আমার দাদা ছিলেন একজন সৎ এবং নিষ্ঠাবান চরিত্রের অধিকারী মানুষ। তিনি কাজীর পেশায় নিয়োজিত ছিলেন এবং আমাদের গ্রামের মসজিদেও ইমামতি করতেন। আমার দাদার ভাইও দীনি শিক্ষায় শিক্ষিত আলেম ছিলেন। যার কারণে আমাদের পরিবারের সদস্যরা ছোট বেলা থেকেই ছিল ধর্মভীরু। আমাদের বাড়িটি দাদার পদানুসারে পরিচিত মুন্সী বাড়ি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আমার বাবাও একসময় গ্রামের মসজিদে ইমামতি করতেন এবং কাজী পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। আমার চাচা বর্তমানে গ্রামের মসজিদের ইমাম এবং আমার বড় ভাই প্রচলিত আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কামেল পাশ। অনেকের বাবা-মা চান তার ছেলে বড় হয়ে ভালো কোন চাকরি করবে বা ব্যবসা করবে আর শেষ বয়সে ছেলে তার দেখাশুনার ভার নেবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি সব সময়ই দেখেছি আমার বাবা আমাদেরকে বলতেন তোমরা ভালোভাবে লেখা পড়া করো, তোমাদের আয়-রোজগারের উপর আমার নির্ভরশীলতা চাই না, তোমরা ভালভাবে মানুষ হও এটাই আমার চাওয়া।
আমরা ভাই বোন একসাথে পড়াশুনা করতাম যার কারণে খরচ দিতে হতো, অনেক কষ্ট হলেও বাবা আমাদেরকে খরচ দিতেন, কোন দিন বলতেন না খরচের জন্য পড়াশুনা করতে হবে না। আমরা নিজেরা যদি কারো কোন কাজ করতাম তাহলে আমার বাবা সব কাজকর্ম ফেলে দিয়ে রাগ করে বলতেন, “আমি আর কোন কাজ করব কেন? তোরা কি বদলা খাটবি মানুষের?” আমাদের ভাইবোনদের মোটামুটি সবাই পড়ালেখায় ভালো ছিলাম, এদিক দিয়েও গ্রামে একটা সুনাম ছিল। গ্রামের মানুষ আমার বাবার নাম ধরে বলতেন, অমুক ছেলেদেরকে খেয়ে না খেয়ে পড়াশুনা করাচ্ছে, তারা বড় হয়ে এক সময় ভালো মানুষ হবে, তাদের আজকের মতো কষ্ট থাকবে না। আমার মেজো ভাই আতাহার হোসাইন তখন পার্শ্ববর্তী গ্রামের “স্যার কে.জি. গুপ্ত উচ্চ বিদ্যালয়ে”র মাধ্যমিক শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। আর সেখান থেকেই তিনি প্রকৃত ইসলামের তথা হেযবুত তওহীদের আহ্বান পান, এবং তাতে যোগদান করেন। আমাদের বাড়িতে এসে যখন ভাই পরিবারের সদস্যদেরকে তার আন্দোলনে যোগদান করার ব্যাপারে জানান তাতে করে পরিবারে একটা বড় রকমের সমস্যা দেখা দিল। কারণ আমার মেজো ভাই ছিলেন পরিবারের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র। বাবার ইচ্ছে ছিল ভাইকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন তিনি যখন আন্দোলনে যোগদান করলেন তখন স্বাভাবিকভাবেই পড়াশুনায় ব্যাঘাত ঘটবে, এই ভেবে বাবা হেযবুত তওহীদ আন্দোলনের বেশ বিরোধিতা শুরু করলেন। আমার বড় ভাই তখন ডিগ্রিতে অধ্যায়নরত এবং আবার মাদ্রাসাতে ফাজিল পাস, তাই তিনি বাবার সাথে একমত পোষণ করে বিরোধিতা শুরু করলেন। শুধুমাত্র আমার মা এবং আমরা দুই ভাই মেজো ভাইয়ের মাধ্যমে আন্দোলনে যোগদান করি। এক পর্যায়ে আমাদের তিনজনের ভরণপোষণ বাবা বন্ধ করে দিলেন।
এভাবে কিছু দিন অতিবাহিত হবার পর আমার মা পরলোকগমন করেন। বাবার মনে সবসময়ই একটি প্রশ্ন ছিল, আমার স্ত্রী কোনদিন আমার কথার অবাধ্য হয় নি, হেযবুত তওহীদের কারণে আমার থেকে আলাদা করে দিলাম কিন্তু তারপরেও কেন সে তা পরিত্যাগ করল না? মা প্রত্যক্ষ জগৎ থেকে আড়াল হবার পর বাবা ঐ ‘কেন’-র উত্তর খুঁজতে আরম্ভ করলেন। মা বেঁচে থাকতে বাবা যেহেতু আন্দোলনের অনেক বিরোধিতা করতেন তাই তিনি গোপনে গোপনে হেযবুত তওহীদের কিছু বই পড়তে শুরু করলেন। তার এই গোপনীয়তার কারণ, এতদিন তিনি আমাদের বিরোধিতা করেছেন, এখন যদি আমরা দেখে ফেলি সেটা তার জন্য অসম্মানজনক হবে। ‘প্রকৃত ইসলামের রূপরেখা’ এই বইটি পড়ে তার অনেক ভালো লাগে এবং কথাগুলো যাচাই করার জন্য তিনি একটা কোর’আনের বাংলা অনুবাদ কিনেন। তিনি বইতে উল্লেখ করা আয়াতগুলো কোর’আনে সাথে মিলিয়ে দেখেন। যখন বুঝতে পারেন হেযবুত তওহীদই প্রকৃত সত্য ইসলাম, বাকি দুনিয়াতে ইসলাম নামে যা চলছে সব মিথ্যা তখন তিনি অনেক অনুশোচনা করেন এবং হেযবুত তওহীদে যোগদান করেন।
এর পর থেকেই গ্রামের মানুষ বিভিন্নভাবে তার বিরোধিতা আরম্ভ করল। নানান ধরণের অপপ্রচার আরম্ভ করল বাবাসহ আমরা সবাই খ্রিস্টান হয়ে গেছি, কাদিয়ানী, জঙ্গী ইত্যাদি হয়ে গেছি, আমরা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের থেকে অনেক টাকা পাই ইত্যাদি। তার পরেও বাবা গ্রামে বুক ফুলিয়েই হাঁটেন তাদের কথার কোন তোয়াক্কা না করেই। কারণ সত্য সত্যই, মিথ্যা মিথ্যাই, লোকে যা-ই বলুক না কেন? এই সত্য নিয়ে যখন রসুল (দ.) মানবজাতির সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন তার বেলাতেও প্রচ- বিরোধিতা এসেছিল মোশরেকদের পক্ষ থেকে এটাই সত্যের ধর্ম। এই অপপ্রচারের সর্বপ্রধান খলনায়ক ছিলেন আমারই চাচা তথাকথিত মসজিদের ইমাম। এ তথাকথিত আলেম সমাজই বেশি কোরে হেযবুত তওহীদের বিরোধিতা করে এবং এর মূল কারণ হচ্ছে, আমরা তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দিচ্ছি মানুষের কাছে। দীন বিক্রি করে তাদের রুজি রোজগারের পথ বন্ধ করে দিচ্ছি। আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে সুরা বাকারার ১৭৪ নম্বর আয়াতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছেন আল্লাহর আয়াতের বিনিময় নেওয়া হারাম। আর সাধারণ মানুষ যদি সত্যি কথাগুলো জেনে ফেলে? তাহলে তো তাদের একমাত্র চলার পথ দীন বিক্রি করে খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে, তাই তারা আমাদের নামে অপপ্রচার শুরু করে যাতে মানুষ আমাদের কাছে না আসে। মোশরেকদের সমস্ত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে আজও আমার বাবা হেযবুত তওহীদের ছায়াতলে প্রতিষ্ঠিত আছেন এবং আল্লাহর রসুলের রেখে যাওয়া দায়িত্ব দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অটল রয়েছেন। আমাদের এখন একটিই দোয়া। আমরা জান ও মাল কোরবান করে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করে যাব জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত ইনশা’আল্লাহ।