রিয়াদুল হাসান
তরঙ্গের অস্তিত্ব, শক্তি, ক্ষমতা সবই সমুদ্রের সঙ্গে জড়িত, সমুদ্রের বাইরে তরঙ্গ কিছুই না। তেমনি মানুষও সৃষ্টিগতভাবে সমাজের সঙ্গে সংযুক্ত। সমাজের বাইরে তার অস্তিত্বের কোনো মূল্য নেই। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ সমাজ থেকে সুবিধা গ্রহণ করে। সে সমাজের শিক্ষালয়ে শিক্ষিত হয়, সমাজের রাস্তায় যাতায়াত করে, সমাজের মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু এসবের বিনিময়ে সে সমাজের কল্যাণ সাধনে এক মুহূর্ত সময় দিতেও প্রস্তুত নয়। সমাজের মঙ্গল সাধনের জন্য তার যে কিছু করণীয় আছে এমন চিন্তা ঘুনাক্ষরেও তার মাথায় আসে না। সে ব্যস্ত থাকে তার বৈষয়িক লাভক্ষতির হিসাব নিকাশে।
তার প্রতিটি কাজের পেছনে স্বার্থই একমাত্র চালিকাশক্তি। যারা সমাজ সেবার কথা বলেন তারাও স্বার্থচিন্তা থেকেই বলেন। সেটা রাজনীতি বা সেবার নামে প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। পাশ্চাত্য সভ্য জগৎ গোটা মানবজাতিকে তাদের তৈরি জীবনব্যবস্থার আওতায় এনে সবাইকে এমন স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক বানিয়ে দিয়েছে। সর্বপ্রকার সেবাকেও ব্যবসায় পরিণত করেছে।
সমাজের ক্ষুদ্রতম একক মানুষ। তাদের মধ্যে যদি কোনো বন্ধন না থাকে তাহলে কেবল স্বার্থের উপর ভিত্তি করে একটি সমাজ বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। বর্তমানে খুব কম মানুষই আছেন যারা তার পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকেন তার নাম বলতে পারবেন। অথচ তিনি তার প্রতিবেশি। একটি দেওয়ালের ক্ষুদ্রতম একক হচ্ছে ইট। ইটগুলোকে সংসক্তিহীনভাবে একটার উপর একটা করে সাজিয়ে রাখলেই দেওয়াল তৈরি হয় না। সিমেন্ট-বালু ইত্যাদির দ্বারা ইটগুলোকে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হয়। অন্যথায় হালকা ঝাঁকুনিতেই ইটের দেওয়াল ভেঙ্গে স্তূপে পরিণত হয়। তাসের ঘরের মতোই তা ক্ষণস্থায়ী হয়ে থাকে।
আমাদের সমাজ এখন তাসের ঘর। স্বার্থের প্রয়োজনে সবাই একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। স্বার্থ না থাকলে কেউ কারও দিকে ফিরেও তাকায় না। অন্যের বিপদে এগিয়ে যাওয়ার চেয়ে এড়িয়ে যাওয়ার সচেতন প্রচেষ্টাই প্রত্যক্ষ হয়। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর শিক্ষা সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে, তাই দুরন্ত মোষ যখন হামলে পড়ে তখন কারওই জীবন নিরাপদ থাকে না।
মানুষ সমাজের জন্য কিছু করে তো না-ই, উল্টো সমাজের ক্ষতি সাধন করে নিজে লাভবান হতে চায়। আত্মঘাতী আঘাতটা এখানেই। সে দেশের স¤পদ লুট করে বড়লোক হতে চায়, দেশের মানুষের গাড়িতে আগুন দিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়, নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দের জন্য দেশকে বিক্রি করে দেয়। সে টাকার জন্য খাদ্যে বিষ মেশায়, ওষুধে ভেজাল দেয়। টাকার জন্য চিকিৎসক রোগীকে প্রতারণা করে, পুলিশ চাঁদাবাজি করে, ঘুষ খায়। কেউ দুর্ঘটনার শিকার হলে মানুষ আজ তাকে বাঁচানোর পরিবর্তে পকেট থেকে মানিব্যাগ আর মোবাইল চুরি করে।
যে যত শিক্ষিত সে তত পাষ-, হৃদয়হীন, ধূর্ত, কপট, স্বার্থপর। যে যত এই সভ্যতাকে আলিঙ্গন করেছে সে ততই কেতাদূরস্ত অমানুষে পরিণত হয়েছে। এই হচ্ছে পাশ্চাত্যের অপরিণামদর্শী অনুকরণের পরিণাম। অপরদিকে ধর্মগুলোও ব্যক্তিগত পরকালের স্বার্থনির্ভর। কিন্তু এখনো সময় ফুরিয়ে যায় নি। বঙ্কিমবাবু লিখেছিলেন, “যত দিন মানুষের আশা থাকে, তত দিন কিছুই ফুরায় না, আশা ফুরাইলে সব ফুরাইলো।” তাই আমরা চাইলে এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারি। প্রয়োজন একটি সিদ্ধান্তের। আমরা বাঁচবো মানুষের জন্য, মরব মানুষের জন্য। সর্বাবস্থায় আমরা সত্যের পক্ষে দাঁড়াবো, মিথ্যাকে রুখে দিব। জীবন গেলেও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করব না। এটাই হোক আমাদের ধর্ম, আমাদের এবাদত, আমাদের জাতীয়তাবোধ, আমাদের দেশপ্রেম। এটাই হোক আমাদের মানবতার দর্শন। কারণ এই সিদ্ধান্তই আমাদের সমাজকে বাঁচাবে, আর সমাজ বাঁচলেই আমরা বাঁচব।
লেখক: সাহিত্য সম্পাদক, হেযবুত তওহীদ।