হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা আমাদেরকে মামলাবাজিতে লিপ্ত করে দিয়ে গেছে। সেই থেকে মামলা মোকাদ্দমার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পেতে মামলা এখন আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। গ্রামীণ মানুষের জীবনও এখন মামলায় জর্জরিত। যে গ্রামের মানুষ আগে কোনোদিন পুলিশ দেখেনি সেই গ্রামেও এখন শত শত মামলা। আমি বাংলাদেশের একটি সীমান্তবর্তী জেলায় গিয়েছি। জেলার নাম সুনামগঞ্জ। শহরের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম সব সুনসান, মনে হলো এখানে কোন মানুষ থাকে না। কিন্তু যখন আমি আদালতের সামনে গিয়েছি তখন আমার ভুল ভাঙল। দেখি হাজার হাজার মানুষ আদালতের প্রাঙ্গণে ভীড় করে আছে। অন্যান্য কর্মব্যস্ততায় মানুষ নেই, সব মানুষ যেন আদালতে গিয়ে বসে আছে। সবাই মামলায় জর্জরিত। কারো রাজনৈতিক মামলা, কারো জায়গা-জমির মামলা, কারো শত্রুতামূলক মিথ্যা মামলার বোঝা বহন করতে হচ্ছে। একটি জাতির প্রাণশক্তি হচ্ছে তার ঐক্যের বন্ধন। বর্তমানে আমরা যে জীবনব্যবস্থা অনুসরণ করছি সেটা আমাদের এই ঐক্যের বন্ধনকে শত-সহ¯্র উপায়ে কেটে দিচ্ছে। তারপরে এই সিস্টেমগুলোকে পরিচালনা করতে সরকারকে বহন করতে হচ্ছে অকল্পনীয় ব্যয়। সরকারের কাছে জনগণের দাবি আকাশসমান। সরকারের সার্বক্ষণিক মনযোগ ব্যয়িত হচ্ছে শত্রু পক্ষ অর্থাৎ বিরোধীদলকে শায়েস্তা করতে। তারা বিরোধীদলকে যেমন নাস্তানাবুদ করতে চাচ্ছে তেমনি জনগণেরও মনঃতুষ্টি সাধন করতে চাচ্ছে। এটা করতে যেয়ে সরকারকে সেই ব্রিটিশদের তথা পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে হাতি পোষার মতো ব্যয়বহুল ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যার ফলে যে সাবানের দাম ছিল ৫ টাকা, সেই সাবানের দাম এখন ৩৬ টাকা। যে দুধের লিটার ছিল ১৫ টাকা, সেই দুধের লিটার এখন ৮০ টাকা। দুধ খেতে পারছে না সাধারণ মানুষ, পারছে না শিশুরা। তাহলে এখন কি করণীয়?
একটি পরিবারে জমি ছিল এক বিঘা। বাপ-চাচা ছিলেন। তাদের পরের প্রজন্মের কারণে সেই জমি এখন টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। তাই এখন চাষ করা তো দূরে থাক, ঘর তোলবার জন্য এক খ- জমি নেই। সেই ঘর তোলার বেড়া নিয়ে লাগে মারামারি, খুনোখুনি, মামলা-মোকাদ্দমা। উপায়ন্তর না পেয়ে প্রায় এক কোটি তরুণ-তরুণী বিদেশে অলিখিত দাসত্বের শৃঙ্খল টানে। কী অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্য দিয়ে শ্রমিকরা যাচ্ছেন তারা জানেন। খুব সুখে থাকলে এভাবে এ দেশের বহু নারীকে এত ভয়ংকর, কালো বিভীষিকাময় পথ বেছে নিতে হত না। আমরা জেনে শুনে আমাদের নারীদেরকে সেই আরব পিশাচদের হাতে তুলে দিচ্ছি। কাজেই আমার কথা হচ্ছে, হে মানুষ, এখন ভাবো তোমরা। তোমাদের বাঁচার কোনো পথ নেই। তোমরা চারিদিক থেকে ঘেরাও হয়ে গেছ। তোমাদের এখন নতুন যে বাজেট তাতে ৫০ হাজার কোটি টাকা কেবল সুদ। তুমি সরকারকে যে ট্যাক্স দিবে তাতে শতকরা ১৮ টাকা যাবে সুদ বাবদ। জাতীয়ভাবে তুমি আকণ্ঠ সুদে নিমজ্জিত। তাই এখন তোমার নামাজ, রোজা, তাহাজ্জুদ এর কোনো মূল্য নেই। তুমি এক মাস রোজা রেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ভাবছ তুমি জান্নাত যাবে, তুমি রহমত, বরকত কিনে ফেলেছ। এগুলা সব তোমার ভুল ভাবনা। তুমি প্রতারিত হয়েছ। মহাপ্রতারক শয়তান তোমাকে প্রতারিত করেছে। ৫০ হাজার কোটি টাকা তোমার সরকার সুদ দিচ্ছে, সে সুদের ভার তোমাকেই বহন করতে হচ্ছে। তোমার করের প্রতি ১০০ টাকায় ১৮ টাকা যাবে সুদে। দিন দিন তোমার উপর অর্থনৈতিক অবিচার বাড়বে বৈ কমবে না। মুখে যতই স্বাধীনতার বুলি আওড়াও না কেন তুমি এখন কার্যত পাশ্চাত্যের কেনা দাসমাত্র।
কাজেই নিজে যদি বাঁচতে চাও তুমি আগে তোমার সমাজ রক্ষা করো, মানবজাতিকে রক্ষা করো। পৃথিবীতে আল্লাহর সত্য দ্বীন প্রতিষ্ঠা করো। তা নাহলে তুমি বাঁচবে না। এখন এখানে মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা নির্মাণ আর সেগুলোতে রং পালিশ করা অর্থহীন। কারণ মানুষের চেহারাই বিবর্ণ ও ক্লিষ্ট হয়ে গেছে। মানুষ প্রচ- কষ্টে আছে। মানুষের সাথে কথা বলা যায় না। বাসে উঠলে ঝগড়া, মসজিদে গেলে ঝগড়া, মন্দিরে গেলে ঝগড়া, কলেজ-ভার্সিটিতে গেলে ঝগড়া, এক শিক্ষক আরেক শিক্ষককে শ্রদ্ধা করে কথা বলেন না। মানুষ বড়ই অশান্তির মধ্যে আছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বন্ধুত্ব ও প্রেম নেই, তারা আর ভালোবাসার গল্প বলে না। এখন তাদের সব গল্প হয়ে গেছে দুঃখের, কষ্টের, অনটন আর টানাটানির। দাদা-দাদী, নানা-নানী এখন আর নাতিদেরকে রূপকথার গল্প শুনায় না। অত সময় নেই কারো, আর ভাঙনের ঢেউ এসে সব যৌথ পরিবারকে একক পরিবারে পরিণত করে গেছে। পূর্বপুরুষ আর উত্তর পুরুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট দূরত্ব। আগের একান্নবর্তী পরিবারে কত পিতা-মাতাহীন ছেলেপেলে একসঙ্গে থেকে খেয়ে খেলে বড় হয়ে যেত, এখন আর সে সুযোগ নেই। আত্মীয়তার বন্ধনগুলো হয়ে গেছে লোক দেখানো, কেউ কারো জন্য ত্যাগস্বীকার করতে প্রস্তুত নয়। ফলে নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে এক ভয়ংকর রাগ, ক্ষোভ নিয়ে আর নিরাপত্তাহীনতার ভীতি নিয়ে। তাদের সেই ক্ষোভের প্রকাশ হচ্ছে রাস্তা-ঘাটে। ইন্টারনেটের অদৃশ্য জালে আটকা পড়ে গেছে তোমাদের সন্তানেরা। অকালপক্কতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের নিষ্পাপ মুখশ্রী হারিয়ে যাচ্ছে, সেখানে ছায়া বিস্তার করছে পাপ। তারা স্মার্ট ফোনে আর ল্যাপটপে দেখছে পর্নগ্রাফি, তারা অশ্লীলতার জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। অশ্লীলতা গোটা সমাজকে ভিতরে ভিতরে শেষ করে দিয়েছে। সুযোগ পেলেই কে যে কখন কাকে ধর্ষণ করবে, কে বুকে ছুরি ঠেকাবে বলাও যাচ্ছে না। সবাই আছে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে। কাজেই মানুষ, তুমি এবং তোমার সমাজ ধ্বংস হয়ে গেছে। তোমার ভিতরও শেষ, তোমার বাহিরও শেষ।
এখন এখানে তোমাদের আর উপাসনালয় বানিও না। আনেক উপসানলায় হয়েছে। আর ধর্মব্যবসায়ীদেরকে তোমাদের সঙ্গী করো না। তুমি যদি মনে করো ধর্মব্যবসায়ীকে ডাব খাওয়ালে, মুরগির রান খাওয়ালে তোমাদের সওয়াব হবে তাহলে তুমি ভুল ভাবছ। এতে তোমার কোনো সওয়াবই হবে না। সওয়াবের খাতা বন্ধ হয়ে গেছে বহু আগেই। তাঁর প্রিয় সৃষ্টি বনি আদম, যার মধ্যে তাঁর রুহ আছে সেই আদম সন্তানেরা নিজেরা মারামারি, রক্তপাত, যুদ্ধ-বিগ্রহ করে দুনিয়াটাকে নরক বানিয়ে রেখেছে। তাই আল্লাহ, ভগবান, ¯্রষ্টা, ঈশ্বর এখন ক্রোধের দৃষ্টি দিয়ে রেখেছেন পৃথিবীর দিকে। তাঁর এখন ক্রোধ বর্ষিত হচ্ছে তোমাদের উপর।
আমাকে গালি দিতে কোনো কসুর করে না তোমাদের ধর্মব্যবসায়ীরা, অসম্ভব গালি দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমাকে হত্যা করার জন্য যেহেতু ফতোয়া দিয়েছে, সেহেতু আমাকে গালি দিলে তো আর গুনাহ হবে না, বরং ইসলামের কাজ করা হবে, সওয়াব হবে। তাদেরকে এই গালি কোথায় শিখিয়েছে, কে শিখিয়েছে, কে তাদের গুরু আমি জানি না। চোখের সামনে তোমরা আপনজনকে মরে যেতে দেখবে, চোখের সামনে তোমরা তুলে নিয়ে যেতে দেখবে, চোখের সামনে তোমরা আরও পৈশাচিক দৃশ্য দেখবে। তোমরা আর্তনাদ করবে, চিৎকার করবে। নিজের চামড়া ছিঁড়ে ফেলবে, নিজের গায়ে নিজে আগুন ধরিয়ে দিবে। তোমরা ভাবছ প্রতিবাদ করবে? কিন্তু কোনো লাভ হবে না। সব প্রতিবাদ ব্যর্থ হয়েছে। তুমি যদি গায়ে ধরিয়ে মরেও যাও তবুও কারো কিছু হবে না।
ইবলিস এটাই চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল, এখানেই সে মানবজাতিকে নিয়ে এসেছে। এখন কি তোমরা এখান থেকে ফিরবে নাকি ফিরবে না? সেই ফেরার জন্যই আমি প্রাণান্তকরভাবে আহ্বান করছি। আমার যত চিৎকার, যত আর্তনাদ শুধু এটার জন্য। তোমরা আমার লেবাসের দিকে তাকিও না। তোমরা আমার শিক্ষা, বংশের দিকে তাকিও না। তোমরা আমার আর্তনাদ শোন, আমার কথা শোন।
একটা মেথরও যদি তোমাদেরকে বলে যে, ‘সামনে যেও না, সামনে ডাকাত আছে। আমি নিজে দেখেছি।’ তোমরা অন্তত সেই মেথরটার কথা শুনবে। ডাকাত আছে কিনা, নিজে গিয়ে দেখবে না।
আমি পাগল নই, আমি উন্মাদ নই। আমি বক্তাও নই যে আমি বক্তৃতা দিয়ে মানুষের মন জয় করব। মানুষ আমাকে বেশি বেশি করে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াবে। সামনের মৌসুমে আমার আরো বড় ওয়াজ হবে। আমার টাকার অঙ্ক বাড়বে। না! আমি কথাগুলো বলছি সমাজের প্রয়োজনে, তোমাদের প্রয়োজনে। এ সমাজকে পরিবর্তন করতে, ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে বলছি। তা নাহলে আমরা কেউই বাঁচব না। বাঁচার এ পথটি ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ফিলিস্তিনে, রাখাইনে, ইয়েমেনে, আফগানিস্তানে আসে নি, ফলে তারা ধ্বংস হয়ে গেছে। আমাদের কাছে সেই পথ এসেছে, আমরা কি তাহলে একবার বাঁচার চেষ্টা করে দেখব না?