মুস্তফিজ শিহাব
একটি মুদ্রার সর্বদা দুটি পিঠ থাকে -এ কথাটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। এর ভাবার্থও খুবই গভীর। প্রতিটি বস্তুর ব্যবহারের মধ্যেই দুটো দিক থাকে- ভালোমন্দ, ডান ও বামের ভারসাম্য নিয়েই জগৎ।
একজন ব্যক্তি যিনি প্রচুর সম্পদের মালিক, সারাজীবন কষ্ট করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন যাতে শেষ জীবনে সুখে সে সম্পদ ভোগ করতে পারেন। বাইরে থেকে তাকে হয়তো অনেক সুখী দেখছেন কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখুন, তার বড় ছেলে আজ মাদকের নেশায় বুঁদ। ছোট মেয়েটি বেসুমার টাকা হাতে পেয়ে নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে আমোদ-প্রমোদ করছে। স্ত্রীর দুর্বব্যবহার তাকে পারিবারিক জীবনকে তিক্ত করে তুলেছে। সুতরাং সম্পদের পাহাড় তাকে সুখী করতে পারছে না। একই মুদ্রার দুটো পিঠ দুই রকম।
অপর একজন লোকের সুন্দরী আধুনিকা স্ত্রী আছেন। সবাই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সবাই তাকে ঈর্ষার দৃষ্টিতে দেখে আর হায় আফসোস করে। কিন্তু তাদের জীবনেও ভিন্ন প্রেক্ষাপট আছে। কারণ তার স্ত্রী আত্মগরিমায় এতটাই উন্নতনাসিকা যে রান্নাবান্না, ঘর-সংসারের কাজে তার কোনো আগ্রহ নেই। ভদ্রলোক নিজের স্ত্রীর হাতের রান্নার স্বাদ থেকে বঞ্চিত, গার্হস্থ সুখ তার কপালে জুটলো না। স্ত্রীর সেবাযত্ন কী সেটা তিনি জানতেও পারলেন না। অন্যের সেবাপরায়ণা কিন্তু কুরূপা স্ত্রীর দিকে তিনি ঈর্ষান্বিত চোখে তাকিয়ে থাকেন। একই মুদ্রার দুটো পিঠ দুরকম।
এভাবে আরো উদাহরণ দেয়া যাবে যেখানে আপনি দেখবেন যে মুদ্রার বরাবরই দুটো পিঠ রয়েছে। এক পিঠ দেখে কখনই সম্যক ধারণা লাভ করা যায় না। একই ভাবে বর্তমানের দাজ্জালীয় সভ্যতারও দুইটি বিপরীত দিক রয়েছে। আমরা সম্পূর্ন মুদ্রাটিকে না দেখে শুধু এক পিঠ দেখছি এবং এই অজ্ঞতাই আমাদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানের দাজ্জালীয় সভ্যতাকে ‘সভ্যতা’ না বলে বরং যান্ত্রিক প্রগতি বলাই শ্রেয় কারণ এ সভ্যতার যা কিছু সভ্য সেগুলো সবই প্রতারণামূলক, মেকি আর কপটতায় পূর্ণ। আপনি আমার সাথে দ্বিমত করতে পারেন যে না, যারাই এ সভ্যতায় উন্নতি লাভ করেছে তারাই সুখ ও শন্তিও পেয়েছে, যারা উন্নতি করতে পারে নি তারাই শুধু পিছিয়ে রয়েছে। কিন্তু আমি বলবো এ ধারণা ভুল। এ সভ্যতা আমাদের একদিকে যেমন বস্তুতান্ত্রিক উন্নতি দিয়েছে তেমনি অপরদিকে এমন একটি সমাজ দিয়েছে যে সমাজের মানুষের মাঝে দয়া, মায়া, ভ্রাতৃত্ব নেই, নেই কোন সুখ-শান্তি। বস্তুগত উন্নয়নের জন্য একজন মানুষ তার মনুষ্যত্বকে বিকিয়ে দিয়ে পশুর চেয়েও নিচে নামতে পারে।
সভ্যতা এই শব্দটি এসেছে ‘সভ্য’ থেকে। সভ্য বলতে বোঝায় ভদ্র, শিষ্ট, মার্জিত, সুরুচিসম্পন্ন, ভাল (civilian, polite, courteous, mannerly) ইত্যাদি। ভাল মন্দের বিবেচনার পর ভালকে গ্রহণ করে ও মন্দকে বর্জন করেই ধীরে ধীরে একটি সভ্যতা (Civilization) গড়ে উঠে। বর্তমান সভ্যতায় এই চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্তের জায়গায় দাজ্জাল তথা বস্তগত ইহুদি খ্রিষ্টান ‘সভ্যতা’ বসে রয়েছে। এর ফলে ব্যক্তিগত দিক থেকে তারা যেমন নৈতিকতাহীন, আত্মাহীন হয়ে পড়েছে তেমনি রাষ্ট্রগতভাবে যুদ্ধ, দলগত হানাহানি করে ক্রমে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। আপনারা এ সভ্যতার যান্ত্রিক প্রগতি দেখছেন কিন্তু এর অপর পিঠটিও আপনাদের বিবেচনায় আনা উচিত। প্রতিটি দেশে আজ খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ ইত্যাদি চ‚ড়ান্ত রূপ ধারণ করেছে। প্রতিটি মানুষ এই সভ্যতার নামে চলা অসভ্যতার শিকারে পরিণত হয়েছে। মানুষ তার মেধাকে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ফলে অর্জিত উন্নতিকে মানুষের ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করছে। আত্মার নিদারুণ পতনের সঙ্গে বিজ্ঞানের প্রযুক্তির (Technology) ধ্বংসকারী শক্তির যোগের পরিণতি চিন্তা করে মানুষ আজ শিউরে উঠছে। একদিকে বস্তুগত উন্নতি এবং অন্যদিকে এরই বিপরীতভাবে নৈতিক অবক্ষয় সমান তালে বেড়েই চলেছে। আমরা মুদ্রার এক পাশ দেখে এ সভ্যতার গুণগান গাইলেও অপর পিঠ দেখে অনেকেই শিউরে উঠছে।
তাহলে এখন আমাদের করণীয় কী? আমাদের মঙ্গলের জন্য, আমাদের সুখের জন্য, শান্তির জন্য, মানবজাতির কল্যাণ ও প্রগতির জন্য, মানবজাতি ও পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য ভাল-মন্দের চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য একটি কর্তৃপক্ষকে মানতেই হবে। যেকোনো জীবনব্যবস্থাতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার জন্য একটি স্থান থাকতে হয় অন্যথায় মানবজাতি যদি যে কোন সমস্যার সমাধানের জন্য আলোচনায় বসে তবে তা অনন্তকাল চলতে থাকবে। এ সিদ্ধান্ত নেবার ও দেবার কর্তৃত্ব ও অধিকার হচ্ছে সার্বভৌমত্ব (Sovereignty)। এই সার্বভৌমত্ব দুই রকমের হতে পারে। যিনি সৃষ্টি করেছেন অর্থাৎ স্রষ্টার অথবা সৃৃষ্টির নিজের। বর্তমানে দাজ্জালীয় সভ্যতার মাধ্যমে সার্বভৌমত্ব চলছে সৃষ্টির নিজের। তাই এখন আমাদের স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব মেনে নিতে হবে। সেই চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্তের জায়গা থেকে দাজ্জালকে সরিয়ে আল্লাহকে বসাতে হবে। তবেই আমরা এ সভ্যতার নামের অসভ্যতার বেড়াজাল থেকে মুক্তি লাভ করতে পারবো।