রিয়াদুল হাসান:
মহান আল্লাহ আখেরী নবী মোহাম্মদের (সা.) উপরে শেষ জীবনবিধান (দীন) হিসেবে যে জীবনব্যবস্থাটি পাঠিয়েছেন সেটা ভারসাম্যযুক্ত জীবনব্যবস্থা। কিসের ভারসাম্য? দুনিয়া ও আখেরাতের ভারসাম্য, দেহ ও আত্মার, শরিয়াত এবং মারেফতের ভারসাম্য। এজন্য আল্লাহ এই উম্মাহকে বলেছেন, “আমি তোমাদেরকে ভারসাম্যযুক্ত জাতি হিসেবে সৃষ্টি করেছি (উম্মতে ওয়াসাতা-সুরা বাকারা ১৪৩)। যুগে যুগে যত নবী-রসুলদেরকে আল্লাহ পাঠিয়েছেন প্রত্যেক নবীর উম্মাহ পরবর্তীতে দীনের ভারসাম্য নষ্ট করেছে। এই ভারসাম্যকে ফিরিয়ে আনার জন্য আল্লাহ আবার নবী পাঠিয়েছেন। কোন জাতি শরিয়াহর উপর বেশী গুরুত্ব দিলে, আধিক্য আরোপ করলে অর্থাৎ বাড়াবাড়ি করলে আধ্যাত্মিকতা তথা মানবতাবোধ, মায়া, দয়া, করুণার গুরুত্ব হারিয়ে গেছে, আবার কেউ শরিয়াহকে পূর্ণ ত্যাগ করে সম্পূর্ণভাবে আত্মিক মানবকি বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষ ঘটানোর সাধনায় মগ্ন হয়ে গেছে। আধ্যাত্মিকতায় ডুবে যাওয়ায় দীনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। স্বভাবতই, দীনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেলে সেটা আর মানুষের পালনের যোগ্য থাকে না, অনুসরণের যোগ্য থাকে না। আখেরী নবীর উপর অবতীর্ণ দীনটার ভারসাম্য যেন নষ্ট না হয় সেজন্য আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতের, শরিয়াহ ও আধ্যাত্মিকতার একটা ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা দিয়ে দীনটাকে পাঠিয়েছেন। মহানবী (সা.) পরিশ্রম ও কঠোর অধ্যবসায় করে, সর্বাত্মক সংগ্রাম করে এমন একটা জাতি তৈরি করেছেন, যে জাতি ৬০-৭০ বছরের মধ্যে অর্ধ পৃথিবীতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করল সর্বাত্মক সংগ্রামের মাধ্যমে। তাঁর উম্মাহর উপরে দায়িত্ব ছিল সমস্ত দুনিয়াতে দীন প্রতিষ্ঠার, কিন্তু এই উম্মাহ সে দায়িত্ব ভুলে, আকীদা ভুলে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, মানবতার মুক্তির সংগ্রাম (জেহাদ) ত্যাগ করলো। সমস্ত পৃথিবীময় আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার কাজ ছেড়ে দিয়ে তাদের একদল সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে সহজ-সরল দীনটাকে জটিল, দুর্বোধ্য, মাকড়সার জালের ন্যায় সাধারণ মানুষের বোধগম্যতার বাইরে নিয়ে গেল।
তাদের এই ব্যাখ্যা, অতি ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, তাফসির, ফেকাহর, সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিশ্লেষণের উপর গড়ে উঠল বিভিন্ন মত, পথ, ফেরকা, মাজহাব, তরিকা ইত্যাদি। আরেকদল আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম ত্যাগ করে অন্তর্মুখী হয়ে গেল, সেখানে আধ্যাত্মিক সাধনা করে রিপুজয়ী, সাধু-সন্ন্যাসী হওয়ার চেষ্টা করল। একদল দীনের সহজ-সরলতাকে জটিল দুর্বোধ্য করে জাতিকে খ–বিখ- করে দিল। আরেক দল দীনের বহির্মুখী, সংগ্রামী চরিত্রকে অন্তর্মুখী, ঘরমুখী করে ফেলল। দুই দলই দীনের ভারসাম্য নষ্ট করে ফেললো। আজকে দুনিয়াময় মারেফতের নামে, তাসাউফ সাধনা, সুফিবাদের নামে যা চোলছে তা ইসলামের সুফিবাদ নয়, তা ভারসাম্যহীন আত্মিক উন্নতির তরিকামাত্র।
এই দীনে মানুষের আত্মার উন্নতির যে অংশটুকু আছে তাকে যদি মা’রেফাত বলে ধোরে নেওয়া যায় তবে এ দীন হলো শরিয়াহ ও মা’রেফাতের মিশ্রণে একটি পূর্ণ ব্যবস্থা। মানুষ এক পায়ে হাঁটতে পারে না, তাকে দু’পায়ে ভারসাম্য করতে হয়। দীনেরও দু’টি পা। এক পা শরিয়াহ অন্য পা মারেফাত। এই দুই পায়ের সহযোগিতায় একটা মানুষ ভারসাম্য রেখে হাঁটতে পারে।
একটা জাতির বেলায়ও তাই। ঐ দুই পায়ের একটা বাদ দিলে বা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলে ঐ জাতিও আর হাঁটতে পারবে না, তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যেও পৌঁছতে পারবে না। সুফী-সাধকরা এই দীনের মারেফাতের পা’টাকে আঁকড়ে ধরলেন। অবশ্য শরিয়াহর পায়ের যেটুকু ব্যক্তিগত পর্যায়ের সেটুকু আংশিকভাবে গ্রহণ করলেন। কিন্তু এ দীনের শরিয়াহ প্রধানতই জাতীয়; রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা ও দ-বিধিই এর প্রধান ভাগ। এই প্রধান অংশটুকুকে বাদ দিয়ে শুধু ব্যক্তিগত শরিয়াহ ও আত্মার উন্নতির অংশটুকু গ্রহণ করে নির্জনবাসী হয়ে সুফীরা এই দীনের একটা পা কেটে ফেললেন। ফলে এ দীন স্থবির হয়ে গেল, চলার শক্তি হারিয়ে ফেললো। যে জিনিসের গতি নেই সেটা মৃত, গতিই প্রাণ। এক পা হারিয়ে এই জাতি চলার শক্তি হারালো তার পর ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। যে জাতি শরিয়াহ আর মারেফাতের দু’পায়ে হেঁটে আরব থেকে বের হয়ে আটলান্টিকের তীর আর চীনের সীমান্ত পর্যন্ত গেল, সে জাতি ফকিহ, মুফাসসির আর সুফীদের কাজের ফলে চলার শক্তি হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। একদল জাতিকে খ- বিখ- করলো, অন্যদল জাতির বহির্মুখী গতিকে উল্টিয়ে অন্তর্মুখী বা ঘরমুখী করে দিল। আজ এই জাতি শত শত আধ্যাত্মিক তরিকায় বিভক্ত হয়ে আছে। তারা আজকে পরাজিত, অন্য জাতির পদানত, সর্বত্র লাঞ্ছিত একটি জনগোষ্ঠী। যতদিন তারা আল্লাহর প্রকৃত ইসলামে ফিরে না আসবে, যতদিন না এই দল মত তরিকা আর ফেরকার বিভক্তির ঊর্ধ্বে উঠে এক কলেমার ভিত্তিতে, তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হবে ততদিন এ জাতির জন্য পৃথিবীতে অপমান, লাঞ্ছনা, পরাজয় আর পরকালে কঠিন শাস্তি ললাটলিখন হয়ে থাকবে।