রিয়াদুল হাসান:
সাধারণ মানুষ ধর্ম সম্পর্কে বিশেষ অবগত থাকেন না। অন্যায়পূর্ণ সমাজে অশান্তির দাবানলে দগ্ধ হয়ে তারা যখন ইহজাগতিক ও পারলৌকিক মুক্তির আশায় ধর্মের দিকে ফিরে আসে তখন তারা শরণাপন্ন হয় ধর্মের কর্তৃপক্ষ সেজে থাকা সেই শ্রেণিটির যারা ধর্মকে স্বার্থের হাতিয়ারে পরিণত করেছে, ধর্মকে পণ্য বানিয়ে ব্যবসা করছে, ধর্ম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে, ধর্মকে ক্ষমতায় আরোহণের সিঁড়ি বানিয়ে প্রতিনিয়ত মাড়িয়ে যাচ্ছে। তারা নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে ধর্মের ব্যাখ্যা প্রদান করে ধর্মপ্রাণ মানুষদেরকে প্রতিনিয়ত বিপথগামী করছেন, প্রতারিত করছেন। তারা যেটাকে ইসলাম বলে উপস্থাপন করেন সেটাকেই মানুষ আল্লাহ-রসুলের কথা হিসাবে শিরোধার্য বলে মনে করে। কেবল স্বার্থের জন্য তারা বহু গুরুত্বহীন বিষয়কে ইসলামের অপরিহার্য বিষয় বানিয়ে দেন, আবার মহাগুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে একেবারে বাদই দিয়ে দেন।
তাদের প্রতি অন্ধবিশ্বাস থাকায় জনগণ প্রতারিত হয়, তারা বুঝতে পারে না ধর্মব্যবসায়ীরা ইসলামের যে রূপ তাদের সামনে তুলে ধরছে সেটা একান্তই তাদের মনগড়া অপব্যাখ্যা। ভোক্তার চাহিদা মোতাবেক যেমন পণ্যের গুণাগুণ, আকার, আকৃতি, মোড়ক বিভিন্ন হয়, তেমনি ইসলামেরও বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হয়। এসব ব্যাখ্যা নিয়ে তারা নিজেরাই হাজারো ভাগে বিভক্ত। আল্লাহ রসুলের ইসলাম তো বর্তমানের মতো এত হাজার ফেরকা, মাজহাব, তরিকায় বিভক্ত ছিল না। এক আল্লাহ, এক রসুল, এক কেতাব, এক জাতি- এই ছিল প্রকৃত ইসলামের বৈশিষ্ট্য। সেই ইসলাম অর্ধ পৃথিবীর মানুষকে অনাবিল শান্তি, নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি, প্রগতি ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছিল। সেই ইসলাম আজ হারিয়ে গেছে। সেই ইসলামের নাম ভাঙিয়ে খাওয়া হচ্ছে মাত্র। বিভিন্ন ধরনের ধর্মব্যবসায়ী সুবিধামাফিক ধর্মকে ব্যবহার করছে কিন্তু চরিত্রে একে ধারণ করছে না।
রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভোটের স্বার্থে ধার্মিকতার ভান ধরছেন, ধর্মব্যবসায়ীদের অন্যায় দাবির কাছে মাথা নুইয়ে দিচ্ছেন, কেউ বা বলছেন অমুক মার্কায় ভোট দিলে জান্নাত নিশ্চিত। কেউ ধর্মের মোড়কে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটিয়ে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের অস্ত্রের বাজার সৃষ্টি করে দিচ্ছেন। মানুষের ধর্মবিশ্বাস, ধর্মীয় চেতনা একটি মহাশক্তি। যে কোনো শক্তিরই সুফল ও কুফল নির্ভর করে তার ব্যবহারের উপর। যারা ধর্মকে নিজেদের কুক্ষিগত করে নিয়েছে তারা সর্বপ্রথম যে কাজটি করেছে তা হলো, তারা মানুষের চিন্তার জগতে তালা মেরে দিয়েছে এই বলে যে ধর্মের কোনো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। ধর্মের নির্দেশের ব্যাপারে কোনো যুক্তি চলবে না। মানুষ শ্রেষ্ঠ হয়েছে মস্তিষ্কের গুণে, আর ধর্মের ধ্বজাধারীরা সেই মস্তিষ্কের ঘরে তালা দিয়ে মানুষকে চিন্তাহীন, যুক্তিবোধহীন, ক‚পমЂক, পশু বানিয়ে ফেলতে চায়। এভাবেই মুসলিম জাতি আজ পৃথিবীর সবচেয়ে পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী। কোনটা ভালো কোনটা মন্দ এটা বোঝার সাধারণ জ্ঞান তাদের ধার্মিকদের লুপ্ত হয়ে গেছে।
আল্লাহর রসুল যে জাতিটির মধ্যে আগমন করেছিলেন সেই জাতিটিও ছিল প্রায় চিন্তাশক্তিহীন। তাদের মস্তিষ্কের ঘরেও তালা মেরে রেখেছিল কাবাকেন্দ্রিক ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী। তা না হলে কি আর মানুষ হয়ে কেউ কাঠপাথরের মূর্তির কাছে প্রার্থনা করে? তাদের এই অজ্ঞানতা এতদূর গিয়েছিল যে, তাদের যুগটাকে ইতিহাসের পাতায় আইয়্যামে জাহেলিয়াত বা অজ্ঞানতার যুগ বলে আখ্যায়িত করা হয়। শিক্ষা-দীক্ষা জ্ঞান-বিজ্ঞানের লেশমাত্রও তাদের মধ্যে ছিল না, তারা ছিল হাজারো অপসংস্কৃতি ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। সর্বদিক থেকে যখন একটি জাতি নিকৃষ্ট জাতিতে পরিণত হয় তখন সেখান থেকেই আল্লাহ সত্যের উত্থান ঘটান। এভাবেই আল্লাহ তাঁর কুদরত, মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন রেখে যান। আল্লাহ তাঁর শ্রেষ্ঠ নবীকে সেই আরব জাতির মধ্যে প্রেরণ করলেন। হেরাগুহায় তিনি তখন ধ্যানমগ্ন ছিলেন, কী করে মানুষের ইহকাল ও পরকালের মুক্তি মিলবে, কী করে মানবজাতিকে এই অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মুক্ত করা যায়, কী করে সমাজের অন্যায় অশান্তি দূর করা যায়, মানবজীবনের সঠিক তাৎপর্য কোথায় এই জিজ্ঞাসাগুলোর জবাব তিনি দিবানিশি তালাশ করতেন। একদিন এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। জিব্রাইল আমিন আবিভর্‚ত হলেন সেই হেরাগুহার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। বললেন, হে মোহাম্মদ (সা.) পড়ো – ইক্বরা। নবী করিম (সা.) বললেন, “আমি তো পড়তে পারি না।” জিব্রাইল আবারও বললেন, “পড়ো।” তিনি আবারও বললেন, “আমি তো পড়তে পারি না।” এভাবে তিনবার তিনি অপরাগতা প্রকাশ করার পর জিব্রাইল আমিন তাঁকে আলিঙ্গন করলেন। রসুলাল্লাহর হৃদয় উন্মোচিত হলো, জ্ঞানজগতের সমস্ত অর্গল এক নিমেষে যেন মুক্ত হয়ে গেল। মুক্তির পথ তাঁর সামনে দৃশ্যমান হলো। “ইক্বরা” অর্থ পড়ো। পড়া হয় কেন? জানার জন্য, জ্ঞান আহরণের জন্য। সুতরাং মানবজাতির প্রতি আল্লাহর শেষ কেতাবের প্রথম হুকুমটিই হলো – “জানো”। শত শত যুগসঞ্চিত অজ্ঞানতার সকল আবর্জনাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল এই একটি শব্দ। সেই মূর্খ অশিক্ষিত আরব জাতি, যারা কাঠ পাথরের মূর্তির পায়ে সেজদা করে থাকতো তারা উদার আকাশের দিকে চোখ মেলে চাইল। তারা উন্নত এক সভ্যতার নির্মাণ করল যা পৃথিবীর সকল জাতির চোখ বিস্ফোরিত করে দিল। কী সামরিক শক্তি, কী অর্থনৈতিক শক্তি – সর্বদিকে তারা হলো শ্রেষ্ঠ জাতি। জ্ঞানবিজ্ঞানের সকল শাখায় তারা ছুটিয়ে দিল বেগবান আরবীয় ঘোড়া। সকল জাতির শিক্ষকে পরিণত হলো মুসলিম জাতি। তখন আর তারা কেবল আরব নয়, অর্ধদুনিয়া তাদের পায়ের নিচে। এই যে রেনেসাঁ, নবজাগরণ রসুলাল্লাহ ঘটালেন এর মূলসূত্র নিহিত ছিল ঐ ইক্বরা শব্দটির ভেতরে, মগজ খোলো মানুষ, চিন্তা করো, দেখো, জানো, শোনো। মিথ্যা ধর্মের মোহে বুঁদ হয়ে থেকো না, স্বার্থের গোলাম হয়ে থেকো না, তুমি আর দশটা জানোয়ারের মতো নও। তোমার মস্তিষ্ক অসাধারণ। তাকে কাজে লাগাও।
আজ আবার অধঃপতিত মুসলিম জাতি সেই জাহেলিয়াতের যুগে ফিরে গেছে। আজ তাদের প্রভু পশ্চিমা সভ্যতা, পশ্চিমাদের বৈজ্ঞানিক সামরিক অর্থনৈতিক প্রযুক্তিগত অগ্রগতি তাদের সামনে এক বিস্ময়। তারা বোয়াল মাছের মতো হা করে তাদের সেই উন্নতির পানে তাকিয়ে থাকে। তাদের আলেম ওলামারা নারীর পর্দা সংক্রান্ত ওয়াজ নিয়ে মহাব্যস্ত। আর ব্যস্ত নিজেদের মধ্যে ক‚টতর্কে, যার যার ফেরকা মাজহাবের শ্রেষ্ঠত্ববর্ণনে। অজ্ঞতার সীমাহীন পাথারে ঘুরপাক খাচ্ছে একদা শ্রেষ্ঠ জাতি মুসলমান। তাদের মস্তিষ্কের ঘরে ঝুলছে তালা। তারা ধর্মান্ধতায় আচ্ছন্ন, তাদের এই ধর্মবিশ্বাসকে টেনে নিয়ে কেউ জঙ্গিবাদে কাজে লাগাচ্ছে, কেউ বা লাগাচ্ছে ধর্মব্যবসায়। তাদের এই ঈমানকে, ধর্মকে যদি এখন মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় সবার আগে মানুষের চিন্তা করার শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে হবে, অচল মস্তিষ্ককে অর্গলমুক্ত করতে হবে। যতদিন ইসলামের কর্তৃত্ব, ধর্মানুভ‚তির নিয়ন্ত্রণ ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে থাকবে ততদিন মুসলিমদের সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আশা দুরাশা। ততদিন ইসলাম কোনো জীবিত মানুষের কল্যাণে আসবে না, মৃত মানুষের কল্যাণেও আসবে না।
[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট; ফেসবুক: riad.hassan.ht]