৬ সালে মাদকবিরোধী যুদ্ধে নামানো হয় সেনাবাহিনীকে। তারপর থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার। ব্রাজিলেও ১৯৭০-এর দশকে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয়, যা কোনো সাফল্যের মুখ দেখেনি। আর ফিলিপাইনের মাদকবিরোধী যুদ্ধ তো একেবারেই সাম্প্রতিক ঘটনা। ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে। তার এই যুদ্ধে নিহতের সঠিক সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সংখ্যাটি তিন হাজার ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু এত হত্যাকাণ্ডও ফিলিপাইনের মাদকের প্রাদুর্ভাব এক রত্তি কমাতে পারেনি। এখনো ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা মাদকের স্বর্গরাজ্য। হেন মাদক নেই যা সেখানে সহজলভ্য নয়।
আসলে আমরা যদি মাদক সমস্যার গভীরে নজর দিই তাহলে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত মাদকের শক্তিশালী সিন্ডিকেট দেখতে পাই। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ইচ্ছে করে মাদকের বিশ্বায়ন ঘটাচ্ছে, এমনকি মাদকের আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ নিতে তাদের মধ্যে বড়সড় যুদ্ধও হয়েছে অতীতে। যেমন আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে যে মাদকের চাষ হয়, তার উপর প্রথমে ছিল রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ। অনেকের ধারণা রাশিয়ার হাত থেকে ওই মাদক বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিতে আফগান যুদ্ধের শুরু করেছিল সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমারা। কাজেই যেখানে বিশ্বের পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো মাদককে প্রণোদনা দেয়, মাদকব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে কাড়াকাড়ি করে সেখানে কোনো একটি দেশের ভেতরে কোনো একটি এলাকায় ওই দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান চালিয়েই মাদকের শেকড় উপড়ে ফেলবে এমনটা আশা করার সুযোগ থাকে না।
ভারতবর্ষে ব্যাপকভাবে আফিম চাষ ও আফিম ব্যবসা চালু করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ব্রিটিশরা চীনদেশকে সামরিক শক্তিবলে দখল করতে ব্যর্থ হলে চীনের সমাজকাঠামো ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রস্বরূপ ভারতবর্ষে আফিম উৎপাদন করে চীনে চালান দিতে থাকে। ওই সময়ে তারা স্থানীয়ভাবে বিক্রির জন্যও আফিমের দোকান চালু করে যেন ভারতবর্ষেও মাদকের বিস্তার ঘটিয়ে পদানত ভূখণ্ডে অধিবাসীদেরকে শারীরিক, আধ্যাত্মিক ও নৈতিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া যায়, তাদের প্রাণশক্তি ধ্বংস করে ফেলা যায় এবং তার ফলে কোনোদিন প্রভু ব্রিটিশের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বিপ্লবী চেতনায় মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। তেমনিভাবে আজ আমাদের এই ১৬ কোটির বাংলাদেশকে নিয়েও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গভীর কোনো ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে কিনা অর্থাৎ বাংলাদেশে মাদকের বিস্তার ঘটিয়ে কোনো সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি ফায়দা লোটার অপচেষ্টা চালাচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখার অবকাশ রয়েছে। যদি তা-ই সত্য হয় তাহলে আরও ভয়াবহ পরিণতির জন্য আমাদেরকে প্রস্তুত থাকতে হবে, কারণ ইতোমধ্যেই তাদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে আটকে গেছে আমাদের সমাজ। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক মাদকব্যবসায়ীদের সাথে শক্তিশালী লিয়াজুঁ তৈরি হয়েছে দেশের ভেতরের মাদক কারবারীদের। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর আমাদের দেশের মাদক গডফাদারদের একটি তালিকা প্রণয়ন করে। দেশজুড়ে যার সংখ্যা ১৪১ জন। এতে ক্ষমতাধর অনেক রাজনীতিকের ভয়ংকর কুৎসিত চেহারা বেরিয়ে এসেছে। তবে শুধু রাজনৈতিক নেতাই নয়, অনেক বড় বড় ব্যবসায়ীদেরও নাম রয়েছে ঐ মাদক গডফাদারদের নামের তালিকায়। প্রকাশ্যে সবাই মাদকের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললেও লোকচক্ষুর আড়ালে মাদকের রমরমা প্রসার ঘটিয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠছে অনেকেই। তারাই আবার রাজনীতিতে জড়িত হয়ে ব্যাপক ক্ষমতার অধিপতি হয়ে উঠছে, কিংবা পয়সা ঢেলে ক্ষমতাবানদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে প্রশাসনের নাকের ডগাতেই মাদকব্যবসা ও চোরাচালান চালিয়ে যাচ্ছে। এদের মোকাবেলায় সাধারণ জনগণ দূরে থাক, প্রশাসনও অসহায়। পরিহাসের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় যখন প্রশাসনের অনেক সদস্যও মাদকব্যবসার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত হয়ে যান! এক কথায় হাজার হাজার মানুষের বহুমুখী স্বার্থ জড়িয়ে পড়েছে এই মাদকের সাথে, বিষবৃক্ষের শেকড় চলে গেছে অনেক গভীরে, যা উপড়ে ফেলা এক প্রকার দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এত প্রচার-প্রচারণা, এত জেল-জরিমানা, এত অভিযান ব্যর্থ হবার পর আমরা কি তবে আত্মসমর্পণ করে নিব মাদকের কাছে? না, তা করতে হবে না, কারণ কার্যকরী উপায় আছে এবং সেই উপায় জানাতেই এই লেখার অবতারণা। তবে তার আগে আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা সত্যিই মাদকের অভিশাপ থেকে যে কোনো মূল্যে সমাজকে মুক্ত করতে চাই কিনা।
মাদক নির্মূলে করণীয়
আইয়্যামে জাহেলিয়াতের আরব সমাজের কথা আমরা সবাই জানি। ওই সময়ের সবচাইতে বর্বর, অসভ্য, হানাহানি, রক্তারক্তিতে নিমজ্জিত, মাদকসঙ্কটে জর্জরিত আরবে আবিভর্‚ত হয়েছিলেন আল্লাহর রসুল মোহাম্মদ (সা.)। অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাত, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অশ্লীলতা ইত্যাদির মত মাদকও ছিল ওই সমাজের একটি বড় ব্যাধি। মানুষ মদ খেয়ে অচেতন হয়ে রাস্তাঘাটে পড়ে থাকত, মাতলামী করে বেড়াত। এটাকে কোনো অন্যায়ই মনে করা হত না। প্রত্যেক পরিবারেই মাদকের সাথে সংশ্লিষ্ট কাউকে না কাউকে পাওয়া যেত, আর ওই মাদকের বেনিফিশিয়ারি হত তৎকালীন সমাজের হর্তাকর্তা ওতবা, শায়বা, আবু সুফিয়ানরা। আরবের অন্ধত্ব, চিন্তা-চেতনায় স্থবিরতা, জ্ঞান-বিজ্ঞানবিমুখতার পেছনে ভ‚মিকা ছিল মাদকের। রসুল (সা.) কী করলেন? তিনি কিন্তু তৎকালীন জনসাধারণকে ওয়াজ করে করে মাদকের কুফল শিক্ষা দেননি। কারণ তিনি জানতেন এটা সমাধান নয়, যেহেতু এখানে বিরাট সিন্ডিকেট আছে, সমাজের উঁচু-নিচু সর্বমহলের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ জড়িত আছে এর সাথে, কাজেই রসুল একেবারে গোড়ায় হাত দিলেন। প্রচলিত ঘুনে ধরা সমাজব্যবস্থা পাল্টে ফেলে তওহীদভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সংগ্রামে নামলেন তিনি।
আল্লাহর রসুল দেখলেন বহুমুখী অন্ত্যহীন সঙ্কটে জর্জরিত তাঁর জাতি। আর সকল সঙ্কটের গোড়া প্রোথিত আছে একটি জায়গায়, ভুল জীবনব্যবস্থা। এই ভুল জীবনব্যবস্থাই হচ্ছে মূল ব্যাধি, আর অন্যান্য সঙ্কটগুলো তার বিভিন্ন উপসর্গমাত্র। আদতে আল্লাহকে একমাত্র ‘হুকুমদাতা’ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়ে আল্লাহর দেওয়া সত্যদ্বীন কার্যকর করাই সকল সঙ্কটের একমাত্র সমাধান। এই সত্যটি আল্লাহর রসুল জাতির সামনে তুলে ধরলেন এবং বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তাঁর অবিরাম সংগ্রামের একটি পর্যায়ে জাতি তাঁর বক্তব্য গ্রহণ করে নিল। তারা বুঝল মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন সফলতার জন্য যে হুকুম, বিধান অনুসরণীয় তা একমাত্র মানুষের স্রষ্টা আল্লাহ রব্বুল আলামিনের পক্ষেই তৈরি করা সম্ভব, কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়; কাজেই জীবনের যে কোনো অঙ্গনে আল্লাহ যেটাকে বৈধ করবেন আমরা সেটা গ্রহণ করব, আর আল্লাহ যেটাকে অবৈধ বলবেন সেটা প্রত্যাখ্যান করব।
এই যে সিদ্ধান্ত, এটাই ইসলামের কলেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম মানব না। এই সিদ্ধান্ত নেবার পর থেকেই ওই সমাজ পরিশুদ্ধ হতে লাগল। ধারাবাহিকভাবে পবিত্র কোর’আনের হুকুম-বিধান নাজেল হতে লাগল এবং জাতি একদেহ একপ্রাণ হয়ে সেই হুকুম কার্যকর করায় সমাজ থেকে মাদকসহ সমস্ত ক্ষতিকর জীবাণুগুলো মরে যেতে লাগল। যেহেতু জাতি আল্লাহর হুকুমের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ, কাজেই আল্লাহ যখন মদকে হারাম করলেন, নিশেষেই সেই হুকুম বাস্তবায়ন হয়ে গেল। পুলিশী অভিযান চালিয়ে মানুষের বাড়িঘর থেকে মাদক উদ্ধার করতে হলো না, বরং মানুষ নিজেরাই মদের পাত্র রাস্তায় ঢেলে দিয়ে রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত করে ফেলল। মুখে মদ ঢালতে যাচ্ছেন এমন সময় জানতে পারলেন কোর’আনের আয়াত, ব্যস, মদের পাত্র ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। লোকজন তাদের মদ খাওয়ার ‘বিশেষ পাত্র’ ভেঙ্গে ফেলল যাতে মদ খাওয়ার প্রতি কখনও আকাক্সক্ষাও না জন্মে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই জাজিরাতুল আরব মদ বা মাদকজাতীয় বস্তুর থাবা থেকে মুক্ত হয়ে গেলো।
একটি জীবনব্যবস্থা ফলপ্রসূ হয় কখন? যখন তাতে মানুষের দেহ-আত্মা ও দুনিয়া-পরকালের ভারসাম্য বজায় থাকে। আমাদের যে জীবনব্যবস্থা আমরা পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আমদানি করে নিজেদের উপর চাপিয়ে রেখেছি এতে কেবল একটি দিক আছে- দেহের দিক, বস্তুর দিক, ফলে এখান থেকে মানুষ পায় কেবল বস্তুবাদী শিক্ষা, আত্মা ও পরকালের দিক এখানে অনুপস্থিত। যে জীবনব্যবস্থা দিবারাত্রি মানুষকে শোখাচ্ছে ‘জীবন মানে খাও-দাও, আনন্দ-ফূর্তি করো, জৈবিক চাহিদা পূরণ করো’ সেই জীবনব্যবস্থার অধীন মানুষ অন্যায় করবে, মাদক খাবে, মাদকের ব্যবসা করবে, নয়ত মাদকের ব্যবসায় সাহায্য করবে এটাই স্বাভাবিক। পাশ্চাত্যের সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিণতিতে যখন একটি শ্রেণি ব্যাপক অর্থবিত্তের মালিক হয়ে গেল, আর বৃহত্তর জনসাধারণ শোষিত বঞ্চিত হতে লাগল, তখন ওই বঞ্চিতরা চেষ্টা চালাতে লাগলো কীভাবে অতি সহজ পন্থায় রাতারাতি অর্থবিত্তের মালিক হওয়া যায়। তাদের জন্য মাদকব্যবসা একটা সুবর্ণ সুযোগ হয়ে দেখা দিল। যেহেতু স্রষ্টাহীন জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, আল্লাহর ভয়ের প্রশ্ন আসে না, পরকালের জবাবদিহিতার প্রশ্ন আসে না, আইন দিয়েই সবকিছু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হয়, কাজেই আইনের চোখে ফাঁকি দিতে পারলেই বা নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে মনে করতে পারলেই সে দুরাচারী হয়ে ওঠে। কিন্তু আল্লাহর রসুল ১৪০০ বছর আগে যেই তওহীদভিত্তিক জীবনব্যবস্থা কায়েম করেন তা ছিল ভারসাম্যপূর্ণ। দেহ আত্মার ভারসাম্য, দুনিয়া পরকালের ভারসাম্য। ওই জীবনব্যবস্থা মানুষকে প্রথমেই শিক্ষা দিয়েছিল, ‘তুমি কে? তুমি কোথা থেকে এসেছো? কোথায় তোমার গন্তব্য? তোমার জীবনের সার্থকতা কোথায়?’ ফলে মানুষ যখন তাদের জীবনকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে শিখল, জীবনের সার্থকতা উপলব্ধি করল, তখন তারা নিজেরাই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মাদককে বয়কট করল। আজও যদি আমরা আল্লাহর হুকুমের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি, প্রচলিত বস্তুবাদী সমাজব্যবস্থা পাল্টে তওহীদভিত্তিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করতে পারি তাহলে আজও আমাদের সমাজ মাদকমুক্ত হতে বাধ্য।
আমরা এই যে সমাধানের উপায়টি তুলে ধরলাম, এটা উড়িয়ে দেওয়া যেত যদি কথাগুলো আমাদের অলীক কল্পনা হত, যদি ইতিহাসে এর কোনো নজির না থাকত। তা তো নয়। যে ব্যবস্থা অতীতে মানুষকে ভয়াবহ সঙ্কট থেকে মুক্তি দিয়েছে, তা আজকেও মুক্তি দিতে পারে। যে ওষুধ অতীতে রোগ সারিয়েছে তা আজও সারাতে সক্ষম, তাই নয় কি?
[লেখক: আমীর, হেযবুত তওহীদ। মতামতের জন্য যোগাযোগ: ০১৬৭০-১৭৪৬৪৩, ০১৬৭০-১৭৪৬৫১]