কামরুল আহমেদ
আমি বাংলাদেশের সকল মানুষের কথা বলছি, আবার এদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর কথাও বলছি। একজন মানুষের যেমন একাধিক পরিচয় থাকে এবং সেই পৃথক পরিচয়ের সঙ্গে পৃথক দায়িত্ব জড়িয়ে থাকে তেমনি আমাদেরও বাঙালি এবং মুসলমান এই দুটো পরিচয়েরই দায়-দায়িত্ব বহন করতে হয়। আমাদেরকে চলমান বিশ্বপরিস্থিতি নিয়ে খুব ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে। আমাদের কুখ্যাতি আছে হুজুগে বাঙাল বলে, আবার মুসলিম জাতিরও কুখ্যাতি জুটেছে কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অন্ধ, জঙ্গি ও দাঙ্গাপ্রবণ বলে। যারা হুজুগপ্রবণ জাতি তারা তাদের মানবজন্মের উপর সুবিচার করতে পারে না, তাদের মহামূল্যবান মস্তিষ্ককে অস্বীকার করে পেশীশক্তিকে তারা অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে। আমাদেরকে অন্ধ আবেগ বা ধর্মানুভূতি-তাড়িত না হয়ে মগজ খাটাতে হবে এবং কর্তব্য-অকর্তব্য নিরূপণ করতে হবে। যখন পৃথিবীতে একটার পর একটা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে তখন আর কতকাল আমরা হুজুগে জাতি হয়ে থাকব?
আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছি ইউরোপ-আমেরিকার অনুসরণ অনুকরণ করতে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে- এমন কি শরীর ও মনের ভাষাতেও চেষ্টা করছি পশ্চিমা হতে। কিন্তু তারা আজ যে অগ্রগতি করেছে সেটা অনুকরণ-অনুসরণ করে আমরা কতটুকু অর্জন করতে পারব? একটি দাস জাতি কি চাইলে প্রভুদের মতো সবকিছু করতে পারে? শাসিত কি পারে শাসকের মতো হতে? আমাদের জাতীয় অবস্থান কোথায় সেটা আমাদের আগে মূল্যায়ন করতে হবে। সবার আগে বুঝতে হবে, কোনো আবিষ্কার, উদ্ভাবনের কৃতিত্ব কেবল এশিয়ার নয়, কেবল আরবের নয়, কেবল ইউরোপেরও নয়। শুভকর সবকিছুর উপর গোটা মানবজাতির সমান অধিকার। যেমন বিজ্ঞানের মালিকানা কেবল খ্রিষ্টানের নয়, ইহুদির নয়, মুসলমানেরও নয়। একটি শিশু যেমন জীবনের নানা পর্যায়ে নানারকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পরিণত মানুষে পরিণত হয় তেমনি মানব সভ্যতাও এ পর্যন্ত বিভিন্ন সভ্যতার অবদানকে ধারণ করে, সঞ্চয় করে এই আজকের পর্যায়ে এসেছে। একজন বিজ্ঞানী একটি তত্ত¡ আবিষ্কার করেছেন, আরেকজন বিজ্ঞানী সেটাকে প্রয়োগ করে একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। সময়ের চাহিদা পূরণে সেই যন্ত্রটিকে প্রযুক্তিবিদেরা প্রয়োজনমাফিক নতুন নতুন রূপ প্রদান করেছেন। এদের কেউ হয়ত মুসলিম কেউ হয়ত খ্রিষ্টান কেউ বা নাস্তিক। তাতে কী আসে যায়? বিজ্ঞানের সম্পর্ক ধর্ম-সম্প্রদায়ের সঙ্গে নয়, সম্পর্ক মানবজাতির সঙ্গে। ইউরোপ ধর্মকে তাদের রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে আলাদা করতে পেরেছে। কেন পেরেছে? কারণ সেখানকার প্রধান ধর্ম খ্রিষ্টবাদের গ্রন্থের মধ্যে রাষ্ট্রীয় বিধিবিধানই নেই, তারা ধর্ম দিয়ে রাষ্ট্র চালাবে কী করে? দ্বিতীয় কারণ হল ইসলাম দিয়ে যে সুশাসনের ইতিহাস আছে সেটাও খ্রিষ্টানদের নেই। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। পবিত্র কোর’আনে জীবন পরিচালনার জন্য প্রয়োজন যাবতীয় মূলনীতি আছে, অর্থনীতি, দণ্ডবিধি, সমাজব্যবস্থা, আত্মিক উৎকর্ষ কোনটা কীভাবে হবে সব মূলনীতি ইসলামে রয়েছে। এখন আমরা যে সমাজে বাস করছি সেখানে ইসলাম বলতে দাড়ি-টুপি, বোরকা, নামাজ-রোজা এই আনুষ্ঠানিকতাগুলোই দেখা যায়। তেরশ বছরে ইসলাম বিকৃত হতে হতে এই অবস্থানে এসেছে।
ইসলাম যে একটি জাতীয় ও পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা সেটা মুসলিম জনগোষ্ঠী বিস্মৃত হয়ে গেছে এবং যারা ইতিহাস জানেন তাদের মধ্য থেকে অনেক সংগঠন গড়ে উঠেছে যারা জাতীয় জীবনে আবার ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এমনকি যে দলগুলো নির্বাচনের দিকে না যেয়ে চরমপন্থার দিকে গিয়েছে তারাও দীন প্রতিষ্ঠার কথা বলছে। খুব সহজেই তারা জনগণকে মোটিভেট করতে পারছে এই বলে যে, “দেখ, এই সরকার কুফরি সরকার। কীভাবে? সরকার কোর’আনের হুকুম মানছে না, ইসলামের হুকুম মানছে না।” তখন ইসলামপ্রিয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব’র সৃষ্টি হয়। মানুষের সবচেয়ে বড় দ্বন্দ হল তার বিশ্বাসের দ্ব›দ্ব। সে এই সরল যুক্তি মেনে নিতে বাধ্য হয় যে ঠিকই তো আমাদের সরকার সেভাবে দেশ চালাচ্ছে না। কাজেই এটি ইসলামের সরকার না। এ সরকার অবৈধ সরকার। এ সরকারের হুকুম মানা আমাদের জন্য জায়েজ নয়, সঙ্গত নয়, ইসলামসম্মত নয়। তাদেরকে বোঝানো হয় যে, এই সরকারকে হটানো হলো একজন মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব। যার ফলে নিজের অবচেতন মনেই সে সরকারের বিরোধিতা করল। সরকারের কোনো কাজে সহযোগিতা করতেও তার কোনো আগ্রহ রইল না। কারণ এটা তো কুফরী সরকার।
একারণে সিরিয়ায় এটাই হলো প্রধান সঙ্কট। সিরিয়ার সরকার একটি ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদী সরকার। কিন্তু হলে কি হবে? সরকারের বিরোধী দলগুলো সম্পূর্ণ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এরাই এখন হয়েছে জঙ্গি, এতদিন কিন্তু তারা জঙ্গি ছিল না। আমাদের দেশে যেমন বিভিন্ন দল আছে যারা তথাকথিত নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করে, নির্বাচন করে, দাবি আদায়ের আন্দোলন করে তার তখন এমন সংগঠন ছিল। বিভিন্ন ধর্মীয় ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন ছিল সিরিয়াতে। সেইসব আন্দোলনের নেতারা সহজেই জনগণকে সমাজতান্ত্রিক বাথ পার্টির আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে পেরেছে। সেই দাবি আদায়ের আন্দোলনের পথ বেয়ে আজকের সিরিয়া, আজকের লিবিয়া ধ্বংসস্ত‚প পর্যন্ত এসেছে। সিরিয়া এখন পুরোই সাম্রাজ্যবাদীদের যুদ্ধের লীলাক্ষেত্র। এখন তারা সঙ্কটে পড়েছে ধর্মকে নিয়ে। ধর্ম সেন্টিমেন্টকে তারা কী করে বশে রাখবে?
মিশরে তো ইতোমধ্যেই ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বন্যার প্রবল স্রোতকে বাধ দিয়ে আটকে রাখলে যেমন একটা সময় সেই বাধ লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে পারে, মিশরের অবস্থা সেদিকে গেছে। ইখওয়ানুল মুসলেমিনের লক্ষ লক্ষ সমর্থক এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে জঙ্গিবাদের মন্ত্রে দীক্ষা নিচ্ছে। বলা যায় তারা এতে বাধ্য হয়েছে। আফগানিস্তান পুরোটা এখন একটি অরাজক দেশ, কোন আইন নেই, কানুন নেই। যে কোনো জায়গায় যে কোনো মুহূর্তে বোমা বিস্ফোরণ হতে পারে। সেখানকার বিধ্বস্ত স্থাপনাগুলো নির্মাণের দায়িত্ব নিয়েছে বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের নির্মাণ সংস্থা। সেখানেও স্বার্থোদ্ধারের উপায় তারা খুঁজে নিচ্ছে। আফগানিস্তান আর পাকিস্তানের নাম হল ব্যর্থ রাষ্ট্র। কাজেই সমস্ত মুসলিম বিশ্বের সঙ্কটটা এখানে। ঐতিহাসিক ঘটনার পরম্পরা এবং মুসলিম বিশ্বের পাশ্চাত্য পদলেহী শাসকরা, সেখানকার পাশ্চাত্যের অনুদাস মানসিকতার শিক্ষিত শ্রেণির লোকেরা, কথিত সুশীল সমাজ, আইনজীবী, যারা রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত তারা মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর রাষ্ট্রদর্শনটাকে এখানে এনেছেন। কিন্তু দেশের অধিকাংশ জনগণের মানসিক প্রবণতা এখনও ধর্মের দিকেই ঝুঁকে আছে এবং তাদের আনুগত্য এখনও ধর্মেরই প্রতি সেটার সঙ্গে রাষ্ট্রব্যবস্থার কোনো যোগ তারা ঘটাতে পারেননি, মানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট বা অনুভূতির সঙ্গে মানানসই কোনো সিস্টেম তারা এখন পর্যন্ত কার্যকর করতে পারেননি। ফলে মুসলিম বিশ্বে রাষ্ট্র আর ধর্মের এই দ্বন্দটা দিনকে দিন, দিনকে দিন প্রকটতর হচ্ছে এবং হবে। এ দ্বন্দ্বের একমাত্র সমাধান এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা, এমন একটি কাঠামো দাঁড় করানো যা একদিকে তাদের ধর্মীয় ন্যায়-নীতির মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হবে আরেকদিকে যুগোপযোগী চিন্তা ভাবনা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, সকল জাতির রুচি-অভিরুচি-আঞ্চলিক সংস্কৃতি সবকিছুকেই যৌক্তিকতার নিরিখে বিচার করে ধারণ করতে পারবে। যে জীবনব্যবস্থা চৌদ্দশ বছর আগের আরবের আঞ্চলিক রীতি-নীতি বা প্রথাকে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেবে না, আরবের পোশাক, খানা-খাদ্য, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গোঁয়ারের মতো অন্যকে গ্রহণ করতে বাধ্য করবে না। আবার তথাকথিত ভোগবাদী, বস্তুবাদী, স্বার্থবাদী এবং স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা, জনকল্যাণবিরোধী যে জীবনপ্রণালী চলছে সেটাও থাকবে না। এরকম একটা ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থা ইসলামে আছে, আর সেটার প্রস্তাবনাই আমরা হেযবুত তওহীদ দিচ্ছি। এই জীবনপদ্ধতি যতদিন না প্রতিষ্ঠা করা হবে ততদিন সরকার একটা কাজই করতে পারবে, তা হলো জোর করে, শক্তি দিয়ে, পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে ধর্মানুভূতিকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করবে। আর ইসলামী দলগুলো প্রচার চালিয়ে যাবে যে এই সরকার ইসলামের শত্রæ। প্রয়োজনে ধর্মব্যবসায়ীদের সঙ্গে আপসরফা করে তাদের অন্যায় আব্দার মেনে মাথায় হাত বুলিয়ে চলবেন। কিন্তু দ্ব›দ্ব দূর হবে না, শেষ পরিণতি হবে ইরাক সিরিয়ায় যা হয়েছে তা। কিন্তু আমাদের এই প্রস্তাবনা গ্রহণ করলে ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ ইত্যাদি যে ভ্রান্ত মতবাদগুলো রয়েছে সেগুলোর উত্থানের কোনো সুযোগই থাকবে না, সরকারকে কেউ কুফর সরকার বলে প্রচার করার সুযোগ পাবে না। গোটা জাতি হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে একদেহ একপ্রাণ। তখন সাম্রাজ্যবাদীরা আর তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য জাতির ঐক্যের প্রাচীরে কোনো ফাটল খুঁজেও বের করতে পারবে না। সুতরাং আমাদের সঙ্কট কী সেটাও আমরা যেমন সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরলাম, তেমনি তার সমাধানের পথটাও তুলে ধরলাম। এখন এটা গ্রহণ করা না করার উপর নির্ভর করছে জাতির পরিণতি।