আল্লাহর রসুল (সা.) কা’বা শরীফের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন। সময়টা অত্যন্ত কঠিন, তিনি ও তাঁর সাহাবীগণের (রা.) ওপর প্রচ- বাধা এবং অবর্ণনীয় নির্যাতন নিপীড়ন চলছে। হঠাৎ একজন সাহাবা বললেন, হে আল্লাহর রসুল! এই অত্যাচার নিপীড়ন আর সহ্য হচ্ছে না। আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করুন আমাদের বিরোধীরা সব যেন ধ্বংস হয়ে যায়।
কথাটাকে আল্লাহর রসুল কতখানি গুরুত্ব দিলেন তা বোঝা যায় এই থেকে যে, তিনি হেলান ছেড়ে সোজা হয়ে বসলেন এবং ঐ সাহাবাকে বললেন, তুমি কী বললে? সাহাবা তার কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। শুনে আল্লাহর রসুল তাকে বললেন, ‘শোন, শীঘ্রই সময় আসছে যখন কোন যুবতী মেয়ে গায়ে গহনা পরে একা সা’না থেকে হাদরামাউদ যাবে। তার মনে এক আল্লাহ এবং বন্য জন্তু ছাড়া আর কোন ভয় থাকবে না।’ [খাব্বাব (রা.) থেকে বোখারী ও মেশকাত]।
অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এই হাদীসটি থেকেই আমরা ইসলামের উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে জানতে পারি। এই ঘটনাটির মধ্যে কয়েকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে।
প্রথমত, আল্লাহর রসুল উদাহরণস্বরূপ বললেন, স্ত্রী লোক, কোনো পুরুষের কথা বললেন না। কারণ স্ত্রী লোকের প্রাণ ও সম্পদ ছাড়াও আরও একটি জিনিস হারাবার সম্ভাবনা আছে যা পুরুষের নেই। সেটা হল ইজ্জত, সতীত্ব, সম্ভ্রম।
দ্বিতীয়ত, ঐ স্ত্রী লোক বয়সে যুবতী। অর্থাৎ লোভাতুরদের কাছে আরও লোভনীয়।
তৃতীয়ত, অলঙ্কার গহনা পরিহিত, চোর ডাকাতের জন্য লোভনীয়।
এতগুলো লোভনীয় বিষয় থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর রসুল বলছেন, অনুরূপ একটি অলঙ্কার পরিহিত যুবতী স্ত্রীলোক একা সা’না শহর থেকে প্রায় তিনশ’ মাইল দূরবর্ত্তী হাদরামাউতে যেতে পারবে, যা অন্তত কয়েক সপ্তাহের ব্যাপার, এত দীর্ঘ পথে আল্লাহ এবং বন্য জন্তু ছাড়া কোন ভয় করবে না।
চতুর্থত, লক্ষ করার বিষয়, স্ত্রীলোকটি শুধু পথের নিরাপত্তা সম্বন্ধেই নিশ্চিন্ত হবে না, বরং বন্য জন্তু ছাড়া অন্য কোন রকম বিপদের কোন আশঙ্কাই তার থাকবে না।
এখানে পাঠকদেরকে বিবেচনা করতে হবে কোন্ সময়ে আল্লাহর রসুল উক্ত কথাগুলো বলছেন? যখন কিনা মেয়ে শিশুদেরকে জীবন্ত কবর দেওয়া হচ্ছিল। এমনকি সদ্য ঈমান আনয়নকারী মুষ্ঠিমেয় মো’মেন-মো’মেনারাই কঠোর নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হচ্ছিলেন, কাউকে কাউকে হত্যা পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু আল্লাহর রসুল স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন, এই অবস্থা চিরদিন থাকবে না। খুব শিগগিরই এই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটবে। অচিরেই এমন সমাজব্যবস্থা তৈরি হবে যেখানে অন্যায়, অবিচার ও অনিরাপত্তার বিন্দুমাত্রও আশঙ্কাও থাকবে না। সাহাবীর কথার জবাবে আল্লাহর রসুল কিন্তু বললেন না যে, শিগগিরই এমন সময় আসবে পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ হবে, লোকে দলে দলে নামাজ পড়তে যাবে, সবাই রোজা রাখবে, জিকির করবে, ঘরে ঘরে কোর’আন তেলাওয়াত হবে ইত্যাদি। এসব বললেন না, বরং নির্দিষ্টভাবে একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝালেন নিরাপত্তার কথা। এ থেকে আমরা ইসলামের ও আল্লাহর রসুলের ইতিহাস সৃষ্টিকারী সংগ্রামী জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্যটি বুঝতে পারি। আমরা বুঝতে পারি যে, সমাজ থেকে যাবতীয় ভয় ভীতি, আতঙ্ক দূর করে মানবজীবনে নিñিদ্র নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করাই ইসলামের মূল উদ্দেশ্য এবং ইতিহাস সাক্ষী, রসুলের ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা হয়নি। বাস্তবেই তেমন একটি শান্তিময় ও নিরাপদ সমাজ উপহার দিয়েছিলেন তারা।