মাননীয় এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর লেখা থেকে
মানুষের স্রষ্টা আল্লাহ দেখলেন, আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে মানুষ জ্ঞান-বুদ্ধি-যোগাযোগ-বিবেক-কৃষ্টি ইত্যাদি এক কথায় বিবর্তনের এমন একটা বিন্দুতে পৌঁছলো সে সমগ্র মানবজাতির জন্য একটি মাত্র জীবন-বিধান গ্রহণ করার জন্য উপযুক্ত, তৈরি হয়েছে। এটা মহান ¯্রষ্টার মহা পরিকল্পনারই একটি অংশ, যে পরিকল্পনা তিনি তার প্রতিনিধি মানুষ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়ই করেছিলেন। মানুষ বিবর্তনের এই বিন্দুতে পৌঁছামাত্র আল্লাহ পাঠালেন মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ (স.)। পূর্ববর্তী প্রেরিতদের মত তাঁর মাধ্যমেও আল্লাহ পাঠালেন সেই দীনুল কাইয়্যেমা-সেরাতুল মোস্তাকীম অর্থাৎ আল্লাহকেই একমাত্র বিধাতা, সার্বভৌম হুকুমদাতা হিসাবে স্বীকার করে নেওয়া। ঐ সেরাতুল মোস্তাকীমকে ভিত্তি করে যে সংবিধান এলো সেটা এবার এলো সমস্ত মানব জাতির জন্য (সুরা আত-তাকভীর ২৭)। আগের মত নির্দিষ্ট কোন জাতি বা গোষ্ঠীর জন্য নয়। এর পরিষ্কার অর্থ হলো এই যে আল্লাহ চান যে বিভক্ত বিচ্ছিন্ন মানব জাতি নিজেদের ভেদাভেদ ভুলে আবার একটি মাত্র জাতিতে পরিণত হোক। কারণ, তারা আসলে গোড়ায় একই বাবা-মা, আদম-হাওয়ার (অফধস-ঊাব) সন্তান অর্থাৎ একই জাতি কারণ তারা একই বাবা মা থেকে সৃষ্ট।
স্বাভাবিক কারণে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো কিন্তু এখন আবার সময় এসেছে এক হয়ে শান্তিতে বসবাস করার অর্থাৎ আল্লাহ চান তাঁর এই প্রিয় সৃষ্টি বনি আদম আবার সকল বর্ণ, সকল ভেদাভেদ ভুলে তারা একটি জাতিতে পরিণত হোক। একটি জাতিতে পরিণত করার জন্য তিনি এমন একটি জীবন-ব্যবস্থা দিলেন, যেটা সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতি নির্ভর অর্থাৎ দীনুল ফেতরাহ। প্রাকৃতিক উপাদান বায়ু থেকে অক্সিজেন, সূর্য থেকে উত্তাপ গ্রহণের ক্ষেত্রে যেমন পৃথিবীর কোন জাতি বর্ণের মধ্যে কোন বৈষম্য নেই, তেমনিভাবে এই দীনটিও সকল এলাকার সকল মানুষ সমানভাবে গ্রহণ করতে পারবে। এই জীবনব্যবস্থা সমানভাবে সকল এলাকার মানুষের প্রয়োজন পূরণ করতে পারবে। নতুন সংবিধানে তিনি বললেন, “হে মানব জাতি! আমি তোমাদের একটি মাত্র পুরুষ ও একটি মাত্র স্ত্রী থেকে সৃষ্টি করেছি। জাতি গোষ্ঠীতে তোমাদের পরিণত করেছি যাতে তোমরা নিজেদের চিনতে পার। তোমাদের মধ্যে যে যত বেশী ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে সতর্ক, অর্থাৎ মোত্তাকী আল্লাহর চোখে সে তত বেশী সম্মানিত। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছুই জানেন। সব কিছুরই খবর রাখেন (সুরা হুজরাত ১৩)। এখানে আল্লাহ তিনটি কথা মানুষকে বলেছেন।
ক) মানুষকে তিনি মাত্র একটি দম্পতি থেকে সৃষ্টি করেছেন অর্থাৎ সমস্ত মানব জাতি একই বংশের একই রক্তের; সুতরাং একই জাতি।
খ) দেহের গঠনে, চামড়ার রংয়ে, ভাষায় ইত্যাদিতে যে বিভক্তি এ শুধু পরিচয়ের জন্য, তার বেশী কিছুই নয়।
এই কথাটা একটু পরিষ্কার করা দরকার। একটি লোকের কয়েকটি সন্তান আছে। সন্তানরা কেউ কালো, কেউ ফর্সা, কেই বাদামী, কেউ লম্বা, কেউ খাটো, কেউ মোটা, কেউ পাতলা। এদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা নাম রাখা হয়। কেন? নিশ্চয়ই পরিচিতির জন্য। আল্লাহ বলছেন ‘মানব জাতিকে শুধু ঐ পরিচিতির জন্যই বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীতে, গায়ের রংয়ে, ভাষায় ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তাছাড়া এটা আল্লাহর সৃষ্টি কৌশলতার এক অনন্য সৌন্দর্য্য। যদি সকল মানুষ সাদা হতো অথবা সকল মানুষ একই উচ্চতার হতো তাহলে সৌন্দর্য্যরে কোন মানদ- থাকতো না, যেমন হাতের ৫টি আঙ্গুল একেকটি একই আকৃতির এবং প্রত্যেকটিরই আলাদা-আলাদা সৌন্দর্য্য এবং কার্যকারিতা রয়েছে। এর মানে এই নয় যে খাট আঙ্গুলটি শ্রীহীন ও কম গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে বিভিন্ন বর্ণের হলেও ঐ লোকটির সন্তানদের মতই পুরো মানবজাতি ভাই-বোন, একই জাতি। অর্থাৎ আল্লাহ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ-বৈষম্য মিটিয়ে দিচ্ছেন।
গ) মানুষে মানুষে তফাতের একটি মাত্র সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিলেন, সেটি হলো ন্যায়-অন্যায়। ভালো-মন্দ দেখে যে যত সতর্ক ভাবে চলবে কাজ করবে- অর্থাৎ যে যত বেশী উন্নত চরিত্রের- সে তত বেশী আল্লাহর কাছে সম্মানিত। এক কথায় আল্লাহ বলছেন মানুষ এক জাতি, কেউ কারো চেয়ে বড় নয়, ছোট নয়, সব সমান। ছোট-বড়র একটি মাত্র মাপকাঠি, সেটি হলো ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠি। সেখানে চামড়ার রংয়ের, ভাষার, কোন দেশে কার জন্ম বা বাস এসবের কোন স্থান নেই। এবং ঐ ন্যায়-অন্যায়ের সংজ্ঞা হচ্ছে সেটা, যেটা আল্লাহ তার সংবিধান কোর’আনে দিয়ে দিয়েছেন। এই আয়াতটি ছাড়াও আল্লাহ কোর’আনের বিভিন্ন স্থানে বলেছেন একই আদম-হাওয়া থেকে সৃষ্ট বলে সমস্ত মানব জাতি এক জাতি। সুতরাং এ কথা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, ভৌগোলিক বা গায়ের রং, ভাষা ইত্যাদি ভিত্তিক জাতি আল্লাহর দেয়া জীবন-ব্যবস্থার সরাসরি পরিপন্থী, উল্টো। একটা হচ্ছে আদর্শের উপর ভিত্তি করে, যে আদর্শ হচ্ছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মোহাম্মাদুর রসুলাল্লাহ’, অন্যগুলি হচ্ছে মানুষের খেয়ালখুশী মত পৃথিবীর বুকের উপর লাইন টেনে গায়ের রংয়ের উপর বা ভাষার উপর ভিত্তি করে। দু’টো একত্রে চলতে পারে না- অসম্ভব, একথা বুঝতে প-িত হবার দরকার নেই।
আজ সারা পৃথিবী জুড়ে চামড়ার রং, ভাষা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করা জাতিগুলি প্রত্যেকটি নিজেদের ছাড়া বাকী মানব গোষ্ঠী থেকে আলাদা, স্বতন্ত্রভাবে দেখে; শুধু স্বতন্ত্রভাবেই দেখে না বর্তমানে এক দেশ আর এক দেশের সঙ্গে শত্রুভাবাপন্নে পরিণত হয়েছে। এর কারণ ঐ সব জাতিগুলির প্রত্যেকটির জাতীয় স্বার্থ বিভিন্ন অর্থাৎ একেক জাতির একেক স্বার্থ। তাদের প্রত্যেকেরই মনোভাব হচ্ছে যে কোন উপায়েই হোক নিজের স্বার্থ রক্ষা করতেই হবে, এতে পাশ্ববর্তী দেশের কত মানুষ হত্যা করতে হবে, কত বাড়ী-ঘর, জনপথ ধ্বংস করা হবে তার কোন হিসাব করার প্রয়োজন নাই, কোন ন্যায়-নীতি, মানবতার বালাই নাই। নিজ দেশের সীমান্তে নদীর গতিপথে বাঁধ দিয়ে অন্যদেশকে মরুভুমিতে পরিণত করে দেওয়া ন্যায়সঙ্গত করে নিয়েছে। মানুষ জীবিকা ও অন্য কোন প্রয়োজনে এই সীমানা অতিক্রমের চেষ্টা করলে সীমান্তরক্ষীদের গুলি তাদেরকে ঝাঁঝরা করে দেয়। অথচ পৃথিবীর এই মাটি থেকে আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই মাটিতেই আবার সকল আদম সন্তানকে ফেরতে যেতে হবে সুতরাং সৃষ্টিগতভাবেই এই মাটির উপর, এই পৃথিবীর উপর মানুষের পূর্ণ অধিকার, হক রয়েছে। মানুষ ইচ্ছা করলে এই পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে যেতে পারে, যে কোন জায়গায় বসবাস করতে পারে। এই পৃথিবী আল্লাহ মানুষের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেছেন মানুষ হচ্ছে পৃথিবীর বুকে তাঁর প্রতিনিধি, খলিফা। এখানে তিনি পৃথিবীর বুকে কোন বিভক্তিরেখা আরোপ করেন নি।
সুতরাং এই সম্পূর্ণ পৃথিবীর উপর প্রতিটি মানুষের সৃষ্টিগত অধিকার। সেই অধিকারবলে এই মাটির সর্বত্র সে যেতে পারে- এই পৃথিবীর যে কোন জায়গায় ন্যায়সঙ্গতভাবে ফসল ফলাতে পারে, কেউ তাকে বাধা দিতে পারে না। এই পৃথিবীর বুকে আল্লাহ যা হালাল করেছেন তা থেকে যার যা খেতে ইচ্ছা করবে তা খেতে পারে, কেউ বাধা দিতে পারে না। অন্যের কোন ক্ষতি না করে, অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না হয় এমন সব কাজ সে করতে পারে। মানুষের ¯্রষ্টা, প্রভু, রব, মালেক আল্লাহ মানুষকে এই অধিকার দিয়ে রেখেছেন, দাজ্জালীয় সভ্যতা এসে মানুষের যাবতীয় অধিকার হরণ করেছে বিভিন্ন সীমারেখা, বিধি-নিষেধ আরোপ করে। ফলে মানুষের মধ্যে স্থায়ী সংঘাত, সংঘর্ষের রূপ নিয়েছে, এই সংঘর্ষের প্রবণতা সব চেয়ে বেশী প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে, একথা যে কোন সময়ে পৃথিবীর রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইতিহাস লক্ষ্য করলেই পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। কারণ ঐ একই। ‘মানুষ এক জাতি’ আল্লাহর এই কথা অস্বীকার করে পৃথিবীর বুকের উপর খেয়াল খুশী মত দাগ দিয়ে, লাইন টেনে, চামড়ার রংয়ের উপর ভাষার উপর ভিত্তি করে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে চিরস্থায়ী সংঘাত-সংঘর্ষ-রক্তপাত ও যুদ্ধের ব্যবস্থা করা। যতদিন মানুষের তৈরি এই জীবনব্যবস্থা পৃথিবীতে চালু থাকবে, ততদিন মানুষে-মানুষে, জাতিতে-জাতিতে অশান্তি, যুদ্ধ রক্তপাত কেউ বন্ধ করতে পারবেন না। শত লীগ অব নেশনসও (League of Nations) নয়, শত জাতিসংঘ ও (United Nations) নয়।
মালয়েকরা মানুষ তৈরির বিরুদ্ধে যে যুক্তি দিয়েছিলেন; ইবলিস মানুষকে দিয়ে যা করাবে বলে চ্যালেঞ্জ দিয়েছে- অর্থাৎ সেই ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা- অশান্তি, অন্যায়, রক্তপাত ও যুদ্ধ যাতে চলতে থাকে সেজন্য শয়তানের হাতে যত অস্ত্র আছে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান অস্ত্র হোচ্ছে এই ভূগোল, চামড়ার রং, ভাষা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে মানব জাতিকে বিভক্ত করা। এবং এই জন্যই এই ব্যবস্থা শেষ এসলামে কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। এই ব্যবস্থা মানুষ জাতির কত অশান্তি, অন্যায়, অবিচার, রক্তপাত, যুদ্ধ, অশ্রু ও ভগ্ন হৃদয়ের কারণ হয়েছে- হচ্ছে, তা সমুদ্রের মত সীমাহীন।
(সম্পাদনায়: মুস্তাফিজ শিহাব, সহকারী সাহিত্য সম্পাদক, দৈনিক বজ্রশক্তি)