ধর্মব্যবসায়ীরা আমাদের সমাজকে অন্যায়-অবিচারমুক্ত করার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে না পারলেও তারা মানুষের মাঝে সহজেই ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করতে অত্যন্ত পটু। এ দক্ষতার প্রমাণ তারা হেযবুত তওহীদের বেলায় বিগত তেইশ বছরে বার বার প্রদান করেছে। ধর্মীয় উন্মাদনা এমন একটি চক্রান্ত যার দ্বারা শত শত মানুষকে হত্যা করে ফেলার পরও আক্রমণকারীরা আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যেতে পারে। এই কৌশলটি তাই ধর্মব্যবসায়ীদের খুবই পছন্দের একটি কৌশল। আমাদের দেশে পীরপন্থী ও মাদ্রাসানির্ভর বহু আন্দোলন গড়ে উঠেছে যারা এই ধর্মোন্মাদনাকেই নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যরে ভিত্তি বানিয়ে নিয়েছে। ধর্মানুভূতিই তাদের একমাত্র অনুভূতি আর ফতোয়াই তাদের একমাত্র অস্ত্র, ধর্মোন্মাদনা সৃষ্টি করে দাঙ্গা বাঁধানোই তাদের শক্তি প্রদর্শনের ক্ষেত্র।
একটা সময় ছিল যখন যেখানেই হেযবুত তওহীদের সদস্যগণ তথা মাননীয় এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর অনুসারীরা আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানানোর জন্য যেতেন, অধিকাংশ স্থানেই তারা ধর্মব্যবসায়ীদের বাধার সম্মুখীন হতেন, আক্রান্ত ও নির্যাতিত হতেন। এভাবেই বহু সদস্য-সদস্যা আহত হয়েছেন, বাড়ি ঘর থেকে উৎখাত হয়ে ছিন্নমূল হয়েছেন। অনেকের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতির কারণে মাননীয় এমামুয্যামান বলতেন, “তোমরা যখন মানুষকে তওহীদের দিকে আহ্বান করতে বাড়ি থেকে বের হবে, শাহাদাতের আকুল তৃষ্ণা নিয়েই বের হবে।” শহীদ সাইফুল্লাহর চিন্তা চেতনায় এর যথার্থ প্রতিফলন ঘটেছিল। এই চিন্তাটি তাঁর মধ্যে সক্রিয় ছিল বলে তিনি বিয়ে পর্যন্ত করেন নি। তার পরিবার ও বন্ধুমহল থেকে বিয়ের কথা উঠলেই তিনি বলতেন, “আমি বিয়ে করব জান্নাতে গিয়ে।” শহীদ হবার দিনও বালাগে বের হবার আগে তিনি সকলের কাছে নিজের শাহাদাতের জন্য দোয়া চেয়েছিলেন।
৫ মে, ২০০৩ প্রকৃত ইসলামের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। প্রকৃত ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ধর্মব্যবসায়ী মোল্লাদের উস্কানিতে ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী রক্তলোলুপ নরপশুদের সঙ্গে প্রাণপণ লড়াই করে আত্মাহুতি দেন একজন প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী। এরপরে হয়তো আরো বহু মানুষ এই সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বে সত্যের পক্ষে আত্মাহুতি দেবেন, কিন্তু প্রথম শহীদ হওয়ার সৌভাগ্য আর কেউ পাবে না।
তখন প্রতি শুক্রবারে সারা দেশের সকল শাখাগুলোতে হেযবুত তওহীদের সদস্যরা ‘প্রকৃত ইসলামের ডাক’ শিরোনামে একটি প্রচারপত্র নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে হাটে মাঠে ময়দানে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিতরণ করতেন। সেদিনও বরিশালের ১৫ জন হেযবুত তওহীদ কর্মী মাদারীপুরের কালকিনী থানার ভুরঘাটা বাসস্ট্যান্ডের নিকটবর্তী এলাকায় চার ভাগে বিভক্ত হয়ে প্রচারপত্র বিতরণ শুরু করেন। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সাইফুল্লাহ। প্রচারকার্যের শেষ পর্যায়ে একজন স্থানীয় লোক হঠাৎ করে একজন হেযবুত তওহীদ সদস্যের শার্টের কলার ধরে চিৎকার করে বলতে থাকে, “তোরা বুশের লোক, তোরা খ্রিষ্টান” ইত্যাদি। সেই সঙ্গে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিতে থাকে। দেখতে দেখতে আরও কিছু লোক তার সাথে এসে যুক্ত হয়। সদস্য কামাল শরীফ ও সাইফুল্লাহ তাদেরকে যথাসাধ্য বুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করেন, কিন্তু তারা তো বোঝার উদ্দেশ্যে বাধা দেয় নি। তাদের পেছনে ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছিল কিছু ধর্মীয় লেবাসধারী ব্যক্তি। তারা স্থানীয় সাধারণ লোকদেরকে উপস্থিত হেযবুত তওহীদ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপবাদ দ্বারা ক্ষেপিয়ে দেয়। এক পর্যায়ে দাঙ্গাবাজ প্রকৃতির জনগণ, সন্ত্রাসী ও ধর্মব্যবসায়ীরা সদস্যদেরকে আক্রমণ করে বসে। তারাও আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন কিন্তু আক্রমণকারীরা সংখ্যায় ছিল প্রচুর। তথাপি তাদের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে আক্রমণকারীরা পিছু হটে। আক্রমণকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে তারা বেশ খানিকটা পথ হেঁটে নিজেদের থানা এলাকা গৌরনদীর সীমানায় চলে আসেন। এমামুয্যামানের নির্দেশ ছিল যে হেযবুত তওহীদের কেউ উদ্যোগী হয়ে মারামারি না করে এবং সেরকম পরিস্থিতি হলে এড়িয়ে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু ইতোমধ্যে শত শত ধর্মোন্মাদ জনতা আবারো সংঘবদ্ধ হয়ে লাঠি, ট্যাটা, রড, দা, সড়কি ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে। তখন আর এড়ানোর কোনো সুযোগ থাকে না। ১৫ জনের সঙ্গে শত শত মানুষের প্রচণ্ড মারামারি ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া আরম্ভ হয়, ফলে মহাসড়কের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এক পর্যায়ে আবারও আক্রমণকারীরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। হেযবুত তওহীদ সদস্যরা আবারও ফেরার পথ ধরেন। কিন্তু হেঁটে আর কতদূর যাওয়া যায়? এরই মধ্যে পিছু হটে যাওয়া যাওয়া সন্ত্রাসী দাঙ্গাবাজেরা আরো শক্তি সংগ্রহ করে দ্বিগুণ শক্তিতে আক্রমণ চালায়। হেযবুত তওহীদের সদস্যরা এবার মরণপণ প্রতিরোধ করেন, ফলে সংঘর্ষ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে।
হেযবুত তওহীদের পক্ষে নেতৃত্বদানকারী সাইফুল্লাহকে একজন সন্ত্রাসী মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করে। তিনি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সদস্য শাহীন ও ইসমাঈল তাকে রক্তাক্ত ও জ্ঞানহীন অবস্থায় কাঁধে করে অনেকটা দূরে নিয়ে যান। এদিকে সংঘর্ষ চলতে থাকে। আক্রমণকারীরা আবারও খানিকটা পিছু হটে যায়। আহত, ক্লান্ত, রক্তাক্ত সদস্যরা অনেকটা পথ পার হয়ে আসেন। কিছুক্ষণ বাদে আবারও তারা পেছন থেকে এসে তাদের উপর আক্রমণ চালায়। এরই মধ্যে সাইফুল্লাহর জ্ঞান ফিরে আসে। তিনি চোখ মেলে দেখতে পেলেন তখনও লড়াই চলছে। সাথে সাথে শাহাদাতের ব্যাকুল পিপাসায় তিনি ছুটে যান সংঘর্ষের একেবারে কেন্দ্রস্থলে। আবারও তার মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করা হয়, আবার তিনি মাটিতে পড়ে যান। তখন তার উপর বৃষ্টির মতো আঘাত নেমে আসতে থাকে। নিষ্ঠুর দাঙ্গাবাজদের উপর্যুপরি আঘাতে একে একে লুটিয়ে পড়েন কামাল শরীফ, ইসমাইলসহ অন্যরা। দুর্বৃত্তরা তাদের নিথর দেহের উপর অতৃপ্ত আক্রোশ মেটানোর জন্য লাঠি ও ধারাল অস্ত্র দিয়ে আঘাত করতে থাকে। তারা পিটিয়ে সাইফুল্লাহর দাত ভেঙ্গে ফেলে এবং কামাল শরীফের পা ভেঙ্গে ফেলে। কামাল শরীফ ছিলেন সাইফুল্লাহর পাশেই। তিনি জ্ঞান হারানোর সময় শুনতে পান সাইফুল্লাহর মৃদুকণ্ঠে উচ্চারিত তওহীদের ঘোষণা – “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ – মোহাম্মাদুর রসুলাল্লাহ (সা.)”।
শত-সহস্র আঘাতে তার দেহ এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত ও বিকৃত হয়ে গিয়েছিল যে তাকে চেনার কোনো উপায় ছিল না। শাহাদাত বরণের ২৭ ঘণ্টা পরও তার দেহ শক্ত (Rigor mortis) হয় নি, মাথার ক্ষতস্থান থেকে তাজা রক্ত ঝরে পড়ছিল। দর্শকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল মহান আল্লাহর বাণী – ‘আল্লাহর রাস্তায় যারা নিহত হয়, তোমরা তাদেরকে মৃত বলো না, তারা জীবিত।’
একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রত্যেকের নিজস্ব মত প্রকাশ ও প্রচারের মৌলিক-সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে, ঠিক সেভাবেই অন্যের অধিকার রয়েছে সেই মত শোনা বা না শোনার, গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যানের। কিন্তু হেযবুত তওহীদকে সেই অধিকার দেওয়া হয় নি, কারণ হেযবুত তওহীদ ধর্মব্যবসায়ীদের কায়েম করে রাখা বিকৃত ইসলামের বিরুদ্ধে প্রকৃত ইসলাম নিয়ে দাঁড়িয়েছে, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মের নামে অপরাজনীতি ও হুজুগ সৃষ্টির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। শহীদ সাইফুল্লাহর কণ্ঠকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিয়েছিলল ধর্মব্যসায়ীয়ের অনুসারীরা। তাদেরই সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছিল প্রশাসনও। নির্মম পরিহাস হচ্ছে, এই মর্মান্তিক ঘটনায় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে নয় উল্টো আক্রান্তদের বিরুদ্ধেই মামলা করা হয়েছিল। ফলে যারা নির্মমভাবে পিটিয়ে সাইফুল্লাহকে শহীদ করেছিল আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আজও তারা নিরাপদে জীবনযাপন করছে, আর চৌদ্দটি বছর মিথ্যা মামলার ঘানি টেনে গেছেন নির্দোষ নিরপরাধ হেযবুত তওহীদের সদস্যরা।