এম. আমিনুল ইসলাম
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আদম তথা আমাদেরকে সৃষ্টি করে তাঁর নিজের রুহ থেকে ফুঁকে দিলেন। যে কারণে আল্লাহর সমস্ত সিফত্ তথা গুণাবলী আমাদের ভিতরে চলে এসেছে যদিও খুবই সামান্য পরিমাণে। আল্লাহর অন্যতম একটি সিফতি নাম ওয়াহ্হাব অর্থাৎ মহাদাতা। এই মহাসৃষ্টির প্রত্যেকটি অণু পরমাণু আল্লাহর দানেরই ফসল। যে কারণে স্বভাবগতভাবে মানুষ দানশীল হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাছাড়াও দানের উদ্দেশ্য, আকিদা ও গুরুত্বের বর্ণনার পাশাপাশি দান করার জন্য আল্লাহ সরাসরি হুকুম দিয়েছেন (সুরা নাহল- ৯০), যার মাধ্যমে দান করা মো’মেনের জন্য ফরদ হয়ে যায়। রসুলাল্লাহ (সা.) বলেছেন, “আল্লাহ বলেন, হে আদম সন্তান! তুমি দান কর, আমি তোমাকে দান করব [আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বোখারি ও মুসলিম]।” হাদিসে আরও উল্লেখিত আছে যে, হাশরের মাঠে দান মো’মেনের জন্য ছায়াস্বরূপ হবে। এ ছাড়া দান আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থার অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
দানের সংজ্ঞা:
দান মানেই মানুষের কল্যাণার্থে কোনো কিছু বিনাশর্তে প্রদান করা, যা কখনোই ফেরতযোগ্য নয়। যদিও আল্লাহ তাঁর নিজ অনুগ্রহে বান্দার এই দানকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেন। শুধু নগদ অর্থ নয়, নিজের অধিকারভুক্ত যেকোনো কিছুই দানের বিষয়বস্তু হতে পারে। রসুলাল্লাহর হাদিস মোতাবেক নিজের পোষ্যদের জন্য ব্যয় করা, আত্মীয়তা রক্ষার জন্য ব্যয় করা, মানুষকে বিপদে আশ্রয় দেওয়া, কারো জন্য দোয়া করা, কোনো ক্ষুধার্ত প্রাণীকে খাদ্য দেওয়া, পথ-সন্ধানীকে পথ দেখিয়ে দেওয়া, পতিত জমিতে আবাদ করা, কোনো মো’মেন ভাইয়ের প্রতি হাস্যমুখ করা, কাউকে সৎ কাজের উপদেশ দেওয়া, অসৎ কাজ হতে নিষেধ করাও দান, পথের থেকে কাঁটা সরিয়ে দেওয়াও একটি দান। এক কথায় বলতে গেলে, প্রত্যেক পুণ্য কাজই মো’মেনের জন্য এক একটি দান যদি সেই কাজে আল্লাহর কোনো সৃষ্টি উপকৃত হয়।
আল্লাহর রাস্তায় দান
মানবজাতি তথা আল্লাহর সৃষ্টির কল্যাণ সাধনে প্রত্যেকটি কাজেরই আল্লাহ প্রতিদান দিয়ে থাকেন, এটা দুনিয়াতেও আখেরাতেও। দান যেহেতু আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা এবং জারি রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে সেহেতু দানের প্রতিদান আল্লাহ দিবেন এটা সহজ কথা। আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রামে দানকে আল্লাহ করযে হাসানা হিসাবে উল্লেখ করেছেন এবং দানকারীকে দানের চেয়ে বহুগুণ বেশি পরিমাণে প্রতিদান দেওয়ার ওয়াদা দিয়েছেন (সুরা বাকারা- ২৪৫, হাদিদ- ১১)। তাছাড়া দানকারী পুরুষ ও নারীদেরকে বহুগুণ বেশি ছাড়াও সম্মানজনক পুরস্কার প্রদান ও ক্ষমার আশ্বাস দিয়েছেন (সুরা হাদিদ ১৮, তাগাবুন- ১৭)। পক্ষান্তরে দানের বিপরীতে যারা কৃপণতা করে এবং অন্যকে কৃপণতার নির্দেশ দেয় তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, আল্লাহ অভাবমুক্ত (সুরা হাদিদ- ২৪), আল্লাহ তাদের জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন (সুরা নেসা- ৩৭), আর লোক দেখানো দানকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন না এবং শয়তানের সঙ্গী হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন (সুরা নেসা- ৩৮)। পাশাপাশি এটাও জানিয়েছেন যে, যারা আল্লাহর পথে নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, দানের কথা বলে বেড়ায় না এবং দান গ্রহণকারীকে খোটাও দেয় না তাদের পুরস্কারতো আছেই, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না (সুরা বাকারা- ২৬২, ২৭৪)। যারা দানের কথা বলে বেড়ায় এবং দান গ্রহণকারীকে কষ্ট দেয় তাদের দানকে আল্লাহ নিষ্ফল করে দেন এবং লোক দেখানো দান বলে অখ্যায়িত করেছেন এমনকি আল্লাহ তাদেরকে মো’মেন হিসাবেও স্বীকৃতি দেননি। আর তাদের উপমা দিয়েছেন একটি মসৃণ পাথরের সাথে যার উপর কিছু মাটি থাকে; অতঃপর প্রবল বৃষ্টিপাতে উক্ত পাথরকে পরিষ্কার করে ফেলে, ফলে দানের কারণে তারা যা কিছু অর্জন করেছিল তা নিষ্ফল হয়ে যায় (সুরা বাকারা- ২৬৪)।
দান করার সময়:
দান করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই, এটা প্রয়োজনীয়তার উপর নির্ভরশীল। দানকারী যেমন নিজের জান-মাল পরিশুদ্ধকরণ, বিপদ-আপদ ও পাপ থেকে মুক্তি ও আল্লাহর ক্ষমা পেতে দান করেন তেমনি গ্রহণকারীও প্রয়োজনবোধে দান গ্রহণ করেন। প্রকাশ্য ও গোপনে, দিনে ও রাতে যখন তখন দান করা যায় (সুরা বাকারা- ২৭১, ২৭৪)। রসুলের হাদিসেও উল্লেখ রয়েছে যে, আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে ভালোবাসেন, যে ব্যক্তি ডান হাতে কিছু দান করে এবং গুপ্ত রাখে (আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে তিরমিযি)।
দানের উপকারিতা:
দানের কারণে দৃশ্যমানভাবে সমাজের অস্বচ্ছল দরিদ্রশ্রেণি যেমন উপকৃত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে তেমনি অদৃশ্য অনেক উপকারিতাও আছে যা মো’মেন মাত্রই বুঝতে সক্ষম। যেমন- দানের কারণে আল্লাহ পাপ মোচন করেন (সুরা বাকারা- ২৭১), আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ হয়, দানকারীর আত্মা বলিষ্ঠ হয় (সুরা বাকারা- ২৬৫)। দানকারীদেরকে আল্লাহ মোত্তাকী এবং তাদের এই কাজকে সৎকর্ম হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন (সুরা এমরান- ১৩৩, ১৩৪)। দানকে আল্লাহর সান্নিধ্য ও রাসুলের দোয়া লাভের উপায় হিসাবেও সাব্যস্ত করেছেন (সুরা তওবা- ৯৯)। আত্মশুদ্ধির জন্য দানকারীদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে দূরে রাখার ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের ঘোষণা দিয়েছেন (সুরা লাইল- ১৭-২১)। দানের উপকারিতা প্রসঙ্গে রসুলাল্লাহ (সা.) বলছেন, “দাতা ব্যক্তি আল্লাহর কাছে, জান্নাতের কাছে, মানুষেরও কাছে অথচ জাহান্নাম হতে দূরে এবং কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহ হতে দূরে, জান্নাত হতেও দূরে, মানুষ হতেও দূরে অথচ জাহান্নামের অতি কাছে। নিশ্চয় মূর্খ দাতা কৃপণ সাধক অপেক্ষা আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় (আবু হুরায়রাহ থেকে তিরমিযি)। দান আল্লাহ পাকের রোষ প্রশমিত করে এবং মন্দ মৃত্যু রোধ করে (আনাস রা . থেকে তিরমিযী)।”
দানের বৃদ্ধির উপমা:
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মানুষ যে সকল সৎকর্ম করে তার মধ্যে ‘দান’ একমাত্র বিষয় যা মানুষকে পার্থিব এবং অপার্থিবভাবে সম্পদশালী করে তোলে। দানের কারণে মানুষ সবসময় আল্লাহর রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় পায়, তাকে বিপদ-আপদ, রোগ-শোক ইত্যাদি আক্রমণ করতে পারে না, তদুপরি দুনিয়ার সম্পদে সে হয়ে যায় কৃপণদের চেয়ে সম্পদশালী। আল্লাহ দানকারীদের উপমা দিয়েছেন শস্যবীজের সাথে, যেমন একটি শস্যবীজ সাতটি শীষ উৎপাদন করে, প্রত্যেক শীষে থাকে একশত শস্যদানা (সুরা বাকারা- ২৬১)। এভাবে দ্রæতগতিতে দানকারীর সম্পদ বাড়তে থাকে।
উৎকৃষ্ট বস্তু দান করা:
মহান আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে মানুষকে অকৃতজ্ঞ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ, মানুষের প্রতি আল্লাহ যে অফুরন্ত রহমত, বরকত, দয়া, করুণা বর্ষিত হয় সে মোতাবেক সে অল্পই আল্লাহকে স্মরণ করে। মানুষের অধিকারে থাকা প্রত্যেকটি সম্পদই আল্লাহর দান কিন্তু যখনই আল্লাহর পথে ব্যয় করার ডাক আসে তখন মানুষ তার সম্পদের নিকৃষ্টতম বস্তুটিই দান করতে এগিয়ে আসে। সে জন্য আল্লাহ উৎকৃষ্ট বস্তুই দান এবং নিকৃষ্ট বস্তু দান করার সংকল্প করা থেকেও দূরে থাকতে (সুরা বাকারা-২৬৭) এবং নিজেদের প্রিয় জিনিস দান করতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন (সুরা আলে এমরান-৯২)। যে জিনিস নিজে গ্রহণ করবে না, বা ইতস্তত করবে সেটা দান করা থেকে বিরত থাকাই বাঞ্ছনীয়। রসুলাল্লাহও এক মো’মেনের প্রতি আরেক মো’মেনের অধিকার বর্ণনা করতে গিয়ে নিজের জন্য যা পছন্দ করবে অপরের জন্যও তা-ই পছন্দ করার তাগিদ দিয়েছেন।
দান করতে হবে দ্রুত:
মানুষ মরণশীল, এটা নীতিবাক্য নয়, অবধারিত সত্য এবং এই মৃত্যুর সঠিক সময় একমাত্র আল্লাহই জানেন। সেই হিসাবে চলমান সময়ের প্রত্যেকটি মুহূর্তই মানুষের জন্য মৃত্যুসম। এজন্য আল্লাহ বলছেন, “হে মো’মেনগণ! আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছি তা হতে তোমরা ব্যয় কর সেই দিন আসিবার পূর্বে, যেই দিন ক্রয়-বিক্রয়, বন্ধুত্ব ও সুপারিশ থাকবে না (সুরা বাকারা ২৫৪)। আমি তোমাদেরকে যে রেযেক দিয়েছি তোমরা তা হতে ব্যয় করবে তোমাদের কারো মৃত্যু আসার পূর্বে। অন্যথায় মৃত্যু আসলে সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আরও কিছু কালের জন্য অবকাশ দিলে আমি সাদকা দিতাম এবং সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত হতাম (সুরা মোনাফেকুন- ১০)।” এ প্রসঙ্গে রসুলাল্লাহ বলছেন, “তাড়াতাড়ি দান কর, কেননা তোমাদের প্রতি এমন সময় আগমন করেছে, যে সময় মানুষ আপন দান নিয়ে ফিরবে, (কিন্তু গ্রহণকারী বলবে) দান গ্রহণ করতাম কিন্তু আজ আমার প্রয়োজন নেই (হারেসা ইবনে ওহব থেকে বোখারি ও মুসলিম)। তোমরা দানের ব্যাপারে তাড়াতাড়ি করবে। কেননা, বিপদ-আপদ তাকে অতিক্রম করতে পারে না (আলি রা. থেকে রাযিন)। যে মৃত্যুকালে দান করে অথবা দাস-দাসী আযাদ করে, তার উদাহরণ সে ব্যক্তির মতো যে পেট ভরে খাওয়ার পর হাদিয়া দেয় (আবু দারদা থেকে, আহমদ, তিরমিযি, নাসাঈ, দারেমী)।”
দান করার নীতি:
মহান আল্লাহ আমাদেরকে ভারসাম্যপূর্ণ জাতি হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর সৃষ্টির প্রত্যেকটি বিষয়বস্তুই ভারসাম্যপূর্ণ, প্রাকৃতিক। এই ভারসাম্য একদিকে নষ্ট হলে অপরদিকেও আঘাত করবে এবং আল্লাহর সৃষ্টিতে বিঘœ ঘটাবে। এ কারণে আল্লাহ দান করার ক্ষেত্রেও ভারসাম্য রক্ষা করতে বলেছেন, “তুমি তোমার হস্ত তোমার গ্রীবায় আবদ্ধ করে রেখো না এবং তা সম্পূর্ণ প্রসারিতও করো না। তাহলে তুমি তিরষ্কৃত ও নিঃস্ব হয়ে পড়বে (সুরা বনী ইসরাইল- ২৯)।” আবার একেবারে কড়ায় গণ্ডায় হিসেব করেও দান করতে রসুল নিষেধ করছেন, “দান করতে থাকবে এবং হিসাব করবে না যাতে আল্লাহ তোমাকে দান করতে হিসাব না করেন। ধরে রাখবে না যাতে আল্লাহ তোমার ব্যাপারে ধরে না রাখেন। তোমার সামর্থ্য অনুসারে সামান্য হলেও দান করবে (আসমা বিনতে আবু বকর থেকে বোখারি ও মুসলিম)।” আবার নগণ্য উসিলায় যেন দান করা থেকে বিরত না থাকে সেজন্য রসুলাল্লাহ বলছেন, “হে নারী সমাজ! তোমরা দান কর যদি তোমাদের গহনা হতেও হয় (যয়নব রা. থেকে বোখারি ও মুসলিম)।”
সম্পদ জমা করার প্রতিফল:
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। অর্থনীতি হলো জীবনব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ। ইসলামী অর্থনীতির মূল কথা হলো সম্পদ জমা করা নয়, খরচ করা, ব্যয় করা। কারণ, একটা সম্পদ যত বেশি লোকের হাতে যাবে ঐ সম্পদ দিয়ে তত বেশি লোক উপকৃত হবে। এ কারণে, ব্যয় না করে যারা জমা করে তাদের জন্য আল্লাহর কঠোর সতর্কবাণী যে, “আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জিভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও। যেদিন জাহান্নামের অগ্নিতে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে, সেদিন বলা হবে, এটাই হচ্ছে তা যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জিভূত করতে। সুতরাং তোমরা যা পুঞ্জিভূত করেছিলে তা এবার আস্বাদন কর (সুরা তাওবা- ৩৪, ৩৫)।” দুর্ভোগ প্রত্যেকের, যে পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে, যে অর্থ জমায় ও তা বার বার গণনা করে, সে ধারণা করে যে, তাহার অর্থ তাকে অমর করে রাখবে, কখনও না, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে হুতামায় (সুরা হুমাযা- ১-৪)।”
যারা কৃপণতা করে তাদের পরিণাম:
আল্লাহ মানুষকে তাঁর রঙে রঙিন হতে বলেছেন, তার মানে তাকে দয়া, মায়া, মমত্ববোধ, উদারতা, মহানুভবতা, দানশীলতা ইত্যাদি আল্লাহর গুণাবলীতে নিজেকে গুণান্বিত করতে হবে। তেমনি কৃপণতা, দারিদ্র্যের ভয়, হতাশা এগুলা হলো ইবলিসের গুণ। যে কারণেই হোক, যারা কৃপণতা করবে তারা ইবলিসের অনুসারী, তারা আল্লাহর লানতের পাত্র হবে। তাদের প্রতি আল্লাহ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন যে, “তোমরাই তো তারা যাদেরকে আল্লাহর পথে ব্যয় করতে বলা হয়েছে অথচ তোমাদের অনেকে কৃপণতা করছ। যারা কার্পণ্য করে তারা তো কার্পণ্য করে নিজেদের প্রতি। আল্লাহ অভাবমুক্ত এবং তোমরাই অভাবগ্রস্ত। যদি তোমরা বিমুখ হও, তিনি অন্য জাতিকে তোমাদের স্থলবর্তী করবেন, তারা তোমাদের মতো হবে না (সুরা মুহাম্মদ- ৩৮)।” কৃপণতাকে ধিক্কার দিয়ে রসুলাল্লাহ বলেছেন, “তোমরা কৃপণতা হতে বেঁচে থাকবে, কেননা, কৃপণতা ধ্বংস করেছে তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে। কৃপণতা তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছে রক্তপাতের প্রতি এবং হারামকে হালাল করার প্রতি, তারা দুনিয়া ও আখেরাত উভয়লোকে ধ্বংস হয়েছে (যাবের ইবনে আবদুল্লাহ থেকে মুসলিম)।”
সব দান সমান নয়:
কারও দুঃসময়ে দান আর সুসময়ে দান এক নয়। আল্লাহ বলেন, “তোমরা আল্লাহর পথে কেন ব্যয় করবে না? আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর মালিকানা তো আল্লাহরই। তোমাদের মধ্যে যারা মক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে তারা এবং পরবর্তীরা সমান নয়। তারা মর্যাদায় তাদের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ যারা পরবর্তীকালে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে। তবে আল্লাহ উভয়ের কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন (সুরা হাদিদ- ১০)।”
দানকারীর প্রতিদান ও কৃপণের সর্বনাশ:
রসুলাল্লাহ বলেছেন, “যখনই আল্লাহর বান্দাগণ ভোরে জাগ্রত হয় তখন আকাশ হতে দুজন মালায়েক অবতীর্ণ হন। তাদের একজন বলেন, হে আল্লাহ! তুমি দাতাকে প্রতিদান দাও এবং অপরজন বলেন, হে আল্লাহ! তুমি কৃপণকে সর্বনাশ দাও (আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বোখারি ও মুসলিম)।”
কৃপণতা মো’মেনের স্বভাব নয়:
মর্যাদাবান প্রত্যেকটি বিষয়ের সাথে আল্লাহ এবং তাঁর রসুল যেমন সম্পর্কিত তেমনি আল্লাহর মো’মেন বান্দাও সম্পর্কিত। কৃপণতা আল্লাহর স্বভাব নয়, রসুলের স্বভাব নয় তেমনি আল্লাহ ও রসুলের অনুগত কোনো মো’মেনেরও স্বভাব নয়। তাই রসুলাল্লাহ বলছেন, “এ দু’টি স্বভাব মো’মেনের মধ্যে একত্রিত হতে পারে না, কৃপণতা ও দুর্ব্যবহার (আবু সাইদ খুদরী থেকে তিরমিযি)। আমি কি তোমাদের বলব না সর্বাপেক্ষা মন্দ স্তরের ব্যক্তি কে? সে ব্যক্তি যার কাছে আল্লাহর নামে কিছু চাওয়া হয় আর সে তাঁর নামে কিছু দেয় না (ইবনে আব্বাস রা. থেকে আহমদ)।”
দান কাকে করবে:
দানের মধ্যে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যয়কৃত দানকেই আল্লাহ ও তাঁর রসুল সর্বোত্তম দান হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং এই দানকে আল্লাহ করযে হাসানা হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এই দানকারীকেই আল্লাহ বহুগুণে বৃদ্ধি করা, পাপ মোচন করা, আল্লাহর সান্নিধ্য ও সন্তুষ্টি অর্জন করা, আল্লাহর ক্ষমা ও মহাপুরস্কার প্রদানের ওয়াদা দিয়েছেন। কারণ, এই দানের কারণে আল্লাহ ইবলিসের চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হন, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, আল্লাহর মহা-পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হয়, সর্বোপরি আল্লাহর অতি আদরের সৃষ্টি মানুষ সুখে-শান্তিতে ও নিরাপত্তায় বসবাস করতে পারে। এ কারণে আল্লাহ দান পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, যিনি আল্লাহর পথে সংগ্রামে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত, আয়-রোজগার করার সুযোগ নেই এবং মানুষের কাছে ভিক্ষাও করে না, আল্লাহর ভাষায়, “এটা প্রাপ্য অভাবগ্রস্ত লোকদের; যারা আল্লাহর পথে এমনভাবে ব্যাপৃত যে, দেশময় ঘোরাফেরা করতে পারে না। ভিক্ষা না করার কারণে অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে অভাবমুক্ত বলে মনে করে। তুমি তাদের লক্ষণ দেখে চিনতে পারবে। তারা মানুষের নিকট নাছোড় হয়ে ভিক্ষা করে না।” (সুরা বাকারা- ২৭৩)।
রসুলাল্লাহ এবং তাঁর আসহাবদের উল্লেখযোগ্য দান:
মানবজাতির দুনিয়াতে শান্তি ও আখেরাতে মুক্তির জন্য আল্লাহ যে বিধান দিয়েছেন রসুলাল্লাহ সেটিই তাঁর নিজের ও আসহাবদের সামগ্রিক জীবনে প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন যে, ইসলাম এটা, ইসলামের এই কাজ এভাবে করতে হয়। রসুলাল্লাহ একজন উৎকৃষ্ট দানশীল ছিলেন এ কথাটা অন্যভাবে বললে বলতে হয়, রসুলাল্লাহর মাধ্যমে তাঁর জাতি দানশীলতা দেখতে পেয়েছে এবং এই মহৎ গুণটা অর্জন করতে পেরেছে। যিনি নিজের অর্জিত সহায় সম্পত্তি, তাঁর প্রথম স্ত্রী উম্মুল মো’মেনিন খাদিজা (রা.) এর সম্পত্তি, নিজের পারিবারিক ঐতিহ্য, ইজ্জত, সম্মান, গুরুত্বপূর্ণ সময়, অক্লান্ত পরিশ্রম, অপরিসীম মেধা, আল্লাহর থেকে দেয়া যুদ্ধলব্ধ সম্পদ, এমনকি যুদ্ধের ময়দানে পবিত্র দেহের রক্ত ঝরানোসহ সকল কিছু দান করে গেছেন মানবতার কল্যাণের জন্য, মুক্তির জন্য, শান্তির জন্য। তাঁর পৃথিবী থেকে চলে যাবার সময়ে নয়টি তরবারিসহ কয়েকটি যুদ্ধের উপকরণ ছাড়া পার্থিব কোনো সম্পদ তিনি রেখে যাননি, সেগুলোও তিনি আল্লাহর রাস্তায় দান করে গেছেন। দানের ক্ষেত্রে এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। যারা আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ রসুলের সাহাবি হয়েছেন তাদের চরিত্রেও একই ধারা প্রবাহিত হয়েছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। যেমন, রসুলের জীবনের সবচেয়ে বড় অভিযান হয়েছে তাবুক অভিযান। এই অভিযানে রসুলাল্লাহ তাঁর জাতির কাছে আল্লাহর রাস্তায় পূর্ণভাবে জান-মাল দিয়ে অংশগ্রহণ করার প্রস্তাব দিলেন। সাহাবিদের সকলেই যথাসাধ্য রসুলাল্লাহর প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছেন কিন্তু আবু বকর (রা.) রসুলাল্লাহর এই প্রস্তাবে সাড়া দিলেন ভিন্ন আঙ্গিকে যা পরবর্তীদের জন্য একটি কালজয়ী উদাহরণ হয়ে থাকলো। তিনি ঘরে ব্যবহার্য পার্থিব যে সম্পদ ছিল অর্থাৎ হাড়ি-পাতিল, থালা-বাসন ইত্যাদিসহ সবকিছু নিয়ে রসুলাল্লাহর দরবারে হাজির হলেন। তিনি ঘরে কী রেখে এসেছেন জিজ্ঞাসিত হলে বললেন যে, তিনি আল্লাহ এবং তাঁর রসুলকে রেখে এসেছেন। তাঁর প্রদত্ত সম্পদের আর্থিক মূল্যমান ছিল নগণ্য কিন্তু আত্মিক মূল্যমান ছিল বিশাল। এই দানের প্রকৃত মূল্য বুঝতে পেরেছিলেন রসুলাল্লাহ। যে কারণে অন্যান্য সাহাবিরা অনেক বেশি সম্পদ দিলেও দানে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন আবু বকর (রা.)। আবার একজন সাধারণ শ্রমিক সাহাবি, তার দেবার মতো কিছুই নেই। দূরের এক বাগানে সারারাত কুয়া থেকে পানি তুলে গাছে দিয়ে সকালে কিছু খেজুর মজুরি হিসেবে পেলেন। অর্ধেক সংসারের জন্য রেখে বাকি অর্ধেক নিয়ে রসুলের কাছে এলে রসুল বললেন, ‘এ খেজুরগুলি সবচেয়ে ভারি, সব মালের উপর ছড়িয়ে দাও।’ যার দেওয়ার মতো কিছুই নেই, সেও শ্রম দিয়ে অর্থ উপার্জন করে আল্লাহর রাস্তায় দান করতেন অথচ আমাদের সমাজে যারা নিজেদেরকে রসুলের উত্তরসূরি (ওরাসাতুল আম্বিয়া) দাবি করেন, তাদের স্থাবর-অস্থাবর অন্যান্য সম্পদের হিসাব যাই হউক না কেন শুধু শরীরে জড়িয়ে থাকা জামা কাপড়ের দামই কয়েক হাজার টাকা, তবুও তারা দান গ্রহণ করেন। অপরকে দানের ওয়াজ করলেও তাদেরকে দান করতে খুব একটা দেখা যায় না।
বর্তমানে দান ধর্মব্যবসার উপাদান:
এখন যদি কোনো মানুষকে দানের মহিমা বোঝানো হয় তাহলে প্রথমেই সে চিন্তা করবে কোথায় দান করা যায়। এর জন্য তার সামনে যে পথগুলোর চিন্তা আসবে সেগুলি হচ্ছে মসজিদ, এতিমখানা, মাদ্রাসা ইত্যাদি। বর্তমানে ইসলাম ধর্মের পুরোহিতরা এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে দানের খাত হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। কিন্তু এগুলি আসলে তাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এখানে দান করলে আল্লাহর দরবারে যায় না, যায় ধর্মজীবীদের পেটে। কিন্তু ইসলাম কোনো ব্যবসায়িক পণ্য নয়, কোর’আন হাদিসের কোনো একটা শব্দের বিনিময়েও দুনিয়াবী কোনো স্বার্থ হাসিল করা নিষিদ্ধ, হারাম। যারা এই গর্হিত কাজ করবে তাদের জন্য আল্লাহ কঠিন শাস্তির হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন (সুরা বাকারা- ১৭৪, ১৭৫-সহ বহু আয়াত ও হাদিস)। মসজিদ নির্মাণের জন্য এক মুষ্টি বালুর টাকা, একটি ইটের টাকা দিয়ে আখেরাতে জান্নাত লাভের প্রতিশ্রুতি দিতে দেখা যায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে। এই অর্থ যুগ যুগ ধরে তোলা হয়, মসজিদ আর হয় না। একইভাবে এতিমখানা, হেফজখানার নামেও চলে ভিক্ষাবৃত্তি। রমজান মাস বা কোরবানির ঈদ যেন ধর্মব্যবসায়ীদের মৌসুম। ভিক্ষা করা হারাম, এক ভিক্ষুককে রসুলাল্লাহ কম্বল বিক্রি করিয়ে কুঠার কিনে কাঠ কাঠতে পাঠিয়েছেন, এই ঘটনা তারাই বর্ণনা করেও ধর্মজীবীরা দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করেন। আজকের সমাজে যারা হাজারো অপকর্ম করে, সুদের কারবার করে সমাজে প্রভাবশালী হন তারাই এই ধর্মব্যবসায়ীদের পোষক। কিন্তু এদের অপকর্মের ব্যাপারে ধর্মব্যবসায়ীরা নিশ্চুপ বরং পার্থিব সুবিধার (যেমন দাওয়াত খাওয়া) আশায় তাদের জন্য এরা দোয়াও করে। এই সকল ধর্মব্যবসায়ীদের প্রতি কথা যে, আপনারা নিজের হাতকে উপরে স্থাপন করুন, রসুলাল্লাহর আসহাবদের মতো শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করুন। কেননা, একদিন রসুলাল্লাহ বলেন, “উপরের হাত নীচের হাত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ (ইবনে ওমর রা. থেকে বোখারি ও মুসলিম)।”
মাননীয় এমামুয্যামানের দানশীলতা:
মাননীয় এমামুয্যামান নিজেকে আল্লাহর রাস্তায় এমনভাবে বিলিয়ে দিয়েছিলেন যে তাঁর নিজের বলতে আর কিছুই ছিল না। আন্দোলনই ছিল তাঁর সংসার। একজন মানুষ নিজের সংসারের জন্য যেভাবে নিজের উপার্জন থেকে ব্যয় করে, সেভাবেই তিনি আন্দোলনের জন্য ব্যয় করতেন। তিনি একটি টাকাও অপচয়ের পক্ষপাতি ছিলেন না। হেযবুত তওহীদ গঠনের প্রাথমিক বছরগুলিতে আন্দোলনের সকল কাজ বলতে গেলে এমামুয্যামানের অর্থেই সম্পাদিত হতো। আন্দোলনের বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে অর্থের ঘাটতি হলে তিনি খরচ জোগানোর জন্য নিজের এবং পৈত্রিক বহু সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছেন। অসুস্থতায় তিনি একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে গেলেও রোগী দেখা বন্ধ করেননি, বিছানায় শুয়ে রোগী দেখেছেন। তিনি হাজার হাজার রোগীর চিকিৎসা করেছেন সম্পূর্ণ বিনা খরচে। আল্লাহর আহ্বানে পরপারে যাওয়ার আগে তিনি তাঁর অবশিষ্ট সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় সোপর্দ করে যান। তিনি নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন কেউ যেন তাঁর জন্য কোনো উপহার না আনে। তারপরও যদি কেউ তাঁর জন্য কোনো উপহার কিনে আনতো তিনি সেটার দাম দিয়ে দিতে চাইতেন এবং তাকে কঠোরভাবে সাবধান করে দিতেন।