রাকীব আল হাসান
ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যে অমানবিক, এটা যে ধনীকে আরও ধনী গরীবকে আরও গরীব করে, একথা আজ যুক্তি-তর্ক দিয়ে প্রমাণ করার দরকার নেই। এই ব্যবস্থার নিষ্ঠুর পরিণতি দেখেই মানুষ বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজেছিল, যদি উম্মতে মোহাম্মদী তাদের উপর আল্লাহর রসুলের অর্পিত দায়িত্ব ত্যাগ করে পরিণামে একটি বিচ্ছিন্ন ঐক্যহীন, অশিক্ষিত, ঘৃণ্য জাতিতে পরিণত না হতো তবে পুঁজিবাদের বিকল্প ব্যবস্থা মানুষকে খুঁজতে হতো না। তাদের উপর আল্লাহর দেয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা উম্মতে মোহাম্মদীই প্রতিষ্ঠা করে সর্ব রকম অর্থনৈতিক অবিচার নির্মূল করে দিতো। যাই হোক, উম্মতে মোহাম্মদী তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় মানুষকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একটা বিকল্প ব্যবস্থা উদ্ভাবন করতে হলো এবং সেটা করা হলো এবং স্বভাবতই সেটা ঐ পুঁজিবাদের মতোই হলো মানুষ দ্বারা সৃষ্ট এবং সেটার স্রষ্টা হলেন কার্ল মার্কস। জয়জয়কার পড়ে গেল- পাওয়া গেছে, মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যার প্রকৃত সমাধান পাওয়া গেছে। আর অর্থনৈতিক অবিচার হবে না, প্রতিটি মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সমান হবে, কেউ প্রাচুর্যে বিলাসে কেউ দারিদ্র্যে বাস করবে না। বলা হলো এই হচ্ছে স্বর্গরাজ্য। কিন্তু হয়েছে কি? সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির নেতারা এবং সাধারণ নাগরিক শ্রমিক-কৃষক একই মানের জীবন যাপন করেন কি? একই মানের খাবার খান কি? একই রকম পোষাক পরিচ্ছদ পরেন কি? অবশ্যই নয়। এই কথায় গত মহাযুদ্ধের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। পুঁজিবাদী ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল মস্কো গিয়েছিলেন, কমিউনিস্ট রাশিয়ার রাষ্ট্রনেতা জোসেফ স্ট্যালিনের সাথে যুদ্ধের ব্যাপারে বুদ্ধি পরামর্শ করার জন্য। ক্রেমলিনের বিরাট প্রাসাদে বসে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করতে করতে গভীর রাত্রে চার্চিলের ক্ষিধে পেয়ে গেল, যদিও রাত্রের প্রথম দিকে তারা যে ভোজ খেয়েছিলেন তা রাশিয়ার সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, কৃষক জীবনেও দেখেনি। যাই হোক, ক্ষিধে চাপতে না পেরে চার্চিল বলেই ফেললেন যে কিছু না খেলে আর চলছে না। খাওয়া-দাওয়ার পাট আগেই চুকে গিয়েছিল বলে স্ট্যালিন আর কাউকে ডাকাডাকি না করে উঠে গিয়ে ফ্রিজ খুলে ভেড়ার একটি আস্ত রানের রোস্ট বের করে এনে টেবিলে রাখলেন। চার্চিল তো চার্চিলই, এক হাত নেবার লোভ সামলাতে পারলেন না। রোস্ট চিবুতে চিবুতে বললেন “ইস্! কবে আমি এমন করতে পারব যে ইংল্যান্ডের প্রতিটি ঘরে ফ্রিজের মধ্যে এমনি ভেড়ার রানের রোস্ট থাকবে”। স্ট্যালিনের গালে এটা ছিল একটা মারাত্মক চড়। অর্থনৈতিক সাম্যবাদের দেশে রাশিয়ার ঘরে ঘরে ফ্রিজের মধ্যে রানের রোস্ট নেই, স্ট্যালিনের প্রাসাদের ফ্রিজে আছে। কিন্তু বলার কিছু ছিল না। স্ট্যালিনকে চুপ করে চড়টা হজম করতে হয়েছিল। স্ট্যালিন যখন চার্চিলকে রানের রোস্ট খাওয়াচ্ছিলেন ও খাচ্ছিলেন, তখন তুমুল যুদ্ধ চলছে। হিটলারের বাহিনী মস্কোর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। লক্ষ লক্ষ রাশিয়ান অর্ধাহারে অনাহারে থেকে প্রাণপণে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার সৈনিক প্রচণ্ড শীতে জমে মারা পড়ছে। অনেকটা অনুরূপ অবস্থায় এই শেষ জীবন-ব্যবস্থার নেতারা কী করেছেন তার একটা তুলনা দেয়া দরকার। এই ইসলাম যখন প্রকৃত ইসলাম ছিল- অর্থাৎ বিশ্বনবীর কাছ থেকে যারা সরাসরি শিক্ষা-গ্রহণ করেছিলেন, তাদের অন্যতম, দ্বিতীয় খলিফা ওমরের (রা.) সময় দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। যতদিন দুর্ভিক্ষ ছিল ততোদিন দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষ যেমন অর্ধাহারে অনাহারে থাকে তিনিও তেমনি থাকতেন। ওমর (রা.) প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যতদিন না জনসাধারণ এমন অবস্থায় পৌঁছবে যে তারা ভালো করে খাবার পরও উদ্বৃত্ত থাকবে ততোদিন তিনি গোশত-মাখন এমনকি দুধ পর্যন্ত খাবেন না এবং খানও নি। তিনি বলতেন “আমি যদি ঠিকমত খাই তবে আমি কী করে বুঝব আমার জাতি কী কষ্ট সহ্য করছে?” এই অর্ধাহারে অনাহারে থেকে খলিফা ওমরের (রা.)
মুখ রক্তশূন্য ও চুপসে গিয়েছিল। এই ঘটনা ও ওমরের (রা.) ঐ কথাগুলো ঐতিহাসিক সত্য। (ইসলামের কঠোর বিরুদ্ধবাদী, মহানবীকে (দ.) প্রতারক, ভণ্ড বলে প্রমাণ করা চেষ্টায় প্রথম সারির লেখক স্যার উইলিয়াম মুইর এর Annals of Early Caliphate এর ২৩২-২৩৩ পৃ. দেখুন।)
দু’টো জীবনব্যবস্থা (দীন); দু’টোরই দাবি হচ্ছে মানুষের মধ্যকার অন্যায় অবিচার, বিলুপ্ত করা। দু’টোর নেতাদের মধ্যে অতবড় তফাৎ কেন? সভ্যতার ধ্বজাধারী বর্তমানের কোনো ব্যবস্থার রাষ্ট্রের কোনো প্রধান ওমরের (রা.) ঐ উদাহরণ দেখাতে পারবেন, পেরেছেন? অবশ্যই নয়। কারণ ও দীনগুলি মানুষের সৃষ্ট, ভারসাম্যহীন-একচোখ বিশিষ্ট। ওগুলো মানুষের দেহের ও আত্মার ভারসাম্য করতে পারে নি। রাষ্ট্রের শক্তিতে একটা ব্যবস্থা মানুষের উপর চাপিয়েছে কিন্তু মানুষের আত্মা, হৃদয়কে দোলাতে পারে নি, পারবেও না, তাই ব্যর্থ। এর অকাট্ট্য প্রমাণ হচ্ছে যেসব দেশে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ (ঈড়সসঁহরংস) প্রতিষ্ঠিত সেইসব দেশের সাধারণ নাগরিকদের আচরণ। ঐসব দেশগুলির নেতৃত্বে যারা আছেন তারা ছাড়া বাকি বিরাট অংশ যার যার ‘স্বর্গরাজ্য’ থেকে পালাবার চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল। দেয়াল দিয়ে, কাঁটা তারের প্রাচীর দিয়ে সীমান্ত বন্ধ করে, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর কড়া প্রহরা বসিয়ে, এমন কি সীমান্তে মাইন পেতে রেখেও তাদের ফেরানো যায় নি। গত বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সাম্যবাদের পতন পর্যন্ত ‘স্বর্গরাজ্য’ থেকে পালাবার চেষ্টায় ঐসব দেশের হাজার হাজার লোক প্রাণ দিয়েছে, আহত হয়েছে। কেমন সে স্বর্গ-যেখান থেকে মানুষ পালাবার জন্য জীবন বাজি রাখে, মৃত্যুর ঝুঁকি নেয়!
সত্যিকারের শান্তি, সাম্য, ন্যায়বিচার, বাকস্বাধীনতা, নারী অধিকার, শ্রেণিহীন সমাজ ইত্যাদি না সমাজতন্ত্র দিতে পেরেছে আর না গণতন্ত্র দিতে পেরেছে। এগুলো পূর্ণরূপে দিয়েছে কেবল আল্লাহর রসুলের প্রকৃত ইসলাম। সেই প্রকৃত ইসলাম বিগত ১৪০০ বছরের কালপরিক্রমায় বিকৃত হতে হতে একেবারে বিপরীতমুখী হয়ে গেছে। এখন ইসলাম বলতে মানুষ বোঝে ব্যক্তিগত কিছু আমল। সমগ্র পৃথিবী যখন অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ-বিগ্রহ, ক্ষুধা-দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত তখন মুসলমানরা সেগুলোর চিন্তা না করে কেবল ব্যক্তিগত আমল নিয়ে ব্যস্ত। অথচ পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যার সমাধান করার দায়িত্বই ছিল তাদের। পৃথিবীর কর্তৃত্ব এখন ইহুদি-খ্রিষ্টান বস্তুবাদী সভ্যতার হাতে, তারা মুসলমানদেরকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দেবার ষড়যন্ত্র করছে। একটির পর একটি মুসলিম দেশ তারা ধ্বংস করে দিচ্ছে নানা অজুহাতে। ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লেবানন, লিবিয়া, ফিলিস্তিন, ইয়েমেন ইত্যাদি দেশ এখন ধ্বংসস্ত‚প। এই অবস্থায় মহান আল্লাহ অতি মেহেরবানী করে টাঙ্গাইলের ঐহিহ্যবাহী পন্নী পরিবারের সন্তান মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীকে প্রকৃত ইসলামের রূপ বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন মুসলমানদেরকে এখন যাবতীয় দ্ব›দ্ব, সংঘাত, অনৈক্য, ফেরকা, মাজহাব ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এক কলেমার উপর। সকলকে এই কথার উপর সাক্ষ্য দিতে হবে যে, আমরা আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানব না। তাহলে আমরা যাবতীয় সমস্যার সমাধান করতে পারব ইনশা’ল্লাহ।