মোহাম্মদ আসাদ আলী:
নতুন বছরের শুরুতে একজন অপরজনকে ‘শুভেচ্ছা’ বা ‘শুভকামনা’ জানাবেন এটাই প্রথা। ভালো-মন্দ মিলিয়ে সব মানুষই নতুন বছরকে ইতিবাচকভাবে শুরু করতে চান। অতীতের ভুল ত্রুটি শুধরে নিয়ে নতুনকে সুশোভিত করতে চান শান্তি ও সুন্দরের সাজে। কিন্তু তার বদলে যদি বছরের শুরুটাই হয় খুন আর ধ্বংসের বার্তা দিয়ে তাহলে বাকি দিনগুলো কেমন যেতে পারে?
না, নিছক কল্পনা নয়, এটাই সত্য হয়েছে এ বছর। যুদ্ধ, রক্তপাতে পরিপূর্ণ ২০১৭ সালের পর ২০১৮ সালটিও শুরু হলো যুদ্ধের হুংকার দিয়ে। প্রথমে হুংকার দিলেন উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উন, তারপর দিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর কেমন সেই রণহুংকার? এ যেন বিশ্বের শক্তিশালী দুইটি দেশের রাষ্ট্রনায়কের বাণী নয়, যেন কলহোদ্যত দুইটি অবুঝ শিশুর উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়!
২০১৭ সালে একের পর এক ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষা এবং যুদ্ধের হুমকি দিয়ে আলোচনায় থাকা উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উন নতুন বছরও শুরু করেছেন যুদ্ধের হুমকি দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে কিম বলেছেন, ‘পারমানবিক বোমার বোতাম সবসময় আমার টেবিলেই থাকে।’ নতুন বছর উদযাপন উপলক্ষে টেলিভিশনে দেয়া এক বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, ‘সমস্ত যুক্তরাষ্ট্র নর্থ কোরিয়ার পারমানবিক অস্ত্রের আওতায়। এটি বাস্তবতা, কোন হুমকি নয় বলেও যোগ করেন তিনি।’ এর জবাব দিয়েছেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনিও দম্ভ করে বলেছেন তার পরমাণু বোমার সুইচ উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং উনের বোমার সুইচের চেয়ে ‘অনেক বড়’ এবং ‘বেশি শক্তিশালী’’। বলার অপেক্ষা রাখে না- যে কোন অ্যামেরিকান প্রেসিডেন্টের হাতের কাছেই পরমাণু বোমার সুইচের কোড থাকে এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরমাণু অস্ত্র ভাণ্ডারও আমেরিকারই।
প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন বছরের শুরুতে যখন বিশ্বের সুস্থচিন্তার মানবতাপ্রেমী মানুষরা শান্তিপূর্ণ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছেন ঠিক সেই সময় পরাশক্তিধর রাষ্ট্রনায়কদের এই যুদ্ধংদেহী মনোভাব এবং কথায় কথায় পরমাণু অস্ত্রের হুমকি বিশ্বকে কী বার্তা দিচ্ছে? সব হুমকিই কি শেষ পর্যন্ত হুমকিতে সীমাবদ্ধ থাকবে, সব হুংকারই কি শেষ পর্যন্ত হুংকারেই সীমাবদ্ধ থাকবে? একটি হুংকারও যদি বাস্তবে রূপ নেয়, কোনো একটি দেশের প্রেসিডেন্ট যদি হঠকারিতাবশত পরমাণু অস্ত্রের ‘বোতামে’ চাপ দিয়েই ফেলেন- তাতে কী পরিণতি হতে পারে?
কী হতে পারে তার বিশ্লেষণ বহু বছর ধরেই চলে আসছে। বিশেষজ্ঞরা অনেক ধরনের আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করে চলেছেন। তবে একটি ব্যাপারে কারো মধ্যে দ্বিমত নেই যে, তা এক মহাধ্বংসের সূচনা করবে, যে ধ্বংসের নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। পৃথিবীর ছোটবড়, শক্তিশালী-দুর্বল সব ধরনের রাষ্ট্রই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এই বিপর্যয়ে জড়িয়ে পড়বে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরামাণু অস্ত্রের প্রয়োগ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই বোমার তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতি ভাষায় প্রকাশ করার সাধ্য আমার নেই, আর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষয়ক্ষতি আজ পর্যন্ত কাটিয়ে ওঠা যায় নি। এখনও পৃথিবীর বুকে সেই বোমা দুইটির ক্ষত লেগে আছে। এরপর আর কোনো পরামাণু যুদ্ধ শুরু হয় নি। না হবার কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয় ব্লকে পৃথিবীর ভাগ হয়ে যাওয়া এবং দুই শক্তির হাতেই পরমাণু অস্ত্রের মজুদ থাকা। শত্রুকে মারলে আমিও মরব- এই ভয়ই কেবল পরমাণু যুদ্ধ থেকে বিশ্বকে এখন পর্যন্ত হেফাজত করে এসেছে, বর্তমানেও তাই। এখনও পৃথিবী মোটামুটি দুইটি শিবিরেই বিভক্ত। পার্থক্য হচ্ছে- সরাসরি ওই দুই শিবিরের অন্তর্ভুক্ত না হয়েও অনেক রাষ্ট্র পরামাণু অস্ত্রধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে এবং এই রাষ্ট্রগুলোও আজ হোক কাল হোক শত্রুকে বাগে পেলে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার ঘটাতে এতটুকু দ্বিধা করবে না। কত কোটি মানুষ মরল, কত কোটি গাছ-পালা, স্থাপনা ধ্বংস হলো তা দেখবে না। শত্রুকে ধ্বংস করতে হবে এটাই শেষ কথা।
ডোনাল্ড ট্রাম্প কিম জং উনকে ডাকেন ‘লিটল রকেট ম্যান’ নামে, আর মি: কিমের কাছে ডোনাল্ড ট্রাম্প হচ্ছে ‘ভীমরতিগ্রস্ত এক বৃদ্ধ’। মানবজাতির দুর্ভাগ্য হচ্ছে- এই লিটল রকেট ম্যান ও ভীমরতিগ্রস্ত বৃদ্ধদের হাতেই নির্ভর করছে তাদের ভবিষ্যৎ! এরাই ঠিক করে দিচ্ছে আগামী বছর মানবজাতি নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে, নাকি পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে যাবে!
নিছক ‘ভয়’ এর উপর নির্ভর করে আজ যে আত্মাহীন, জড়বাদী সভ্যতাটি দাঁড়িয়ে আছে, যে সভ্যতার প্রাণভ্রমরা লুকিয়ে আছে পরমাণু বোমার সুইচের ভেতরে, সেটাকে কি সভ্যতা বলা যায়? এই বিবেকবর্জিত যন্ত্রসর্বস্বতার নাম যদি সভ্যতা হয় তাহলে অসভ্যতা কাকে বলে?