রিয়াদুল হাসান
কোর’আন বই আকারে লিপিবদ্ধ হয় ওসমান (রা.) এর সময়ে। এর পূর্বে কোর’আন মুখস্থ করাই ছিল শেষ ঐশী গ্রন্থ সংরক্ষণের একমাত্র পথ। তাই খলিফারা কোর’আন মুখস্থ করাকে খুব উৎসাহিত করতেন, কোর’আনে হাফেজদেরকে অত্যন্ত সমাদর করতেন। তাঁদেরকে কোর’আন শিক্ষা দেওয়ার জন্য মুসলিম ভূখণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চলসমূহে প্রেরণ করা হতো। এভাবে যাঁদেরকে কোর’আন শিক্ষাদানের দায়িত্ব দিয়ে সরকারিভাবে প্রেরণ করা হতো তাদের খোরপোষের দায়িত্ব সরকারই বহন করত। তারা যেন ব্যক্তিগতভাবে কারো থেকে কোনো হাদিয়া বা বিনিময় গ্রহণ না করেন সে বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া হতো। আজকের সময় কোর’আন মুদ্রণযন্ত্রের কল্যাণে ঘরে ঘরে বিরাজ করছে। সারা পৃথিবীতে বহু ভাষায় অনূদিত কোটি কোটি সংখ্যক কোর’আন রয়েছে, তার উপর আছে অডিও রেকর্ড, আছে সফট কপি। এক কথায় কোর’আনের অস্তিত্ব এখন কেবল মুখস্থ করার উপর নির্ভরশীল নয়। আর চ‚ড়ান্ত কথা হলো, কোর’আনের সংরক্ষণ আল্লাহ নিজেই করবেন। তিনি কীভাবে সেটা করবেন, কার মাধ্যমে করবেন সেটাও তাঁরই সিদ্ধান্তের ব্যাপার। বাস্তবক্ষেত্রে আমরা দেখতে পেয়েছি যে, আল্লাহ কখনও সেটা হাফেজে কোর’আনদের মাধ্যমে করেছেন, কখনও করেছেন ছাপার অক্ষরের মাধ্যমে, কখনও করছেন আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে। যখন কোর’আনের কোনো লিখিত কপি ছিল না তখন কোর’আন মুখস্থ করার জন্য মানুষকে উৎসাহিত করা হতো। খলিফা ওমরের (রা.) এর শাসনামলে কোর’আনে হাফেজদেরকে কখনও কখনও সরকারিভাবে পুরষ্কৃত করা হতো। ইসলামের অন্যতম লক্ষ্য মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। যখন ইসলামের ভূখণ্ডের পরিধি বাড়তে লাগলো তখন স্বভাবতই জাতিও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে লাগলো। কেননা ইসলামের নীতি হলো সম্পদ পুঞ্জিভূত করা যাবে না। নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ দান করে দিতে হবে। যখনই কোনো যুদ্ধলব্ধ সম্পদ শাসকের কাছে আসতো তিনি দ্রুততম সময়ের মধ্যে দরিদ্রদের মধ্যে, সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের মধ্যে বিলি-বণ্টন করে দিতেন। রসুলের যারা আসহাব ছিলেন তাদেরকেও ভাতা দেওয়া হতো। এভাবে কোর’আনে হাফেজদেরকেও পুরষ্কৃত করা হতো, সম্মান দেওয়া হতো। একবার কোর’আন তেলাওয়াতকারীদেরকেও খলিফা ওমর (রা.) পুরষ্কৃত করতে মনস্থির করলেন। কিন্তু হিতে বিপরীত হওয়ায় তিনি তৎক্ষণাৎ সে সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেন।
খলিফা ওমর (রা.) কোনো একটি এলাকার শাসকের প্রতি চিঠি লিখে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, “যারা কোর’আন পড়ে তাদেরকে আর্থিক সাহায্য দাও।” সেখানকার শাসনকর্তা এই নির্দেশকে কার্যকর করেন। কিন্তু এর ফল দাঁড়ায় এই যে, বহুলোক কেবল অর্থের লোভে কোর’আন পড়তে শুরু করে। উক্ত শাসনকর্তা এহেন অবস্থা দেখে সঙ্গে সঙ্গে খলিফাকে অবগত করলে খলিফা এই হুকুমটি প্রত্যাহার করেন এবং কোর’আন পাঠ বা শিক্ষাদানের বিনিময়ে পার্থিব স্বার্থহাসিলের যে কোনো সুযোগ ইসলামে নেই এবং এর পরিণতি যে জাহান্নাম সে প্রসঙ্গেও একটি চিঠি মুসলিম ভূখণ্ডের শাসকদের নিকট প্রেরণ করেন। তিনি মূলত চাইতেন কোর’আনে হাফেজদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাক, কোর’আনের পাঠক বৃদ্ধি পাক কারণ কোর’আনকে সংরক্ষণ করা খলিফা হিসাবে তাঁর একটি গুরু দায়িত্ব। কিন্তু কোর’আন যেন স্বার্থ হাসিলের মাধ্যম না হতে পারে সে দিকেও তিনি ছিলেন সজাগ ও সতর্ক। উপরোক্ত ফরমানটি প্রত্যাহার করে তিনি নতুন করে নির্দেশ দিলেন যে, “যে সকল ব্যক্তি উদার ও দানশীল এবং রসুলাল্লাহর সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেছেন তাদেরকে আর্থিক সাহায্য দাও।” (কিতাবুল আমওয়াল, কাসিম ইবনে সাল্লাম, পৃষ্ঠা ২৬)।
খলিফা ওমর একবার মনস্থির করেন যে তিনি বিভিন্ন সেনাঘাঁটিতে অবস্থানরত মুজাহিদদের মধ্যে যাঁরা কোর’আনের হাফেজ তাঁদেরকে মুসলিম অধ্যুষিত ভূখণ্ডের বিভিন্ন এলাকায় কোর’আন শিক্ষাদানের জন্য প্রেরণ করবেন। তিনি তাঁদের জন্য একটি ভাতা (বাৎসরিক ২৫০০ দিরহাম) নির্ধারণ করেন। তিনি বসরা ও এর অধীন এলাকার প্রশাসক আবু মুসা আশ’আরী (রা.) এর কাছে পত্র লিখে হাফেজে কোর’আনদের তালিকা চান। আবু মুসা আশ’আরী (রা.) বসরার তিনশতেরও বেশি হাফেজের তালিকা পাঠালেন। তখন ওমর (রা.) তাঁদের নামে একটি চিঠি প্রেরণ করেন যেখানে তিনি কোর’আন দ্বারা স্বার্থহাসিল সংক্রান্ত বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। তিনি খলিফার সেই চিঠিটি পেয়ে হাফেজদেরকে নিয়ে একটি সম্মেলন করেন এবং সেখানে চিঠিটি পাঠ করে শোনান।
হাফেজে কোর’আনদের নামে খলিফা ওমরের চিঠি-
আল্লাহর বান্দা ওমরের পক্ষ থেকে আবু মুসা আবদুল্লাহ ইবনে কায়েস এবং কোর’আনের হাফেজগণের প্রতি।
তোমাদের সবার প্রতি সালাম রইল। জেনে রাখ যে, এই কোর’আন তোমাদের জন্য পুরস্কার ও সওয়াব অর্জনের অসিলা। অতএব এর শিক্ষার উপর আমল করো। একে নিজের স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার বানিও না। যে ব্যক্তি কোর’আনকে নিজের স্বার্থ ও প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণের মাধ্যম হিসাবে বানাবে কোর’আন তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। আর যারা কোর’আনকে নিজের পথপ্রদর্শক ও অনুসরণীয় বানাবে কোর’আন তাদেরকে জান্নাতের উদ্যানে ভ্রমণ করাবে। লক্ষ্য রাখবে, কোর’আন যেন আল্লাহর দরবারে তোমাদের জন্য সুপারিশকারী হয়। তোমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী যেন না হয়। কোর’আন যার সুপারিশ করবে সে জান্নাতে যাবে। আর কোর’আন যার বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে সে জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। মনে রেখো, এই কোর’আন হেদায়াতের উৎস, জ্ঞানের কলি এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে সদ্য নাজিলকৃত জীবন্ত এক কেতাব। এর মাধ্যমে আল্লাহ অন্ধের চোখ, বধিরের কান এবং মনের বন্ধন খুলে দেন।
আল্লাহর বান্দা যখন রাতে নিদ্রা থেকে ওঠে, মেসওয়াক করে, ওজু করে অতঃপর তাকবির বলে সালাতে দাঁড়িয়ে কোর’আন তেলাওয়াত করে তখন মালায়েকগণ (ফেরেশতা) তাকে চুম্বন করে এবং বলে, “পড়ো, পড়ো। তুমি পাক পবিত্র হয়ে গেছ। এবার কোর’আন পাঠ করলে তোমার আনন্দ আসবে।” সালাতে কোর’আন তেলাওয়াত গুপ্তধন পাওয়ার মতো। এতে অসীম কল্যাণ ও বরকত রয়েছে।
অতএব যত বেশি সম্ভব কোর’আন পাঠ করো। সালাত হলো নূরস্বরূপ, যাকাত হলো প্রমাণস্বরূপ, ধৈর্য হলো আলোস্বরূপ, আর কোর’আন হলো তোমাদের পক্ষে অথবা বিপক্ষে দলিলস্বরূপ। অতএব কোর’আনের সম্মান করো, এর প্রতি অমনোযোগী হয়ো না। কেননা আল্লাহ তাঁর সম্মান করে থাকেন যে কোর’আনের সম্মান করে। আর আল্লাহ তাকে অসম্মান করে থাকেন যে কোর’আনের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। স্মরণ রেখো, যে কোর’আন পড়ে তা মনে রাখে এবং তদনুযায়ী আমল করে, আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা পূর্ণ করে দেন। অন্যথায় তাঁর আরাধ্য বস্তু পরকালের জন্য জমা করে রাখেন। আল্লাহর ইনআম (উপহার) সর্বোৎকৃষ্ট ও চিরস্থায়ী। আর সে পুরষ্কার তারাই পায় যারা মো’মেন এবং যারা নিজের প্রভুর উপর পূর্ণ আস্থাশীল। (ইবনে যানজাবিয়্যার বর্ণনায় কানযুল উম্মাল, ১ ঃ ২১৭)।
আবু মুসা আল আশয়ারী (রা.) সেই সম্মেলনে উপস্থিত ৩ শ হাফেজের উদ্দেশে যে বক্তব্য পেশ করেন সেখানে তিনি বলেন, “নিঃসন্দেহে কোর’আন হয় আপনাদের জন্য সওয়াবের, না হয় আপনাদের জন্য শাস্তির কারণ হবে। অতএব কোর’আনের অনুসরণ করবেন। কিন্তু কোর’আনকে নিজের স্বার্থ ও প্রবৃত্তির কামনা পূরণের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করবেন না। কেননা যে ব্যক্তি কোর’আনকে নিজের পথ প্রদর্শক হিসাবে গ্রহণ করবে কোর’আন তাকে জান্নাতের বাগানে নিয়ে যাবে। আর যে কোর’আন নিজের কামনা পূরণের হাতিয়ার বানাবে কোর’আন তাদেরকে গলা ধাক্কা দিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে।” (সাফওয়াতুস সাফওয়াত, ইবনুল যাওজী, হায়দরাবাদ, ভারত, ১৩৫৫ হি. ১:২৬৬)।
উল্লেখ্য যে, রসুলাল্লাহর সময় থেকেই আবু মুসা আশ’আরীর (রা.) বিশেষ দায়িত্ব ছিল উত্তর ইয়েমেনের বিভিন্ন প্রদেশে কোর’আন শিক্ষাদান ও যাকাত সংগ্রহ। তিনিসহ রসুলাল্লাহর প্রত্যেক সাহাবি জানতেন যে কোর’আনের বিনিময়ে স্বার্থ হাসিল, পার্থিব সম্পদ, উপহার-হাদিয়া, ইনআম গ্রহণ নিষিদ্ধ, হারাম। তাঁরা কোর’আনের সংরক্ষণের গুরুত্ব এবং কোর’আনের শিক্ষা বিস্তারের গুরুত্ব নিঃসন্দেহে আমাদের চাইতে বেশি বুঝতেন। এজন্য তাঁরা জাতিকে কোর’আন শিক্ষা দিলেও কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছ থেকে এর বিনিময় নিতেন না, উপহার নিতেন না। কোনোভাবেই হেদায়াতের উৎস কোর’আনকে তাঁরা স্বার্থের হাতিয়ার হতে দেন নি।
মুসলিম জাতির একটি কর্তৃপক্ষ থাকা সব সময় বাধ্যতামূলক। তারা কখনও নেতৃত্বহীন হতে পারে না। ইসলামের অনুসরণকারী পুরো জাতি হবে এক জাতি, তাদের নেতা হবে একজন। তিনি অর্থাৎ কর্তৃপক্ষ যখন কোর’আন শিক্ষা দেওয়ার জন্য, দীনের জ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার জন্য কোনো বিজ্ঞ ব্যক্তিকে দায়িত্ব প্রদান করবেন, তখন ঐ ব্যক্তির ভরণপোষণের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন সেটা কর্তৃপক্ষ বহন করবে। প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিতদের বেলাতেও একই কথা। কিন্তু সরকার নিয়োগ দেয় নি, ব্যক্তি উদ্যোগে একজন লোক অন্যকে ইসলামের জ্ঞান দিবে, কোর’আন শেখাবে আর সেটা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করবে এই পেশাদারী দীনশিক্ষাদানের কোনো বৈধতা ইসলামে নেই। এটা কেন সে কথা পূর্বে একাধিকবার বলে এসেছি, আবারও বলছি। একজন মানুষ যার থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করে তার প্রতি সে নৈতিকভাবে অনুগত হয়ে যায়, তার অন্যায়ের বিরুদ্ধেও সে প্রতিবাদ করতে পারে না। একজন মুসলিম তার ঊর্ধ্বতন রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ এবং সর্বোচ্চ নেতার প্রতি এমনিতেই অনুগত থাকতে বাধ্য। তাই সেই কর্তৃপক্ষ যখন তার ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয় তখন সেটি তার আনুগত্যের ক্ষেত্রে, চেইন অব কমান্ডের ক্ষেত্রে কোনো বৈপরীত্য, সংঘর্ষ বা দ্ব›দ্ব সৃষ্টি করে না। কিন্তু কেউ যদি ধর্মের কাজ করে কোনো ব্যক্তি বা যে কারো থেকে অর্থ গ্রহণ করে তখন তার আনুগত্য সেখানে বাঁধা পড়বে। সেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অন্যায়ের প্রতিবাদ সে করতে পারবে না। এভাবে হক, সত্য ঢাকা পড়ে যাবে।
তাই আজকে যখন ইসলামের কোনো একক নেতৃত্ব নেই, ইমামত নেই, কর্তৃপক্ষ নেই, মুসলিমরা যখন আল্লাহর জীবনব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করে ইবলিসের প্রদর্শিত জীবনব্যবস্থা মেনে চলছে তখন মুসলিম দাবিদারদের মুখ্য কর্তব্য হলো একজন নেতার নেতৃত্বে আগে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, একটি সর্ববাদিসম্মত কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা খলিফাদের যিনি রসুলাল্লাহর স্থলাভিষিক্ত হবেন। এই প্রেক্ষাপটের তারতম্যকে বিবেচনার মধ্যে না এনে, মানুষকে সেটা বুঝতে না দিয়ে কোনোরকমে একটা কোর’আন শেখানোর জীবিকার বন্দোবস্ত করে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার সুযোগ ইসলামে নেই।
[তথ্যসূত্র: হযরত ওমর রা. – এর সরকারী পত্রাবলি]