আয়েশা আক্তার শ্রাবণী:
সম্প্রতি বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদন পড়ে জানতে পারলাম যে, সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সে দেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছেন তার অংশ হিসেবে আগামী দশকে সেখানকার বিনোদন শিল্পে প্রায় সাড়ে ছ’শো কোটি ডলার লগ্নি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সৌদির জেনারেল এন্টারটেইন অথরিটির প্রধান আহমেদ বিন আকিব আল-খাতিব আশা প্রকাশ করেছেন ২০২০ সালের মধ্যেই সৌদি আরবের সত্যিকারের পরিবর্তন ঘটে যাবে।
সৌদি আরব রক্ষণশীল দেশ হিসেবেই পরিচিত। গান-বাজনা-চলচ্চিত্র ইত্যাদিকে হারাম ফতোয়া দিতেন সেখানকার আলেমরা। হঠাৎ করেই সেগুলো হালাল হয়ে গেল কিভাবে সেটা এক রহস্য। তবে আমি ক্ষুদ্র জ্ঞানের মানুষ, কিতাব কালামের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মাসলা-মাসায়েল আমার বোঝার ক্ষমতার বাইরে। তাছাড়া সৌদি আরবের বিষয় নিয়ে আমার না ভাবলেও চলবে, আমি আদার ব্যাপারী! আমি কেবল আমার দেশের প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই, এই দেশের সন্তান হিসেবে দেশের ভালো-মন্দ নিয়ে দু’টো কথা বলার অধিকার তো আমার আছেই।
বাংলার আপামর জনতা সৌদি আরব বলতেই গদগদ! মক্কা-মদীনার ইসলামকেই তারা সবচাইতে খাঁটি ইসলাম মনে করে। ইসলামের নামে চলছে কিন্তু প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা নয়- এমন কিছুর সমালোচনা করলে অনেক ক্ষেত্রেই যৌক্তিক জবাবের বদলে একটি প্রচলিত প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হয় যে, ‘আপনি কি মক্কা-মদিনার আলেমদের চাইতে বেশি জানেন? সৌদি আরবের মানুষ ইসলাম বুঝল না আর আপনি বাংলাদেশের কোথাকার কোন সলিমুদ্দি কলিমুদ্দি ইসলাম বুঝে গেলেন?’ কোর’আনের শত আয়াত, রসুলের প্রামাণ্য জীবনী- সবকিছুই এই অযৌক্তিক প্রশ্নটির কাছে উপেক্ষিত থেকে যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যারা এতদিন মক্কা-মদিনার আলেম আর সৌদি আরবের ইসলামের অজুহাত দেখিয়ে নিজেদেরকে যাস্টিফাই করতেন তারাই এখন সৌদি আরবের সংস্কারমূলক বিভিন্ন সিদ্ধান্তের নিন্দা জ্ঞাপন করছেন এবং সোজা ইউটার্ন নিয়ে বলছেন- ‘সৌদি আরব কী করল সেটা দেখার বিষয় নয়, কোর’আন-হাদীসে যেটা আছে সেটাই ইসলাম।’ অর্থাৎ তাদের কাছে ইসলামের যে রূপরেখাটা আছে, সেটা অযৌক্তিক হোক, প্রকৃত ইসলামের শিক্ষাপরিপন্থী হোক, যে কোনো অজুহাতে সেটাই তারা বলবৎ রাখবেন! তার জন্য কখনও কোর’আন-হাদিসের অজুহাত দেখাবেন, কখনও মাসলা-মাসায়েলের অজুহাত দেখাবেন, কখনও সৌদি আরবের অজুহাত দেখাবেন। বিষয়টা সত্যিই হাস্যকর! তারা আসলে না যুক্তিবাদী, আর নাতো দলিলবাদী, আদতে তারা সুবিধাবাদী।
আমি যতটুকু জানি ইসলাম যুক্তিবুদ্ধির দরজায় তালা মারার ধর্ম নয়, যুক্তিবুদ্ধিকে ব্যবহার করে সত্য ও ন্যায়কে খুঁজে নেবার ধর্ম। কাজেই আমি আমার যুক্তিবুদ্ধি ও সাধারণ জ্ঞান প্রয়োগ করে এইটুকু বুঝি যে, আল্লাহ একমাত্র ক্ষতিকর বিষয় বা বস্তু ছাড়া অন্যকিছুকে হারাম করেন নি। আমি আজ পর্যন্ত এমন কোনো বিষয় বা বস্তু খুঁজে পাই নাই যেটা আল্লাহ হারাম করেছেন অথচ তা মানুষের জন্য উপকারী। বেছে বেছে কেবল ক্ষতিকর বা অকল্যাণকর বিষয়কেই আল্লাহ হারাম করেছেন যেন মানুষ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিনোদন শিল্প অর্থাৎ সঙ্গীত চলচ্চিত্র ইত্যাদি সমাজের জন্য ক্ষতিকর কিনা?
আমি বলব- ক্ষতির কাজে ব্যবহার করলে ক্ষতিকর, ভালো কাজে ব্যবহার করলে কল্যাণকর! একটি অস্ত্র যখন সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্য ব্যবহৃত হয় তখন সেটা ক্ষতিকর হয়ে ওঠে, আর যখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে ব্যবহৃত হয় তখন কল্যাণকর হয়ে ওঠে। বিনোদন শিল্পও তা-ই। এটি এমন এক মাধ্যম যার সঠিক ব্যবহার আমাদের যুবসমাজকে মানবতার কল্যাণে নিজের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে সংগ্রাম করার অনুপ্রেরণা যোগাতে পারে, আবার এর ভুল ব্যবহার তরুণ সমাজকে বেপরোয়া জীবন-যাপনের দিকে ঠেলে দিতে পারে। ভালো-মন্দ দু’টোই নির্ভর করছে ব্যবহারের উপর। তাহলে বিনোদন শিল্পই কীভাবে হারাম বা হালাল হতে পারে? হারাম হচ্ছে অশ্লীলতা, হারাম অপব্যবহার।
মহান আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান দান করেছেন, বিবেক দিয়েছেন এবং ইচ্ছাশক্তিও দিয়েছেন। মানুষকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন সৃজনশীল সত্ত্বা হিসেবে। সেই সৃজনশীলতাকে মানুষ ভালো কাজে ব্যবহার করবে নাকি খারাপ কাজে ব্যবহার করবে তা মানুষের সিদ্ধান্ত। যেমন করবে তেমন ফল পাবে। খারাপ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে তো আল্লাহর দেওয়া ‘সৃজনশীলতা’র গুণটাই হারাম হতে পারে না। এই সহজ বিষয়টা যদি আমরা বুঝতে পারতাম তাহলে আজকের হারাম ফতোয়া কালকে হালাল বলতে হত না, আজকের সৌদিপ্রীতি কালকে নিন্দাবাদে রূপ নিত না। সৌদি সরকার যদি বিনোদন শিল্পের সঠিক ও কল্যাণকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারেন তাহলে নিন্দা নয়, নিঃসন্দেহে সেটা হবে প্রশংসনীয় উদ্যোগ! লেখক: শিক্ষার্থী।