রিয়াদুল হাসান:
আমাদের দেশের সরকারগুলোও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতোই শক্তি প্রয়োগ করে জঙ্গিবাদকে মোকাবেলা করতে চেষ্টা করছে। কিন্তু এটা প্রমাণিত সত্য যে, শুধু শক্তি প্রয়োগ করে মতবাদগত সন্ত্রাস কখনও নির্মূল করা যায় না। একটি অন্যায়, অবিচারপূর্ণ সমাজের পরিবর্তন ঘটানোর জন্য যুগে যুগে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে, কেউ তাদের সন্ত্রাসের পক্ষে ধর্মকে আশ্রয় করেছে, কেউ জাতীয়তাবাদকে, কেউ সাম্যবাদকে। আমরা হেযবুত তওহীদ ২০০৯ সন থেকে সরকারের প্রতি প্রস্তাবনা পেশ করে আসছি, দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে, জনসভা-সেমিনার ইত্যাদির মাধ্যমে বলে আসছি যে জঙ্গিবাদীরা যে আদর্শ (ওফবড়ষড়মু) মানুষের সামনে উপস্থাপন করে তাদেরকে প্রভাবিত করছে আমাদের উচিত সেই আদর্শের ত্রুটিগুলো মানুষের সামনে যুক্তি প্রমাণ ও ধর্মীয় রেফারেন্স দিয়ে (ঈড়ঁহঃবৎ ঘধৎৎধঃরাব) সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা যেন মানুষের ধর্মীয় চেতনা ভুল পথে, মানবতাবিধ্বংসী পথে পরিচালিত না হয়। সরকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে ট্যাকটিক্যাল ওয়ার বা কৌশলগত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পাশাপাশি ওফবড়ষড়মরপষধ ধিৎ বা আদর্শিক লড়াইও অপরিহার্য। কেননা ধর্মীয় চেতনার অপব্যবহার এমনই একটি বিষয় যা কেবল বুলেট বোমা দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। আমাদের দৈনিক বজ্রশক্তির মূল কাজ এই ধর্মীয় চেতনার অপপ্রয়োগ, ধর্মের উদ্দেশ্যমূলক অপব্যাখ্যার বিপরীতে ধর্মের প্রকৃত আদর্শ তুলে ধরা যার মাধ্যমে এই সকল বিষবৃক্ষকে শেকড়সুদ্ধ মানুষের মগজ ও হৃদয় থেকে উপড়ে ফেলা, পাশাপাশি যে ধর্ম মানুষকে উন্নত জীবে পরিণত করে, প্রগতিশীল করে, ভারসাম্য দেয়, ন্যায়ের পক্ষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আত্মিক প্রেরণা দান করে সেই শিক্ষাগুলোকে মানুষের সামনে মেলে ধরা। তাহলেই আবার এ জাতির মধ্যে চিন্তার জাগরণ হবে, মগজের বন্ধ দরজাগুলো খুলে যাবে, নতুন করে আবার তারা একটি রেনেসাঁর সূত্রপাত ঘটাবে।
যখন কোনো সমাজ অচলায়তনে পরিণত হয়, প্রথাগুলো প্রগতির অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, ধর্মান্ধতা ও কূপম-ূকতা প্রবল শক্তিমান হয়ে ওঠে, অযৌক্তিক বিজ্ঞানহীন চিন্তাচেতনায় মাকড়শার জালে বন্দী পতঙ্গের ন্যায় সমাজ ছটফট করতে থাকে তখন সেই জালকে ছিন্ন করতে আবির্ভূত হন কিছু দৃষ্টিবান মানুষ যারা আপ্রাণ চেষ্টা করেন সমাজব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার জন্য। তারা ইতিহাসের গতিপথকে পাল্টে দেন। তাদের এই সম্মিলিত আঘাতকে বলা হয় রেনেসাঁ। মানবজাতি বার বার এই রেনেসাঁর অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। সচেতন ব্যক্তিমাত্রই জানেন যে মানবসভ্যতার চিন্তাজগতে সাম্প্রতিকতম রেনেসাঁটি হয়েছিল ইউরোপে। আধুনিক এই সভ্যতার জন্ম হয়েছিল সেই রেনেসাঁর হাত ধরেই। এই রেনেসাঁরও প্রধান নিয়ামক ছিল মানুষের হৃদয়ে পরিবর্তনের বাসনা তীব্র হয়ে উঠেছিল, কারণ মানুষ তাদের সঙ্কট উপলব্ধি করেছিল।
মধ্যযুগের ইউরোপে দীর্ঘকাল থেকে চলছিল দাসপ্রথা, সামন্তপ্রভুদের দুঃশাসন। খ্রিষ্টান ধর্মযাজকদের ফতোয়ার তরবারিতে নির্দোষ মানুষের রক্তসাগর বয়ে গিয়েছিল। ধর্মযাজকদের কথা ছিল তাদের কথা মানলে পরকালে স্বর্গপ্রাপ্তি হবে, না মানলে নরক। কথায় কথায় তারা ফতোয়া দিয়ে মানুষকে পুড়িয়ে মারতো, নৃশংস উপায়ে হত্যা করতো। একদিকে সামন্তবাদী প্রভুদের বিপুল ভোগ বিলাস আর ক্ষমতার চাবুক, অপরদিকে সীমাহীন দারিদ্র্য আর বঞ্চনা। যারা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কথা বলতেন, যারা চিন্তাশীল, বিজ্ঞানী, সংস্কারপন্থী দার্শনিক ছিলেন তাদেরকে ধর্ম-অবমাননার অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হতো। এই সময়কেই বলা হয় ডার্ক এইজ বা অন্ধকারের যুগ, জাহেলিয়াতের যুগ।
তখন ধর্মযাজকদের প্রাচীন ধ্যানধারণা, জড়ত্ব, স্থবিরতা, অন্ধত্ব, সবকিছুর মধ্যে পরকালীন শাস্তির ভীতিপ্রচার, নিজেদের ঐশ্বরিকতা ইত্যাদি ধ্যান-ধারণা থেকে বাইরে বের হবার চেষ্টা করেছে শ্বাসরুদ্ধ মানুষ। তাদের চিন্তাকে ঐ জড় ধর্মচিন্তার কারাগার থেকে বের করে এনেছে বহু জীবনের বিনিময়ে, রক্তের বিনিময়ে, বহু প্রজন্মের সম্মিলিত প্রয়াসে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আর রাজতন্ত্রের যাঁতাকলের নিষ্পেষণ থেকে অসহায় মানবতাকে পরিত্রাণ করতে ইউরোপের সাহিত্যিকরা সাহিত্য রচনা করতে লাগলেন, নাট্যকাররা নাটক লিখতে লাগলেন, কবিরা কবিতা লিখলেন, শিল্পীরা ছবি আঁকলেন। তাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মানুষের চিন্তার বন্ধঘরের তালা খুলে গেল, নতুন নতুন জ্ঞানের দুয়ার উন্মোচিত হলো। সাংঘাতিক এক রেনেসাঁর সৃষ্টি হল। সে অচলায়তন থেকে বের হয়ে মানুষ দেখল যে না আসলেই তো আমার অনেক চিন্তা করার বিষয় আছে। সে একটা মুক্ত আকাশ পেয়েছে। এই যে চিন্তার মুক্তি তা মানুষকে নতুন একটি সভ্যতার সম্ভাবনার ঊষালগ্নে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এরই নাম তারা দিয়েছে রেনেসাঁ (ৎবহধরংংধহপব), নবজাগরণ। সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের, শিল্প-সাহিত্যের একটা স্ফূরণ ঘটে গেছে। সেই সকল রেনেসাঁর ফলেই আজকে আমরা মানবজাতি জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তিগত এই উন্নতির যুগে উপনীত হয়েছে।
যারা ইউরোপীয় রেনেসাঁর অগ্রনায়ক তাদের লক্ষ্য ছিল এই পৃথিবীটাকে তারা স্বর্গে অর্থাৎ শান্তিময় আবাসে রূপান্তরিত করবেন। একদিকে বিকশিত হলো শিল্প-সাহিত্য, প্রযুক্তি আরেকদিকে জীবন চালানোর জন্য একটার পর একটা সৃষ্টি হলো উদারনৈতিক গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, আন্তর্জাতিকতাবাদ, সাম্যবাদ, পুঁজিবাদ ইত্যাদি। এগুলো তারা রচনা করলেন ঐ চিন্তাশক্তি দিয়ে, মস্তিষ্ককে স্বাধীনভাবে ব্যবহার করার মাধ্যমে। যারা করেছে তারা নিজেদের সমাজের সঙ্কটটাকে উপলব্ধি করেছিলেন বলেই পরিবর্তনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু সেই সভ্যতা বস্তুগত উন্নতির পাশাপাশি মানবজাতিকে এমন একটি নির্মম বাস্তবতা উপহার দিয়েছে যা অতীতের সব ভয়াবহতাকে ছাড়িয়ে গেছে। দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে রেনেসাঁর যে নেটফল মানুষ লাভ করেছে তাতে তাদের সকল প্রাপ্তি অর্থহীনতায় পর্যবসিত হয়েছে। বিশ্বমানবতা সেই দানবিক শক্তির সামনে আত্মসমর্পণ করে নিয়েছে। এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, সেই মহান রেনেসাঁ কার্যত একটি আত্মাহীন একপেশে আখেরাত-বর্জিত, পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায়ের জ্ঞানশূন্য, ভারসাম্যহীন সভ্যতার জন্ম দিয়েছে যা আসলে কোনো সভ্যতাই নয়, বরং ভোগবাদী একটি যান্ত্রিক প্রগতিমাত্র (টঃরষরঃধৎরধহ ঞবপযহড়ষড়মরপধষ ধফাধহপবসবহঃ)।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে জ্ঞানের ভারসাম্যহীনতার ফলে, ন্যায়-নীতির ভুল মানদ-কে ধারণ করার কারণে জ্ঞান বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষের যুগেও মানুষকে এখনও তাদের বাস্তবজীবনে চরম অন্যায়-অবিচার, খুন-ধর্ষণ, নিরাপত্তাহীনতা, দুঃখ-ক্লেষ, যুদ্ধবিগ্রহ, রক্তপাতের মধ্যেই বাস করতে হচ্ছে। যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ছিল আশীর্বাদ সেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিই অপশক্তির কুক্ষিগত হওয়ার কারণে মানবতার বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, মানবজাতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত করেছে, ফেলে দিয়েছে অস্তিত্বের সংকটে। আজও চলছে শক্তিমানের শাসন, পুরো মানবজাতি ন্যায়-অন্যায় ভুলে পারমাণবিক শক্তির সামনে, তাদের যাবতীয় অন্যায়ের সামনে আত্মসমর্পণ করে আছে। গ্রাম থেকে শুরু করে বিশ্ব সর্বত্র এখন সরলের উপর ধূর্তের প্রতারণা, দরিদ্রের উপর ধনীর বঞ্চনা, শাসিতের উপর শাসকের জুলুম। নিরপরাধ শিশুর রক্তে আজ পৃথিবীর মাটি ভেজা। যেন সেই অন্ধকার যুগের (উধৎশ ধমব) প্রেতাত্মা এই সময়ের কাঁধে ভর করেছে। (চলবে)