হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

আমার শিক্ষা

হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম:
শিক্ষাব্যবস্থার গলদ নিয়ে, ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে হর হামেশাই আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। অতি সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রীর ‘সহনশীল দুর্নীতি’ প্রসঙ্গ নিয়ে সেই আলোচনা নতুন মাত্রা পেয়েছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দার্শনিক দিক বলতে গেলে অনেকের কাছে জটিল-দুর্বোধ্য আর ইতিহাস বলতে গেলে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। তাই আমি সে দিকগুলোতে যাব না, আমি আমার ব্যক্তিগত জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে শিক্ষাব্যবস্থার মূল্যায়ন করতে চাই।
আমার মনে পড়ে আমার দাদাজান আমাকে আর আমার ছোটভাইকে হাতে ধরে বাড়ির এক কিলোমিটার দূরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে গেলেন। জীবনে প্রথমবার স্কুলে যাওয়ার অনুভ‚তি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমরা জড়সড় হয়ে দাদার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। হেড স্যারের হাতে একটা জালি বেত, একটা ক্লাস শেষ করে এসে দাঁড়িয়েছেন। স্কুলে বেত মারা হয় সেটা আগে থেকেই শোনা ছিল তাই আমরা আরো জড়সড় হয়ে গেলাম। আশেপাশে আমার বয়সী কত বাচ্চাকাচ্চা কোলাহল করছে দেখে নিজের ভেতরেও অনেক উত্তেজনা বোধ করলাম। কিছুক্ষণ বাদে বুঝলাম আমাদেরকে স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে। আমাকে ক্লাসে রেখে দাদাজান চলে গেলেন। অনাত্মীয় পরিবেশে প্রথম প্রথম নিজেকে একটু অসহায় লাগল। কিছুক্ষণ পর দেখলাম বাছাই করে নিয়ে আমাকে একটা টুলে বসালো আর আমার ছোট ভাইকে নিয়ে ফ্লোরে বসালো। বাম পাশে দেখলাম আমার থেকে দুই বছর ছোট বালক-বালিকাগুলোকে একটা ফ্লোরের মধ্যে রাখা হয়েছে, যেখানে তারা খুব চিৎকার করে পড়ছে। তারা মেঝেতে পড়ছে আর আমরা টুলে। তখন আমার নিজের মধ্যে বড়ত্বের একটা ভাব জাগলো, মনে হলো আমি বড়।
এবার আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গোড়ার কথাটা বলে নেই। আমি যখন একজন মহামানব জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর সংস্পর্শে এলাম, আমি জানলাম ব্রিটিশরা এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার গোড়া পত্তন করেছে। এর পর পাকিস্তান আমল গেছে। ১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমাদের শিক্ষা ও সমাজকাঠামোতে বিরাট পরিবর্তন এনেছে এই স্বাধীনতা যুদ্ধ। যুদ্ধের বছর ছাত্ররা পড়াশোনা করতে পারে নি, তাই সে বছর এক রকম বিনা পরীক্ষাতেই সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছিল। ‘বাহাত্তরের পাশ’ কথাটি পরবর্তী বছরগুলোতে তুচ্ছার্থে ব্যবহার করা হতো। ধীরে ধীরে বন্ধু-বান্ধব বাড়ল, ভয়ভীতি কেটে গেল। ক্লাস টু শেষ করে ক্লাস থ্রিতে উঠার পর বুঝতে পারলাম যে আমি কোন বিষয়ে ভালো পারি আর কোন বিষয়ে দুর্বল। যেই বিষয়ে পিটুনি খাই বুঝলাম সেটাই কঠিন বিষয়। শিক্ষকেরা সেই কঠিন বিষয়টিতে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার পরিবর্তে অধিক পিটুনি দিতেন। গণিত আর ইংরেজি মানেই বেত অবধারিত। সব চাইতে কড়া স্যার গণিত আর ইংরেজি পড়ান।
একদিন হঠাৎ করে দেখলাম হেড স্যারের রুমে প্রচুর চিৎকার চেচামেচি। ঘটনা কী? আমরা সবাই বেড়ার ফাঁক দিয়ে গিয়ে ভীড় করলাম মৌমাছির মতো। রুমের ভেতরে একজন আরেকজনকে বলছে, “তুই কিসের মাষ্টার? তুই হচ্ছিস ভুয়া।” আরেকজন বলছেন, “তুই ভুয়া। তুই কি পাশ করেছিস? তোকে আমিই নকল সাপ্লাই দিয়ে পাশ করিয়েছি।” আরেকজন বলছেন, “তুই চোর।” জবাবে অপরজন বললেন, “তুই চোর না, তুই ডাকাত।” এভাবে একজন আরেকজনকে ভুয়া পাশ, ৭২ এর পাশ, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, তোর সার্টিফিকেট জাল, তুই পঙ্গু না তবুও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার ভাতা খাস ইত্যাদি বলে গালিগালাজ করতে লাগল। তখন কিন্তু মাথা-মুÐু কিছুই বুঝতাম না। শুধু বুঝতাম এসব বুঝি স্যারদের মধ্যে হয়েই থাকে।
ঘটনা হচ্ছে যিনি প্রধান শিক্ষক তিনি ছিলেন গণিতের শিক্ষক। আর যিনি আরেক মুক্তিযোদ্ধা তিনি সত্যিই পঙ্গু না হয়েও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ভাতা গ্রহণ করেন। তিনি আর দশটা যুবকের চেয়েও সুস্থ ও শক্তিশালী ছিলেন। তিনিই আমাদের বাংলা কিংবা সমাজ পড়াতেন। যাই হোক, প্রাইমারি স্কুলে যেভাবে ইংরেজি পড়ানো হতো সেটা স্মরণে আসলে আমি আজ উপলব্ধি করি যে আমরা কোথায় মারটা খেয়েছি। কীভাবে আমাদেরকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে, আমরা যতই পড়াশুনা করি ইংরেজিতে শুদ্ধ করে কথা বলা বা লেখা কিছুই শিখতে পারি না।
এই করতে করতে আমরা প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে আসলাম। বইয়ের সংখ্যা ও পুরুত্ব বৃদ্ধি পেল। হাইস্কুলের প্রথম ক্লাসেই কিছু সিনিয়র ভাইকে দেখলাম যারা আদু ভাই হিসাবে আখ্যায়িত হতেন। তারা ছোটদের ধরে ধরে পেটাতেন আর বুঝিয়ে দিতেন যে ক্লাস সিক্সের মাতবরী কার। ইংরেজি স্যার সব সময় বেত মারেন, প্রতি শব্দেই বেত। আর গণিতের স্যার সহজেই কোনো কথা বলেন না। তিনি অত্যন্ত ভারী প্রকৃতির ভদ্রলোক। এ পর্যন্ত আমি দেখেছি গণিতে ভালো হিন্দুরা, খুব ভালো গণিত শিক্ষক মুসলমানদের মধ্যে আমি খুব একটা দেখি নি, স্কুলেও না আমি কলেজেও দেখেছি। হিন্দু স্যারেরা হলেন গণিতে ভালো। লোকেরা বলত এর কারণ হিন্দুদের মাথা নাকি ঠাণ্ডা আর মুসলমানরা গরু খায় বলে মাথা গরম আর ঘিলুও ওই রকম। তখন ওই ব্যাখ্যাকেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হতো।
আমাদের যিনি বাংলা ব্যাকরণ পড়াতেন তাঁর নাম ছিল বাবু মতিলাল মজুমদার। কিন্তু সবাই তাঁকে পদ্ধতি স্যার বলত। তিনি খুবই উদার মানসিকতার লোক ছিলেন। হাইস্কুলে আমাদের শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কী সেটা নিয়ে কেউ কোনোদিন কোনো প্রশ্ন তোলে নি। আমরাও কোনোদিন ভাবিও নি পড়ানোর কৌশল কতো নিখুঁত, বিজ্ঞানসম্মত সেটাও বিবেচনা হয়নি। আমরা ধরেই নিয়েছি আমাদের ইংরেজি স্যার ইংরেজির কর্তৃপক্ষ, তিনি যা পড়ান সেটাই সর্বোচ্চ ইংরেজি। তাঁর শিক্ষা সঠিক না ভুল সেগুলো যাচাই করার কোনো সুযোগ আমাদের ছিল না। আর আমাদের গণিতের শিক্ষক গণিতের মূল পরিভাষাগুলোর ব্যাখ্যা কী সেগুলো কোনোদিন বলেছেন বলে আমার মনে পড়ে না।
হাইস্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার পরে যখন কলেজে আসলাম তখন বিজ্ঞান বিভাগে আমি ভর্তি হলাম। ভর্তি হবার সঙ্গে সঙ্গেই একটা তথ্য জেনে গেলাম যে ক্লাসের বাইরে কোনো একজন স্যারের কাছে পড়তে হবে। তাহলেই ভালো ফলাফল সম্ভব। শুরু হলো কোচিং আর প্রাইভেট পড়ার প্রতিযোগিতা। শিক্ষাজীবনের এই পর্বে এসে বুঝলাম আমাদের অতীত হওয়া শিক্ষাজীবনে ভুল শিক্ষার বহর।
জীবনের বর্তমান পর্যায়ে এসে যখন আদর্শ প্রচারের জন্য পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নিলাম তখন আমার শিক্ষার ঘাটতিগুলো অনুভব করতে লাগলাম। বুঝলাম যে বিদেশী ভাষা দূরে থাক, আমার মাতৃভাষা বাংলার মধ্যেও কত কিছু শেখার আছে। স্কুলে আমাদেরকে ভাবসম্প্রসারণ করানো হয়েছে কিন্তু কখনও ভাবসম্প্রসারণের মূলনীতিগুলো শেখানো হয় নি। পড়া দেওয়া হয়েছে, মুখস্থ করেছি, পরীক্ষার খাতায় লিখে এসেছি, পড়া না পারলে হাত পেতে বেত খেয়েছি। কী করে দুই লাইনকে দুই পাতায় পরিণত করা যায় তা আর শিখতে পারি নি। একইভাবে একপাতা লেখাকে কী করে তিন/চার লাইনের সারাংশে পরিণত করা যায় সে বিদ্যাও অজানা রয়ে গেছে।
তারপরে লেখার ক্ষেত্রে বানান রীতিতে যে কী পরিমাণ ভুল আমরা করি সেটা স্কুল-কলেজে কোথাও আমি শিখতে পারি নি। গত বাঁধা কারক-সমাস-বিভক্তি শুধু পড়েই গেছি। এমন কি আমাদের শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি যে তাঁরা বাংলা ব্যাকরণের প্রয়োগ করে সঠিক বানান লেখার জ্ঞান কতটুকু আয়ত্ব করতে পেরেছিলেন সেটা নিয়েও আমার সন্দেহ আছে। বিদ্রোহী কবি নজরুলের ‘আমি হবো সকাল বেলার পাখি’ কবিতাটির তাৎপর্য আমি গোটা শিক্ষাজীবনেও জানতে পারি নি। এখন বুঝি যে, সকাল বেলার পাখিটা কী? এখানে তিনি যে বলছেন মা তুমি ঘুমিয়ে থাকো, এই মা কে? তিনি বলছেন, আমরা যদি না জাগি তাহলে জাতি জাগবে না। এই যে জাতিকে জাগানিয়া ডাক, সেই ডাক আমাদের কয়জন শিক্ষক এই কবিতা পড়তে গিয়ে শুনতে পেয়েছেন জানি না। বাচ্চাদের কাছে যে বিষয়টা কঠিন লেগেছে তারা সেটাকে এড়িয়ে সহজ রাস্তা নিয়েছে, মুখস্থ করে ফেলেছে, সম্ভব হলে নকল করেছে, ফাঁকিবাজি করেছে। কিন্তু জীবনের একটা পর্যায়ে এসে আমাকে এবং আমাদের অনেককেই সেই পুঞ্জিভ‚ত ফাঁকির সম্মুখে দাঁড়াতেই হয়েছে। অথচ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দায়িত্ব ছিল ঐ কঠিন জায়গাগুলো পরিষ্কার করে ছাত্রদের বুঝিয়ে দেওয়া। শিক্ষকরা যেহেতু নিজেরাও সেগুলো পরিষ্কার নন, তাই তাদের পক্ষে ছাত্রদেরকেও এর চেয়ে ভালো জ্ঞান দেওয়া সম্ভব ছিল না। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ পর্যাপ্ত না থাকাটা শিক্ষাব্যবস্থার বড় একটা ত্রুটি।
আসলে আমাদের গোড়ার গলদটা হচ্ছে এই শিক্ষাব্যবস্থাটা ব্রিটিশদের তৈরি যা আসলে আমাদের দেশের মানুষের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণই নয়, এটা তৈরিই করা হয়েছিল ব্রিটিশদের কেরানি যোগান দেওয়ার জন্য। এখন কয়জন শিক্ষক আছেন যে ইংরেজি বলতে জানেন? তাহলে তাঁরা ছাত্রদের কী করে ইংরেজি শেখাবেন? কয়জন শিক্ষক ইংরেজি পত্রিকা পড়েন, ইংরেজি শুনে বুঝতে পারেন যে তাঁরা ছাত্রদেরকে ঐ দক্ষতাগুলো দান করবেন? এজন্য আমাদের সবার আগে দরকার একটি নীতিমালা ঠিক করা যে আমরা কতটুকু ইংরেজি পড়ব? আমার জীবনে কতটুকু ইংরেজি জানার দরকার হতে পারে। আমার বাস্তব জীবনকে সামনে রেখে সে মোতাবেক ইংরেজির সিলেবাসটা বানাতে হবে। এরকমভাবে সবগুলো বিষয়ে আমাদের লক্ষ্যটা আগে নির্ধারণ করতে হবে যে এতটুকু জানলে বোঝা যাবে যে আমি বিষয়টা যথেষ্ট জানি। এই লক্ষ্যটাই আমাদের ঠিক করা হয় নি। ফলে কেউ ২০% শিখছে, কেউ ৩০% শিখছে কিন্তু কোনোটাই কাজে আসছে না, ফলাফল শূন্য। না তারা ইংরেজিতে কথা বার্তা চালাতে পারে, না শুদ্ধ করে এক পাতা লিখতে পারে, না একটি ইংরেজি বই পড়ে শিখতে পারে, না ইংরেজি গান শুনে বুঝতে পারে।
এখন আমাদের উচিত হবে নিজেদের শিক্ষাব্যবস্থাকে নিজেদের প্রয়োজন মোতাবেক ঢেলে সাজানো যেন তা জাতির মধ্যে কোনোরূপ বিভাজন সৃষ্টি না করে, মানুষকে জড়বাদী ও স্বার্থপর না করে, অপর জাতির প্রতি গোলামি মানসিকতাসম্পন্ন ও নীতিনৈতিকতা বিবর্জিত প্রাণীতে পরিণত না করে, শিক্ষার্থীদেরকে দেশপ্রেম ও ঈমানী চেতনায় উদ্বুদ্ধ সত্যনিষ্ঠ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলে।

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...