মোহাম্মদ আসাদ আলী
আল্লাহর রসুল বলেছেন, এমন একটা সময় আসবে যখন রোযাদারদের রোযা থেকে ক্ষুধা ও পিপাসা ব্যতীত আর কিছু অর্জিত হবে না। আর অনেক মানুষ রাত জেগে নামাজ আদায় করবে, কিন্তু তাদের রাত জাগাই সার হবে (অর্থাৎ নামাজ কবুল হবে না) (ইবনে মাজাহ, আহমাদ, তাবারানী, দারিমি, মেশকাত)। এই হাদীসে যাদের কথা বলা হচ্ছে তারা কিন্তু রোজার যথাযথ নিয়ম-কানুন পূর্ণ করে ক্ষুধা ও পিপাসার যন্ত্রণা সহ্য করেই রোজা রাখবে, তবু তাদের রোজা আল্লাহর দরবারে কবুল না হবার কারণ কী? এর কারণ আমাদের বাস্তব সমাজেই মিলবে।
আজকে আমরা যদি সত্যিকার রোজাদার হতাম, সংযমী হতাম, তাহলে একটা মুসলিমপ্রধান দেশে কীভাবে ১১ মাস খাদ্যদ্রব্যের দাম কমে আর রোজার মাস বাড়ে? রসুলাল্লাহ (সা.) এবং সাহাবী ও তাবে-তাবেয়ীনদের যুগে রমজান মাসে বাজার দর সবচেয়ে মন্দা যেত। পণ্যসামগ্রির চাহিদা থাকতো সবচেয়ে কম। তারা নিজের জন্য ভোগ্যপণ্য কেনাকাটা না করে ঘুরে ঘুরে গরীব দুঃখীদের দান সদকা করতেন। আর বর্তমানে রমজান মাস আসলেই চাল, ডাল, আটা, চিনি, লবণ, পেঁয়াজ, রসুন, তেল এগুলোর মূল্য ধাঁই ধাঁই করে বেড়ে চলে। অর্থাৎ প্রকৃত ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত। সংযমের কোনো চিহ্নই থাকে না, অন্য সময়ের চেয়ে খাওয়ার পরিমাণ ও ব্যয় বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ বলেছেন, যারা কুফরী করেছে তারা ভোগ-বিলাসে লিপ্ত থাকে এবং পশুর মত আহার করে। তাদের ঠিকানা হল জাহান্নাম (সূরা মোহাম্মদ ১২)।
সওমের মাসে যদি সতিকার অর্থে সংযম থাকত তাহলে মুসলিম বিশ্বে দারিদ্র্য থাকত না। একমাসের সওমই সমাজকে অনেকাংশে স্বচ্ছল করতে যথেষ্ট ভ‚মিকা রাখতে পারত। যারা অবস্থাসম্পন্ন তারা যদি সংযমী হতেন যে এই একটি মাস আমরা লোকদেখানো সংযম নয়, সত্যিকারভাবে সংযম করব, তাহলে যতটুকু তারা ব্যয় সংকোচন করছেন সেটা সমাজের মধ্যে উপচে পড়ত। পনেরো কোটি জনসংখ্যার মধ্যে পাঁচ কোটিও যদি সওম (সংযম) করে সেই ভোগ্যবস্তু অন্যকে দান করত তাহলে জাতীয় সম্পদ এমনভাবে উপচে পড়ত নেওয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যেত না। এটা হচ্ছে সওয়মের বাস্তব প্রতিফলন। উদাহরণ যদি অন্যান্য মাসে ভোজ্য তেলের লিটার থাকত ১০০ টাকা, এই মাসে থাকত ২০ টাকা। অন্যান্য মাসে গোশত যদি থাকত ২০০ টাকা এই মাসে থাকতো ৫০ টাকা। কারণ মানুষ নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করছে, চাহিদা থাকলেও খাচ্ছে না। সেই নিয়ন্ত্রণের প্রভাব তার শরীরের মধ্যে পড়বে, মনের মধ্যে পড়বে, এতে একদিকে ব্যক্তি পরিশুদ্ধ হবে, অন্যদিকে সমাজ সমৃদ্ধ হবে। তাহলে প্রতি বছর মুসলিম বিশ্বে রোজা রাখা হচ্ছে, খাদ্যগ্রহণ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, কিন্তু আমাদের সমাজে অন্যায় অবিচার, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ভয়ানক আকারে বেড়ে চলছে। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে আমাদের সওম হচ্ছে না।
আইয়্যামে জাহেলিয়াতের ভোগবাদী সমাজ ইসলামের ছায়াতলে আসার পর কেমন পরিবর্তিত হয়েছিল সেটা ইতিহাস। যে সমাজে নারীকে ভোগ্যবস্তু মনে করা হতো, সেই সমাজে এমন নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে একজন যুবতী নারী একাকী সারা দেহে অলঙ্কার পরিহিত অবস্থায় শত শত মাইল পথ পরিভ্রমণ করত, তার মনে কোনো ক্ষতির আশঙ্কাও জাগ্রত হতো না। মানুষ নিজের উপার্জিত সম্পদ উট বোঝাই করে নিয়ে ঘুরত গ্রহণ করার মতো লোক খুঁজে পেত না। শহরে না পেয়ে মরুভ‚মির পথে পথে ঘুরত, শেষে মুসাফিরদের সরাইখানাগুলোতে দান করে দিত। সামাজিক অপরাধ এত কমে গিয়েছিল যে আদালতগুলোয় মাসের পর মাস কোনো অপরাধ সংক্রান্ত অভিযোগ আসতো না। সেই সোনালি যুগের কথা এখন অনেকের কাছে গল্পের মতো লাগতে পারে।
আবু যার গেফারি (রা.) এর গেফার গোত্রের পেশাই ছিল ডাকাতি। সেই আবু যর (রা.) সত্যের পক্ষে আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন। রাস্তায় কেউ সম্পদ হারিয়ে ফেললে খুঁজতে গিয়ে তা অবশ্যই ফেরত পাওয়া যেত। মানুষ সোনা-রূপার অলঙ্কারের দোকান খোলা রেখেই মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ত, কেউ চুরি করত না। মানুষ জীবন গেলেও মিথ্যা বলত না, ওজনে কম দিত না। এই যে শান্তিপূর্ণ অবস্থা কায়েম হয়েছিল এটা কেবল আইন-কানুন দিয়ে হয়নি। মানুষের আত্মায় পরিবর্তন না আনতে পারলে কঠোর আইন দিয়ে মূল্যবোধ সৃষ্টি করা যায় না। যে সমাজের মানুষগুলো কিছুদিন আগেও ছিল চরম অসৎ তাদের আত্মায় এমন পরিবর্তন কী করে সম্ভব হয়েছিল? সেটা হচ্ছে এই সালাত, সওম ইত্যাদি চারিত্রিক প্রশিক্ষণের প্রভাব। সেই নামাজ রোজা তো আজও কম হচ্ছে না, তাহলে এর ফল নেই কেন?
তার কারণ সওম পালনের যে প্রথম শর্ত হচ্ছে তাকে মো’মেন হতে হবে। কিন্তু এই জাতি মো’মেন না। দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, তাকওয়া, সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় বোধের সৃষ্টি। আজকে অন্যান্য জাতির কথা বাদই দিলাম আমাদের মুসলমানদের মধ্যে ন্যায়-অন্যায় বোধের কোনো চিহ্ন নেই। এই বিষয়গুলা আজকে আমাদেরকে অবশ্যই বুঝতে হবে, ভাবতে হবে। ভাবতে হবে এই জন্য যে আমরা মুসলমান ১৫০ কোটি। একের পর এক যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে সা¤্রাজ্যবাদীরা মুসলিম দেশগুলোকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমরা দিনকে দিন মসজিদ বানাচ্ছি, টাইল্সের মসজিদ হচ্ছে, এসি হচ্ছে, সোনার গম্বুজ হচ্ছে, আমাদের রোজাদারের কোনো অভাব নাই, হাজীর হজ্বের কমতি নেই, নামাজের কোনো অভাব নাই। এতেই বোঝা যায় আমাদের নামাজ রোজাসহ অন্যান্য আমল কতটুকু গৃহীত হচ্ছে।
সমাজে সওমের আরেকটি প্রভাব পড়া উচিত ছিল যে মানুষ ক্ষুধার্তের কষ্ট অনুধাবন করবে। এটা কি আদৌ পড়ছে? যদি দেখা যায় যে বছরের অন্যান্য সময়গুলোতেও মানুষ এই বিষয়টা উপলব্ধি করে তার খাদ্য ক্ষুধার্তকে দিচ্ছে, প্রতিবেশিকে আহার করাচ্ছে তাহলে বোঝা যেত যে তার রমজানের সওম ফলপ্রসূ হয়েছে অর্থাৎ কবুল হয়েছে। তেমন কোনো নিদর্শন কিন্তু আমাদের সমাজে দেখা যায় না, তবে ব্যতিক্রম দু-চারজন ব্যক্তি থাকতেও পারে।
যে এগারো মাস ঘুষ খায় সে যদি এই একটি মাসে না খায় তাহলে তার একটি বিরাট প্রভাব সমাজে পড়ার কথা। কিন্তু আমরাতো এটা দেখি না, উল্টো এই মাসে অপরাধ আরো বাড়ে। এই মাসে খাদ্যে আরো বেশি বিষ মেশানো হয়। টাকার জন্য মানুষ মানুষকে এভাবে বিষ খাওয়াচ্ছে, সংযম তো দূরের কথা। এই মাসটিকে ব্যবসায়ীরা বাড়তি উপার্জনের মাস হিসাবে নির্বাচন করে। কথা ছিল সংযম কিন্তু রোজা শুরু হতে না হতেই দামি দামি পোশাক কেনা শুরু হয়। কথা ছিল এ মাসে আমি পোশাক কিনব গরীব মানুষের জন্য, সে হিন্দু হোক বা মুসলিম। এক কথায় সে মানুষ কিনা, বনী আদম কিনা? ব্যাস, যার বস্ত্র নাই তাকে দেওয়া। কিন্তু কোথায় কী? যেখানে মুসলমানরা যখন অভাবের তাড়নায় ইউরোপের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করছে, শুধু অসহায় নারী নয়, পুরুষরা পর্যন্ত দেহব্যবসায় বাধ্য হচ্ছে সেখানে অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতে চলছে ইফতার আর ঈদের নামে খাদ্য ও সম্পদের বিপুল অপচয়। সওম তাদেরকে কোনো সংযমই শিক্ষা দিচ্ছে না। যেমন সালাহ তাদেরকে কোনো অন্যায় থেকে ফেরাতে পারছে না, ঐক্য-শৃঙ্খলা শিক্ষা দিচ্ছে না, তেমনি সওম পালন করেও চরিত্রে কোনো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়নি। এভাবেই আল্লাহর রসুলের হাদিসটি পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়েছে।