এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর লেখা থেকে সম্পাদিত-
[চৌদ্দশ’ বছর থেকে মুসলিম উম্মাহর ঘরে ঘরে দাজ্জাল সম্পর্কে আলোচনা চলে আসছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবৎ বহু ইসলামী চিন্তাবিদ, জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিত্ব এবং ধর্মের ধ্বজাধারী তথাকথিত আলেম মাওলানারা দাজ্জালকে নিয়ে অনেক বই লিখেছেন, গবেষণা করেছেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ তারা রসুলাল্লাহর দাজ্জাল সম্পর্কিত রূপক বর্ণনাগুলোকেই বাস্তব হিসেবে ধরে নিয়ে এক মহা শক্তিশালী দানবের আশায় বসে আছেন। তাদের এই বিকৃত আকীদার ফলশ্রুতিতে তারা ইতোমধ্যেই পৃথিবীতে আসা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব অস্বীকারকারী এবং নিজেকে রব দাবিদার দাজ্জালকে চিনতে পারছেন না। তারা বুঝতে পারছেন না যে তাদের অজান্তেই মানবজাতির মহাবিপদের ঘণ্টা বাজিয়ে আজ থেকে ৪৮১ বছর আগেই দাজ্জালের জন্ম হয়েছে এবং বর্তমানে সে তার শৈশব-কৈশোর পার হয়ে যৌবনে উপনীত। হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা, এ যামানার এমাম, এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী কোর’আন-হাদিস-বাইবেল, ইতিহাস এবং আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন যে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতাই হলো রসুলাল্লাহ বর্ণিত দানব দাজ্জাল। দাজ্জাল সম্পর্কে লেখা যামানার এমামের “দাজ্জাল? ইহুদি-খ্রিষ্টান ‘সভ্যতা’!” বইটি পাঠক মহলে ব্যাপক আলোচিত এবং আলোড়িত বিষয়, যা ছিল ২০০৮ সালের বাংলাদেশের বেস্ট সেলার।]
দাজ্জালের আবির্ভাবের গুরুত্বের কথা বলার পর আল্লাহর রসুল তার সম্বন্ধে বেশ কতকগুলি চিহ্ন বলে গেছেন যাতে তাঁর উম্মাহ দাজ্জালকে ‘দাজ্জাল’ বলে চিনতে পারে ও সতর্ক হয়, তাকে গ্রহণ না করে এবং তার বিরোধিতা করে, তাকে প্রতিরোধ করে। তন্মধ্যে এখানে কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করছি। এক দিক দিয়ে বিষয়টি তুলনামূলকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দাজ্জালকে দাজ্জাল বলে আমরা যদি চিনতেই না পারি তবে আমাদের বিপদের সম্ভাবনা বহু বেশি হয়ে যায়। এ অনেকটা এমন যে শত্রু যদি বন্ধু সেজে আমাদের মধ্যে প্রবেশ করে এবং আমরা তাকে শত্রু বলে না চিনি তবে বিপদের ঝুঁকি কত বেশি হয়ে যায়। এ জন্যই বোধহয় আল্লাহর রসুল দাজ্জালকে যাতে আমরা সহজেই চিনতে পারি সেজন্য অনেকগুলি চিহ্ন বলে গেছেন। কিন্তু ঐ সঙ্গে এ কথাও বলে গেছেন যে প্রকৃত মো’মেন ছাড়া, মহাপ-িত হলেও দাজ্জালকে দাজ্জাল বলে চিনতে পারবে না, যদিও দাজ্জালের কপালে “কাফের” শব্দটি লেখা থাকবে। আর মো’মেন নিরক্ষর হলেও দাজ্জালকে দাজ্জাল বলে চিনতে পারবে। [আবু হোরায়রা (রা.), আবু হোযায়ফা (রা.), এবং আনাস (রা.) থেকে বোখারী ও মুসলিম]।
আল্লাহর রসুল বলেছেন- দাজ্জালের বাহনের দুই কানের মধ্যে দূরত্ব হবে সত্তর হাত। [আবু হোরায়রা (রা.) থেকে-বায়হাকী, মেশকাত]
আরবি ভাষায় সত্তর বোলতে সাতের পিঠে শুন্য দিলে যেমন ৭০ বোঝায় তেমনি এর আরও একটা ব্যবহার আছে। সেটা হলো কোন সংখ্যাকে বহু বা অসংখ্য বোঝাবার জন্যও ঐ সত্তর সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। এটা শুধু ঐ সত্তর সংখ্যা দিয়েই করা হয়, অন্য কোন সংখ্যা, যেমন পঞ্চাশ বা একশ’ দিয়ে করা হয় না। এই হাদিসটায় বিশ্বনবী দাজ্জাল যে বিশাল, বিরাট কিছু এই কথাটা রূপকের মাধ্যমে বলেছেন। বাহনের দুই কানের মধ্যকার দূরত্ব বহু হাত হলে, বাহনটা কত বড় এবং তাহোলে সেই বাহনের আরোহী কত বড়। এই প্রসঙ্গে এখানে আরেকটি হাদিস পেশ করতে চাই। এ হাদিসটি আমি ছাত্রজীবনে ভারতের মধ্য-প্রদেশের একজন বড় আলেমের কাছ থেকে শুনেছিলাম। তখন ওটার উৎস লিখে রাখি নি এবং এখন আর কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। হাদিসটি হলো, আল্লাহর রসুল বলেছেন- দাজ্জালের ঘোড়ার বা গাধার (বাহনের) এক পা পৃথিবীর পূর্বপ্রান্তে, অন্য পা পশ্চিমপ্রান্তে হবে। এ হাদিসটি আমি সহিহ বলে বিশ্বাস করি, কারণ ওপরে আবু হোরায়রার (রা.) ঐ হাদিসটির এটি পরিপূরক ও একার্থবোধক। দু’টোরই অর্থ দাজ্জাল ও তার বাহন উভয়ই বিরাট, বিশাল ও পৃথিবীব্যাপী।
বর্তমানে পৃথিবীতে ইহুদি-খ্রিষ্টান যান্ত্রিক সভ্যতার চেয়ে বড়, এর চেয়ে শক্তিধর কিছুই নেই, এ কথায় কেউ দ্বিমত করতে পারবেন না, এটা সন্দেহাতীত সত্য। এই শক্তির কাছে সমস্ত পৃথিবী নতজানু হয়ে আছে, এর পায়ে সাজদায় পোড়ে আছে। কারো সাধ্য নেই এই সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার বা একে প্রতিরোধ করার। আরোহী দাজ্জাল হচ্ছে ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতা আর তার ঘোড়া বা বাহন হচ্ছেন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিগত যন্ত্র (ঝপরবহঃরভরপ ঞবপযহড়ষড়মু)। এই বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিগত যন্ত্রই হচ্ছে এর মহাশক্তি। এই সভ্যতার যন্ত্র আজ পৃথিবীর সর্বত্র। এ এত শক্তিশালী যে এর পারমাণবিক অস্ত্র (ঘঁপষবধৎ বিধঢ়ড়হং) আজ এই পৃথিবীকে ভেঙ্গে ফেলতে পারে। বিশ্বনবীর রূপক বর্ণনার শাব্দিক অর্থ নিয়ে যারা বিরাট এক ঘোড়ায় উপবিষ্ট একচক্ষু এক দানবের অপেক্ষায় আছেন, এই দুইটি হাদিসই তাদের ভুল ধারণা শোধরাবার জন্য যথেষ্ট মনে করি। দুই কানের মধ্যে শত শত বা হাজার হাজার হাত দূরত্ব বা পৃথিবীর দুই প্রান্তে দুই পা, এমন বাহন কি সম্ভব বা বাস্তব? এটা নড়াচড়া করবে কোথায়? এরপরও যারা ঐ ধারণা নিয়ে থাকবেন তারা কেয়ামত পর্যন্ত তাদের ধারণার (আকীদার) দাজ্জালের জন্য অপেক্ষা করতে পারেন।
আল্লাহর রসুল বলেছেন- দাজ্জালের গতি হবে অতি দ্রুত। সে বায়ুতাড়িত মেঘের মত আকাশ দিয়ে উড়ে চোলবে। [নাওয়াস বিন সা’মান (রা.) থেকে মুসলিম, তিরমিযি]
এই হাদিসের বেশি ব্যাখ্যার প্রয়োজন করে না। দাজ্জাল অর্থাৎ পাশ্চাত্য যান্ত্রিক সভ্যতার তৈরি এ্যারোপ্লেন যখন আকাশ দিয়ে উড়ে যায় তখন যে সেটাকে বায়ুতাড়িত অর্থাৎ জোর বাতাসে চালিত মেঘের টুকরোর মত দেখায় তা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন কি?
আল্লাহর রসুল বলেছেন- দাজ্জালের আদেশে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ হবে। [নাওয়াস বিন সা’মান (রা.) থেকে- মুসলিম, তিরমিযি]
বর্তমান ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতার বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি (ঝপরবহঃরভরপ ঞবপযহড়ষড়মু) আকাশে হালকা মেঘের ওপর এ্যারোপ্লেন দিয়ে রাসায়নিক পদার্থ (ঈযবসরপধষং) ছিটিয়ে বৃষ্টি নামাতে পারে এ কথা তথ্যাভিজ্ঞ প্রত্যেক লোকই জানেন। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ঐ প্রক্রিয়ায় কৃষি কাজের জন্য বৃষ্টি নামানো হচ্ছেন। সন্দেহ হলে যে কোন আবহাওয়া বিজ্ঞানীর (গবঃবৎড়ষড়মরংঃ) বা কৃষিবিদের (অমৎরপঁষঃঁৎরংঃ) কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন।
আল্লাহর রসুল বলেছেন- দাজ্জালের গরু-গাভী, মহিষ, বকরি, ভেড়া, মেষ, ইত্যাদি বড় বড় আকারের হবে এবং সেগুলোর স্তনের বোটা বড় বড় হবে (যা থেকে প্রচুর পরিমাণে দুধ হবে)। [নাওয়াস বিন সা’মান (রা.) থেকে- মুসলিম, তিরমিযি]।
তথ্যাভিজ্ঞ প্রতিটি লোকই জানেন যে ইউরোপ, আমেরিকার অর্থাৎ পাশ্চাত্য জগতের ঈধঃঃষব অর্থাৎ গরু মহিষ, বকরী ভেড়া ইত্যাদি প্রাণীর আকার বাকি দুনিয়ার ঐসব গৃহপালিত পশুর চেয়ে অনেক বড়, কোন কোনটা একেবারে দ্বিগুণ এবং ওগুলো প্রাচ্যের পশুগুলির চেয়ে চার-পাঁচগুণ বেশি দুধ দেয়। ও দু’টোই ওরা সম্ভব করেছে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে।
আল্লাহর রসুল বলেছেন- দাজ্জাল মাটির নিচের সম্পদকে আদেশ করবে ওপরে উঠে আসার জন্য এবং সম্পদগুলি ওপরে উঠে আসবে এবং দাজ্জালের অনুসরণ করবে। [নাওয়াস বিন সা’মান (রা.) থেকে- মুসলিম, তিরমিযি]
দাজ্জালের অর্থাৎ ইহুদি-খ্রিষ্টান যান্ত্রিক সভ্যতার জন্মের আগে ভূ-গর্ভস্থ অর্থাৎ মাটির গভীর নিচের খনিজ সম্পদ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান খুবই সীমিত ছিল। মাটির সামান্য নিচের কিছু কিছু সম্পদ মানুষ কখনো কখনো আহরণ করতে পারত। এই সভ্যতার সৃষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির উন্নতির ফলে দাজ্জাল মাটির গভীর নিচ থেকে, এমনকি সমুদ্রের তলদেশ থেকে তেল, গ্যাস ইত্যাদি নানা রকমের খনিজ সম্পদ ওপরে উঠিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে ও পৃথিবীময় তা ওঠাচ্ছে। এটাকেই মহানবী বলেছেন যে, দাজ্জালের আদেশে মাটির নিচের সম্পদ ওপরে উঠে আসবে। তারপর ঐ সম্পদ দাজ্জালকে অনুসরণ করবে তার অর্থ হলো এই যে, মাটির নিচ থেকে ওপরে উঠে আসার পর দাজ্জাল তা পৃথিবীর যেখানে ইচ্ছা নিয়ে যাবে, যেখানে ইচ্ছা পাঠাবে, ঐ সম্পদ দাজ্জালের যন্ত্রপাতি, কল-কারখানা, জাহাজ, গাড়ি, যুদ্ধের যানবাহন ইত্যাদি সমস্ত কিছুতে ব্যবহার করবে। আজ বিশ্বনবীর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্যায়িত হয়েছে।