রুফায়দাহ পন্নী
সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত মানবজাতির অগ্রযাত্রার প্রতিটি পদক্ষেপের পিছনে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। সভ্যতার নির্মাণে আমরা পুরুষকে অগ্রণী ভূমিকায় দেখতে পেলেও লোকচক্ষুর অন্তরালে সেই পুরুষের পেছনে থেকে কোনো না কোনো নারীর প্রেরণা, সহযোগিতা সক্রিয় ছিল। আল্লাহ প্রথমে একজন পুরুষ সৃষ্টি করেছিলেন। মহান আল্লাহ সৃষ্টির শুরুতে মালায়েকদের ডেকে বললেন তিনি পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে এক নতুন সৃষ্টিকে প্রেরণ করতে চান। মালায়েকরা এই সৃষ্টিকে সৃষ্টি করার বিরুদ্ধে মতামত ও যুক্তি পেশ করলেও মহান স্রষ্টা তাদের কথা শুনলেন না, স্রষ্টার চাওয়ায় সৃষ্টি হল সৃষ্টির। আল্লাহ নিজ হাতে মানবসভ্যতার প্রথম মানুষ, আদি পিতা, আদি পুরুষ, আদমকে তৈরি করলেন। তৈরি করে তাঁর মাঝে নিজের রূহ ফুঁকে দিলেন, তাঁকে জ্ঞান দিলেন, বিজ্ঞান শেখালেন যার ফলে মানুষ মালায়েকদের থেকে শ্রেষ্ঠ হওয়ার গৌরব অর্জন করলো, সম্মান লাভ করলো এবং তাদের থেকে রোজ কিয়ামত পর্যন্ত সেবা পাওয়ার অঙ্গিকার লাভ করলো। এরপর আদমের বসবাসের স্থান হিসেবে জান্নাত নির্ধারিত হল।
জান্নাতে প্রথম পা রাখলেন বাবা আদম। তিনি বিস্ময়ের সাথে চারিদিকে দেখতে লাগলেন। জান্নাতের পরম শান্তি, নয়ানাভিরাম সৌন্দর্য, ফুল ও ফলের বাগান তার চিত্তে পুলকের সৃষ্টি করলো। কিন্তু এক পর্যায়ে গিয়ে দেখা গেল তাঁর চিত্তে আর শান্তি নেই। আদমের কাছে জান্নাতের সৌন্দর্য, সুখ-সম্ভোগ, রং-রূপ-রস সবকিছু বিবর্ণ-মলিন মনে হলো। স্রষ্টা জানেন সৃষ্টির মনস্তত্ত¡, তিনিই হলেন আমাদের সবার জন্মদাত্রী মা হাওয়া। মা হাওয়াকে লাভ করার পর পিতা আদমের জান্নাত পূর্ণতা পেল। প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ সেই জন্যই বোধ হয় তার একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন, ‘বিধাতা নর সৃষ্টি করেন এবং সেই নরকে বাঁচিয়ে রাখে নারী।’ আদম ও হাওয়াকে মহান আল্লাহ তাঁর পরিকল্পনা অনুসারে একটি ভুলের শাস্তি স্বরূপ পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন। শুরু হলো পৃথিবীতে নারী-পুরুষের একত্রে ইবলিসের বিরুদ্ধে মহাসংগ্রাম।
জান্নাত থেকে বিতাড়িত করে আল্লাহ পুরুষ ও নারীকে শাস্তিসহ পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন। পুরুষ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রোদে পুড়ে-বৃষ্টিতে ভিজে উপার্জন করবে ও পরিবারের ভরণ-পোষণ করবে এবং নারী গর্ভযাতনা সহ্য করবে ও সন্তান লালন-পালন করবে। এ দায়িত্ব ছাড়াও খেলাফতের যে মহান দায়িত্ব নিয়ে আদম ও হাওয়া পৃথিবীতে এসেছিলেন সেই দায়িত্বের সমান অংশীদার হলেন তারা দুইজন। আদমসন্তানদের বংশবিস্তারের ধারাবাহিকতায় পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল মানবজাতি। সর্বযুগে, সর্বস্থানে আল্লাহ মানুষকে দুনিয়াতে তাদের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য এবং এই দায়িত্ব পালনের পথ বেয়ে জান্নাতে ফিরে যাওয়ার জন্য নবী-রসুল-অবতার তথা পথপ্রদর্শক পাঠাতে থাকলেন। নবী-রসুলদের বিদায়ের পর কালের আঘাতে বিকৃত হয়ে যায় তাদের শিক্ষা, ফলে আবার সৃষ্টি হয় বিপর্যয়ের। সেই শিক্ষাকে সংস্কার করতে আসেন নতুন কোনো নবী। যতবারই দীন বিকৃত হয়ে যায়, পৃথিবীতে অন্যায়-অশান্তির বিস্তার হয় তাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় নারীরা। যেহেতু পুরুষের পেশীশক্তি অধিক তারাই হয় সমাজের নিয়ন্তা, আর নারীকে মুখ বুঁজে পুরুষতান্ত্রিক নির্যাতন সয়ে যেতে হয়। তাদেরকে বার বার পরিণত করা হয় বিনোদনের সামগ্রীতে, ভোগ্যপণ্যে। নতুন নবী এসে আবার সমাজে নারী ও পুরুষের যথাস্থান নিশ্চিত করেন, প্রত্যেকের মর্যাদা পুনঃস্থাপন করেন। তাঁদের এই সংগ্রামে নারী ও পুরুষ উভয়েই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন, কিন্তু নারীর ভূমিকা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইতিহাসের পাতায় অনুক্ত থেকে যায়।
ন্যায়প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের আবির্ভাবের এই পালাক্রমিক ঢেউ একের পর এক এসে মানব ইতিহাসের তটদেশ ছুঁয়ে যায়। নবী-রসুলদের আগমনের ধারাবাহিকতায় মহান আল্লাহ আজ থেকে চৌদ্দশ’ বছর আগে তাঁর শেষ রসুলকে প্রেরণ করেন। তিনি মক্কার আরব সমাজে বেড়ে উঠতে লাগলেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই মক্কার পরিবেশ দেখে যারপরনাই ব্যথিত হতেন। যুগটাকে বলা হয় আইয়্যামে জাহেলিয়াত বা অন্ধত্ব-অজ্ঞানতার যুগ। নারীদের অবস্থা সেখানে ছিল সবচেয়ে করুণ। কোনো পরিবারে কন্যাশিশু জন্মগ্রহণ করলে সেই পরিবারের সকলের মুখ অন্ধকার হয়ে যেত। কন্যাশিশুকে জীবন্ত কবর দেয়া ছিল নিত্য দিনের ব্যাপার। গোত্রে গোত্রে নারীদের নিয়ে কোন্দল হত, শক্তিশালী গোত্রের লোকেরা দুর্বল গোত্রে কোন সুন্দরী নারী থাকলে তাকে ভোগ করার জন্য আক্রমণ করত। এই ভয়েও অনেকে কন্যা সন্তান জীবিত রাখত না। নারীদের দেহপসারিনী বাঈজী হিসাবে ব্যবহার করা হত। এমনকি পবিত্র কাবায় উলঙ্গ হয়ে হজ করতেও বাধ্য করা হত। এরূপ একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে রসুল আসলেন এবং এই সমাজকে আলোকময় করার উপায় সন্ধান করতে লাগলেন। মহান আল্লাহ তাঁকে পথ দেখালেন, হেদায়াহ প্রদান করলেন। তাঁর উপর নাজেল করলেন ইসলামের শেষ সংস্করণ যার লক্ষ্য সমগ্র মানবজাতি। তিনি সমগ্র মানবজাতির জীবন থেকে যাবতীয় অন্যায় অবিচার দূর করে ন্যায়বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নবী হিসাবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হলেন। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় সমগ্র আরব উপদ্বীপে সেই অনাবিল শান্তি প্রতিষ্ঠা করে স্রষ্টার কাছে চলে গেলেন। আরবদের সমাজে ফিরে এলো ভারসাম্য।
আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থায় নারীরা আবার তাদের মর্যাদা ফিরে পেল। তারা তাদের সৃষ্টির মূল কারণ উপলব্ধি করতে সক্ষম হলো। তারা জীবনের সঠিক লক্ষ্য খুঁজে পেল। রসুলাল্লাহর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ তাদেরকে পরিণত করল দুঃসাহসী যোদ্ধায়। তারা সমাজের প্রতিটি অঙ্গনে তাদের প্রতিভা ও যোগ্যতার ছাপ রাখতে লাগলেন। তারা হলেন হাসপাতালের অধ্যক্ষ, হলেন বাজার ব্যবস্থাপক, তারা সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলেন। যারা ছিল সমাজের বোঝা, তারাই হলো সমাজের শক্তি।
সময়ের চাকা যতই ঘুরেছে ইসলাম ততই তার প্রকৃত রূপ থেকে দূরে সরে গিয়েছে। নারীদের পর্দা সংক্রান্ত মাসলা মাসায়েল নিয়ে, ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে হাজার হাজার মাসলা মাসায়েল নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে বিরাট বিরাট কেতাবের পাহাড় গড়ে তোলা হয়েছে। এভাবে সহজ সরল ইসলাম বিকৃত, বিপরীতমুখী, জটিল ও দুর্বোধ্য হয়ে গেছে। এখন এই যুগে এসে সেই মাসলা-মাসলায়েলগুলো পাঠ করলে ইসলামকে একটি নারী-নিগ্রহকারী, নারী অধিকার হরণকারী ও পুরুষতান্ত্রিকতার হেফাজতকারী একটি প্রাচীনপন্থী ধর্ম বলেই প্রতীয়মান হয়। মনে হয় যেন ইসলাম নারীকে আপাদমস্তক কালো কাপড়ে আবৃত করে রাখতে চায়, তাকে গৃহবন্দী করে রাখতে চায়, তার অবদানকে রান্না ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করতে চায়। এসব দেখে আধুনিকমনস্ক মানুষ ইসলামের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে। নারীরা হয়ে পড়েছে পাশ্চাত্যের পূজারী কারণ পাশ্চাত্য মূল্যবোধ নারীকে গৃহবন্দী করে রাখার পক্ষপাতী নয়। তারা তাদের নারীদেরকে চাঁদের দেশে নিয়ে গেছে বহু আগে, তাদের জাতীয় জীবনের সর্ব অঙ্গনে নারীর অবাধ পদচারণা ও অংশগ্রহণ। এদিকে মুসলিম নারীরা আজও শিক্ষা অধিকার নিয়েই সংগ্রাম করে যাচ্ছে, তাদেরকে অনুদান দিয়ে পড়াশোনায় উৎসাহিত করতে হচ্ছে। মেয়েরা অত শিক্ষিত হয়ে কী হবে – এমন কথা এখনও হরহামেশাই শোনা যাচ্ছে। ধর্মের বিকৃত মাসলা মাসায়েল দিয়েই নারীদেরকে এভাবে শত শত বছর পশ্চাৎবর্তী করে রেখেছে ধর্মব্যবসায়ী ফতোয়াবাজ গোষ্ঠী। তাদের সৃষ্ট এই ফতোয়ার নিগড় থেকে মুক্ত হতে গিয়েই পাশ্চাত্যের প্রদর্শিত অশ্লীল জীবনাচরণের ফাঁদে পা দিয়েছে আমাদের নারীরা। তারা যে আবার সেখানে গিয়ে মানুষের মর্যাদা খুইয়ে পণ্যেই পরিণত হয়েছে সেটা তারা উপলব্ধি করতে পারছে না। তাদেরকে আধুনিকতা ও স্বাধীনতার নামে আরেকটি ভারসাম্যহীন জীবন উপহার দিচ্ছে পশ্চিমা জীবনদর্শন।
একদিকে ধর্মব্যবসায়ীদের ফতোয়ার বেড়াজাল আরেকদিকে মুক্তির নামে পণ্যে পরিণত করার ফাঁদ এই উভয়প্রকার অন্যায় অবস্থা থেকে জাতিকে উদ্ধার করার পথ আল্লাহ পাক দান করেছেন। নবী-রসুল তো আর আসবেন না, কিন্তু আখেরি নবী যে প্রকৃত ইসলামের মাধ্যমে আরবের নারীদেরকে মুক্তির আস্বাদ প্রদান করেছিলেন, তাদেরকে যথোপযুক্ত মানবিক মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছিলেন আমর সেই ইসলাম পেয়েছি। সেটি আমরা মানবজাতির সামনে তুলে ধরে দৃঢ়তার সঙ্গে বলছি, আমাদের কাছে পথ আছে। কেবল নারীর মুক্তির পথ নয়, গোটা মানবজাতির মুক্তির সঠিক পথ আমাদের কাছে আছে। প্রতিটি মানুষ তার স্বীয় যোগ্যতা অনুসারে তার ভূমিকা রাখতে পারবে এমন একটি স্বাধীন সমাজব্যবস্থা আমরা মানবজাতিকে উপহার দিতে পারব ইনশাল্লাহ। সেখানে কেউ নিজেকে নিগৃহীত মনে করবে না, সুবিধাবঞ্চিত মনে করবে না, পরাধীন মনে করবে না, অধিকারহারা মনে করবে না, ন্যায্য অধিকার আদায়ে সোচ্চার কারো কণ্ঠই রুদ্ধ হবে না। আজ ইসলামে নারীর পর্দার নামে যে বিরাট অবিচারের পাহাড় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে মুসলিম ধর্মাবলম্বী নারীদের উপর সেই অবিচার থেকে তারা মুক্ত হয়ে আল্লাহর রসুলের নারী আসহাবদের মতোই জীবনের উন্মুক্ত অঙ্গনে পুরুষদের পাশাপাশি সমান ভূমিকা রাখবেন সে নিশ্চয়তা ইসলাম দিয়েছে।
আমরা হেযবুত তওহীদ সেই পথটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। একটি বিরাট বটবৃক্ষের সম্ভাবনা যেমন একটি ছোট বীজের মধ্যে নিহিত থাকে তেমনি আমাদের বক্তব্যের মধ্যে সমগ্র ইসলামের জীবনরীতি সম্পর্কে প্রচলিত ধ্যানধারণাকে পাল্টে দিয়ে একটি স্বর্গীয় পৃথিবী গড়ে তোলার রূপরেখা নিহিত রয়েছে- এই কথা আমরা দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতে পারি।