মোহাম্মদ আসাদ আলী:
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পশ্চিমাদের উন্নতিসাধন দেখে অনেকে একটি ভুল ধারণা করে বসেন যে, ‘যেহেতু হালের অধিকাংশ প্রযুক্তিই পশ্চিমাদের তৈরি, সুতরাং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে অভিনব উৎকর্ষতা অর্জিত হয়েছে, তার কৃতিত্বের দাবিদার শুধু পশ্চিমারাই, অন্য কোনো জাতির বিশেষ কৃতিত্ব এখানে নেই।’ এমন মনোভাব পোষণ করেন যারা তাদেরকে বুঝতে হবে- মানবজাতির জ্ঞান বিজ্ঞান একটি ধারাবাহিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে, রাতারাতি কোনো নির্দিষ্ট জাতির একক প্রচেষ্টায় তা হয় নি।
উড়োজাহাজ, বৈদ্যুতিক বাল্ব, রেডিও-টেলিভিশন ইত্যাদি আবিষ্কৃত হয়েছে সেদিন, কিন্তু আবিষ্কারের পটভূমি রচিত হচ্ছিল পৃথিবীর প্রথম মানুষটি থেকেই। এর সাথে মিশে আছে হাজার হাজার বছরের লাখো মানুষের সঞ্চিত জ্ঞান, সাধনা, শ্রম, চিন্তা-ভাবনা ও কল্পনা। একজনের সফলতার পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে হাজারো মানুষের ব্যর্থতা। বিষয়টি একটি সিড়ির বিভিন্ন ধাপের মত। প্রথম ধাপ আছে বলেই আপনি দ্বিতীয় ধাপে পা রাখতে পারছেন। দ্বিতীয়টি আছে বলে তৃতীয়টিতে। এই একেকটি ধাপকে যদি একেকটি জাতি-গোষ্ঠী হিসেবে কল্পনা করা হয়, তাহলে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন সময়ের ভিন্ন ভিন্ন অনেকগুলো জাতি, গোত্র, গোষ্ঠী ও দেশের মানুষের শ্রম ও সাধনার ভিত্তিতে বিজ্ঞানের যে সিড়িটি তৈরি হয়েছে, আজকের পাশ্চাত্য সভ্যতা সেই সিঁড়িটির সর্বোচ্চ ধাপটিতে অবস্থান করছে মাত্র, আর কিছু নয়।
উদাহরণস্বরূপ, কাঁচ আবিস্কৃত হয়েছে আজ থেকে হাজার বছর আগে। আর টমাস আলভা এডিসন বৈদ্যুতিক বাল্ব আবিষ্কার করেছেন উনবিংশ শতাব্দীতে এসে। এই দুইয়ে মিলে আজ আমাদের ঘর হয়েছে আলোকোজ্জ্বল, আমরা অতিক্রম করতে পেরেছি আরেকটি নতুন ধাপ। আসলে বর্তমানে আমরা এমন একটি বৃক্ষের ফল ভোগ করছি যে বৃক্ষটির পরিচর্যা শুরু হয়েছে পৃথিবীর সেই প্রথম মানুষটি থেকেই। তারপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জাতি-গোত্রের মানুষ সে বৃক্ষের পরিচর্যা করে এসেছে। অতঃপর আজ বৃক্ষটি উপনীত হয়েছে পরিণত বয়সে। তাতে সুস্বাদু ফল ধরতে শুরু করেছে। আর পাশ্চাত্য সভ্যতা সেই ফলটাই পেড়ে খাওয়াচ্ছে আমাদের।
ইতিহাস সচেতন মানুষমাত্রই জানেন মাত্র কয়েক শতাব্দী আগেও পাশ্চাত্যের সমাজে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা বলে কিছু ছিল না। বাইবেলবিরোধী সত্য বললে আগুনে পুড়িয়ে মারা হত। তখন আবার জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিস্ময়কর উৎকর্ষ অর্জন করেছিল আরবরা। আরবদের কাছে বিজ্ঞান শিখত অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীগুলো। পরবর্তীতে ধর্মের উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলায় জ্ঞানকে কেবল ধর্মীয় শাস্ত্রের জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেললে আরব তথা সারা পৃথিবীর মুসলিমরা বিজ্ঞান চর্চায় পিছিয়ে পড়ে। বিজ্ঞানের অসমাপ্ত ইমারত তখন লুফে নেয় পাশ্চাত্য। ফলে আজ তারা পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের কর্ণধার, যার ভিত্তি মজবুত করেছিল মুসলমানরা।
কোনো সভ্যতাই চিরস্থায়ী হয় না। হয়ত একদিন পাশ্চাত্যও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় পিছিয়ে পড়বে। তাদের উৎকর্ষতাকে আরও বহুগুণে বৃদ্ধি করবে অন্য কোনো জাতি, গড়ে উঠবে অন্য কোনো সভ্যতা। তবে উত্থান-পতন যা-ই হোক, বিজ্ঞান থেমে থাকবে না। তাকে তার লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। একদিন জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ ধাপটিতে পদার্পণ করবে মানুষ। পূর্ণতা পাবে বিজ্ঞান নামক ইমারতটি, যা হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান-মুসলমানের একার সম্পদ নয়, পাশ্চাত্যের বা প্রাচ্যেরও নয়, মেরু বা মরু অঞ্চলের নয়, সেটা সমগ্র মানবজাতির সম্পদ।