হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম
পশ্চিমা বস্তুবাদী ‘সভ্যতা’র শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে আমাদের সমাজেও তথাকথিত মুক্তমনা, শিক্ষিত ও উন্নাসিক একটি শ্রেণির প্রাদুর্ভাব হয়েছে যারা বলে থাকেন ধর্ম কুসংস্কার, ধর্ম প্রাচীন যুগের সমাজপতিদের তৈরি করা জুজুর ভয়, স্রষ্টা বলতে কেউ নেই, পরকাল, জান্নাত, জাহান্নাম সবই মানুষের কল্পনা ইত্যাদি ইত্যাদি। তারা ধর্মের প্রভাবকে, ধর্মের গন্ধকেও মানবজীবন থেকে ঝেড়ে ফেলতে চান। রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনায় সম্পৃক্ত ব্যক্তিগণও অনেক ক্ষেত্রে তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েন। তাদের কথা ও কাজের দ্বারা যখন মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে তখনই সমাজে দাঙ্গা ও গোলোযোগ সৃষ্টি হয়। আমাদেরকে অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে যে, এই তথাকথিত মুক্তমনারা যতই বলুন, বইয়ে আর ব্লগে লেখালিখি করুন না কেন, মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে মুছে ফেলার চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য, অধিকাংশ মানুষই এসব কথা শুনবে না। এ কথা বিগত কয়েক শতাব্দীতে শত শতবার প্রমাণিত হয়েছে। ইউরোপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের উদ্ভবের পাশাপাশি নাস্তিক্যবাদেরও উদ্বোধন ঘটে যা কম্যুনিজমের মাধ্যমে রাষ্ট্রব্যবস্থায় বাসা বাঁধতে সক্ষম হয়। পাশ্চাত্যের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধর্মহীন, এই শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ঔপনিবেশিক যুগে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষকেই ধর্মের প্রতি সন্দিহান করে তোলা হয়েছে। আর রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে তো বহু আগেই বাদ দেওয়া হয়েছে। বিগত শতাব্দীতে কম্যুনিস্ট শাসনাধীন এলাকাগুলোতে নাস্তিক্যবাদী দর্শনের যে রমরমা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল তাতে করে নাস্তিক্যবাদী চিন্তানায়ক ও রাষ্ট্রনায়করা ধারণা করেছিলেন যে এবার বুঝি স্রষ্টার ধ্যান-ধারণাকে মানুষের মন-মগজ থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করা সম্ভব হবে। কিন্তু কার্যত সেটা সম্ভব হয় নি। কারণ,
- আল্লাহর রূহ: যিনি সৃষ্টি করেছেন অর্থাৎ সেই স্রষ্টার রূহ বা আত্মা প্রত্যেকের ভেতরে আছে। স্রষ্টাকে বিশ্বাস করার মতো যথেষ্ট রকম উপাদান প্রকৃতিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যেগুলোকে পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ আয়াত, নিদর্শন বা মো’জেজা বলেছেন। তারকারাজি, পর্বতমালা, সমুদ্রের জলরাশি, পশু-পাখি, এক কথায় প্রকৃতির অপূর্ব, অনিন্দ্য সুন্দর, নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে মানুষ অবচেতন মনেই এই সবকিছুর স্রষ্টাকে খুঁজতে থাকে এবং একজন মহান স্রষ্টা যে অবশ্যই আছেন সে ব্যাপারে আত্মার সাড়া পায়। এসব দেখার পরও মানুষ অন্ধের মতো নাস্তিকে পরিণত হবে না।
ধর্মগ্রন্থ: আল্লাহর নাজেলকৃত ধর্মগ্রন্থগুলোর বেশ কয়েকটি এখনও মানুষের কাছে আছে যেগুলো স্রষ্টার অস্তিত্বের স্বাক্ষর বহন করছে। মানুষ সেগুলো সম্মানের সঙ্গে পড়ছে, জানছে, বিচার বিশ্লেষণ করছে। এগুলোর স্বর্গীয় বাণীসমূহ মানুষের আত্মার গভীরে প্রভাব ফেলছে। অধিকাংশ মানুষ সেগুলোকে মাথায় করে রাখছে, সন্তানকে যেমন যত্ন করা হয় সেভাবে যত্ন করছে। - অতীত ইতিহাস: অতীতে হাজার হাজার হয়তো লক্ষ লক্ষ বছর মানুষকে শান্তি দিয়েছে ধর্ম। এই ইতিহাস মানুষের জানা আছে। সময়ের সেই বিশাল ব্যাপ্তির তুলনায় গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদির শাসনামল এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র এবং এগুলোর অভিজ্ঞতাও শান্তিময় নয়। ধর্মের শাসনে প্রাপ্ত সেই শান্তির স্মৃতি মানবজাতির মন থেকে মুছে যায় নি। অধিকাংশ মানুষ এখনও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে একমাত্র স্রষ্টার বিধানেই শান্তি আসা সম্ভব। কাজেই যুগের হাওয়া তাদেরকে যতই অন্য দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুক, তারা শান্তির আশায় বারবার ধর্মের পানেই মুখ ফেরায়।
ভবিষ্যদ্বাণী: প্রতিটি ধর্মগ্রন্থেই ভবিষ্যদ্বাণী আছে যে, শেষ যুগে (কলিযুগ, আখেরি যামানা, The Last hour), আবার ধর্মের শাসন বা সত্যযুগ প্রতিষ্ঠিত হবে, মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ বৈরিতা থাকবে না, কোনো অবিচার, অন্যায়, শোষণ থাকবে না, পৃথিবীটা জান্নাতের মত শান্তিময় (Kingdom of Heaven) হবে। এই বিশ্বাস থেকে অধিকাংশ মানুষ ধর্মের উত্থানই কামনা করে। এটা তাদের ঈমানের অঙ্গ, এ বিশ্বাস মানুষের অন্তর থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। - বিকল্প ব্যবস্থার অনুপস্থিতি বা ব্যর্থতা: শান্তির আশায় ধর্মের পানে ছুটে চলা মানুষকে ফেরাতে চাইলে স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজন হবে ধর্মের বিকল্প এমন একটি জীবনব্যবস্থা প্রণয়ন যা তাদেরকে সেই কাক্সিক্ষত শান্তি দিতে পারবে, একই সঙ্গে দেহ ও আত্মার প্রশান্তি বিধান করতে পারে। কিন্তু সত্যি বলতে কি সেটা মানুষ আজ পর্যন্ত করতে পারে নি এবং কোনো কালে পারবেও না। বহু চেষ্টা করেছে কিন্তু সবই মাকাল ফল। শান্তির শ্বেতকপোত রাজতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক বা গণতান্ত্রিক কারো হাতেই ধরা দেয় নি। মানুষের আবি®কৃত জীবনব্যবস্থাগুলোকে যত সুন্দর সুন্দর নামেই ডাকা হোক না কেন তা হচ্ছে মানবজাতির সামনে মৃত্যুর বিকল্প পথ। জীবনের পথ একটাই; আর সেটা হলো ধর্ম। বর্তমান স্রষ্টাবর্জিত জীবনদর্শন মানুষকে কেবল নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতর জীবন উপহার দিয়েছে। কাজেই মানুষ এখন জীবন রক্ষার আশায় ধর্মের দিকেই যেতে চাইবে, কেননা তাদের বস্তুত শান্তি দরকার। সুতরাং মানবজাতিকে ধর্মহীন করে ফেলার চেষ্টা অপ্রাকৃতিক, বাস্তবতাবর্জিত, নিতান্তই অর্বাচীন ও মূঢ়তাসুলভ পরিকল্পনা।
- এখন একটাই করণীয়, মানুষের ঈমানকে, ধর্মবিশ্বাসকে সঠিক পথে চালিত করা। প্রথমেই কয়েকটি মৌলিক বিষয় মানুষকে জানাতে হবে যেমন- ধর্মের আগমনের প্রধান উদ্দেশ্য মানবতার কল্যাণ। মানবতার কল্যাণে জীবন-সম্পদ উৎসর্গ করাই মো’মেনের প্রধান শর্ত। অন্য মানুষের দুঃখ-দুর্দশা হৃদয়ে ধারণ করা এবং তা দূর করার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টাই তার প্রকৃত এবাদত। ধন অর্জন ও জ্ঞান অর্জনের মূল লক্ষ্য হলো অন্য মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে দান। এতেই মানব জনমের সার্থকতা নিহিত, এতেই স্বর্গ প্রাপ্তি বা জান্নাত লাভ সম্ভব। অন্য পথে নয়। ধর্মব্যবসা সকল ধর্মে নিষিদ্ধ। ধর্মকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে ধর্মব্যবসায়ীরা কীভাবে মানুষকে প্রতারিত করছে, কীভাবে মানুষের ইহকাল ও পরকালকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, কীভাবে তারা মিথ্যা ফতোয়াবাজি ও ধর্মের অপব্যাখ্যা দ্বারা সমাজে অন্যায়, অশান্তি, দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িকতা বিস্তার করছে আর নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করছে এসব বিষয় সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে। এটা করতে পারলে তারা আর ভবিষ্যতে ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা উত্তেজিত হয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় জড়াবে না। ধর্মব্যবসায়ীরা তাদের আচার-অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্মের অপব্যবহার থেকে বিরত হতে বাধ্য হবে। সমাজ ধর্মব্যবসার অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে। পাশাপাশি ধর্মের গায়ে লেগে থাকা অধর্মগুলোকে চিহ্নিত করে ধুয়ে ফেলে ধর্মকে নির্মূল করতে হবে। ধর্মের সত্য ও সুন্দর রূপটিকে যদি মানুষের সামনে তুলে ধরা যায় তাহলে আলো ও অন্ধকার, সাদা ও কালো পৃথক হতে সময় লাগবে না। তখন ধর্মই হবে সুশীতল শান্তির আধার।
লেখক: এমাম, হেযবুত তওহীদ
ফেসবুক: fb.com/emamht