মো. মোস্তাফিজুর রহমান শিহাব:
সমগ্র মানবজাতি বর্তমানে প্রায় দুইশতের মতো ভৌগোলিক রাষ্ট্রে বিভক্ত। বহু সংগ্রাম ও রক্তের বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট দেশের জনগণ তাদের স্বাধীন ভূখণ্ড অর্জন করেছে। তারা ভাবছে এটাই প্রকৃত স্বাধীনতা। কিন্তু আসলেই কি তারা স্বাধীন?
মানুষ স্বভাবতই আনুগত্যপ্রবণ। সে কারও না কারও প্রতি অনুগত থাকতে চায় কারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের গুরুদায়িত্বটি সে অন্যের উপর অর্পণ করে ভারমুক্ত থাকতে চায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে তার আনুগত্য অর্পণ করে থাকে শক্তিমানের প্রতি। এভাবেই নতুন নতুন শক্তির অধীনে সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন সভ্যতা। এ সভ্যতার বিকাশ ও বিবর্ধনের ফলে নতুন নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে নতুন ভাব ও আদর্শের। আমরা যদি শুধু আমাদের এ ভারতবর্ষের দিকে তাকাই তাহলেই সহজে বিষয়টি বুঝতে পারবো। প্রচলিত ইতিহাস মোতাবেক ভারতবর্ষে এক সময় আর্যদের শাসন ছিল। পরবর্তীতে মৌর্য, গুপ্ত, পাল ইত্যাদি রাজবংশের শাসন দেখা যায়। এরই ধারাবাহিকতায় এক সময় রাজপুত, আফগান, মোঘলরা ভারতবর্ষকে শাসন করে। এ সময়ে তারা ভারতবর্ষকে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো শাসন করে। এরপর ইউরোপ থেকে একদল শকুন উড়ে আসে। তারা ভারতে ব্যবসার নাম করে অনুপ্রবেশ করে ও পরবর্তীতে তাদের মধ্য থেকে ব্রিটিশরা ভারতকে নিজেদের উপনিবেশে পরিণত করতে সক্ষম হয় ও একে দুইশ বছর শোষণ করে। তাদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে অনেক আন্দোলন হয়, দু দুটো বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয় পৃথিবীতে, একটা পর্যায়ে ভারত ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। তারা বিদায় হওয়ার সময় ভারতবর্ষকে তিনটি ভাগে ভাগ করে রেখে যায়, যারা নিজেদের স্বাধীন সরকার গঠন করে। একইভাবে আরও যে সকল জায়গায় ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর উপনিবেশ ছিল তারাও একে একে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এভাবে বর্তমানে বিশ্বে অনেকগুলো নতুন রাষ্ট্র তৈরি হয় যারা নিজেদের স্বাধীন বলে পরিচয় দিয়ে থাকে।
তারা নিজেদের ভৌগোলিক সীমানায় স্বাধীন ভাবলেও প্রকৃত অর্থে তারা কেউই স্বাধীন নয়। এই রাষ্ট্রগুলো তাদের পূর্বতন প্রভু রাষ্ট্রগুলো থেকে রাজনৈতিকভাবে আলাদা হলেও তাদের আইন-কানুন, দণ্ডবিধি দিয়েই এখনও নিজেদের দেশ পরিচালনা করে চলেছে। তাদের অনুদান ছাড়া এই দেশগুলোর অধিকাংশেরই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হয় না, বাজেট হয় না। পাশ্চাত্যের সংস্কৃতিকেই প্রাণপণে ধারণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে এই দেশগুলো। নিজেদের স্বাধীন ভাবলেও তারা হুকুম মানছে অন্য মানুষের। মানুষকেই তারা প্রভু বলে মেনে চলছে, সুতরাং এটা কখনওই তাদের প্রকৃত স্বাধীনতা নয়। বরং মানুষ যখন স্বাধীনভাবে তার স্রষ্টার হুকুম মানতে সক্ষম হবে তখনই কেবল সে এই পরাধীনতা থেকে মুক্তি পাবে। কেননা স্রষ্টা তার পর নয়, তাই স্রষ্টার অধীনতা মানে পরাধীনতা নয়। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে স্রষ্টার রূহ বিরাজ করে।
তেমনি আল্লাহ সমগ্র মানবজাতিকে এক পিতা-মাতা থেকে সৃষ্টি করেছেন। সে হিসেবে সকল মানুষ একে অপরের ভাইবোন। তারা তখনই পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করবে যখন মানবজাতি আল্লাহকে নিজেদের হুকুমদাতা হিসেবে মেনে নিয়ে তার দেয়া আইন-কানুন দিয়ে নিজেদের জীবনকে পরিচালনা করবে। মানুষ তো কারও না কারও আনুগত্য করবেই, প্রশ্ন হলো সে ন্যায়ের আনুগত্য করবে নাকি অন্যায়ের আনুগত্য করবে। যদি সে তার সার্বিক জীবনে শান্তি পেতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই ন্যায় ও সত্যের অনুগামী হতে হবে, কেবল শক্তির অনুগামী হলে চলবে না। স্রষ্টা স্বয়ং হচ্ছেন ন্যায়ের প্রতীক, তিনি সকল সত্যের উৎস। তিনি কোনো অন্যায় আদেশ করতে পারেন না, কেননা তিনিই একমাত্র স্বার্থের উর্ধ্বে। তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন যে কিছু হারানো বা প্রাপ্তির আশায় তাঁকে অন্যায় সিদ্ধান্ত দিতে হবে, অন্যায়ের সঙ্গে আপস করতে হবে। মানুষের পক্ষে কখনওই নিরপেক্ষভাবে, স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সত্য ও মিথ্যা, ন্যায় ও অন্যায়কে ভিত্তি করে বিধান দেওয়া সম্ভব হয় না, তারা নিজেদের স্বার্থের অনুকূলেই সিদ্ধান্ত ও কর্ম করে থাকে। সুতরাং মানুষকে প্রভু মেনে নিলে সে অন্যায়ের প্রতি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
যে কোনো বিধান ভবিষ্যতের জন্যই রচনা করা হয়, আর মানুষ তার ভবিষ্যৎ কিছুই জানে না। কিন্তু স্রষ্টা যেমন মানুষের পূর্ণ অতীত জানেন, তেমনি জানেন তার ভবিষ্যৎ। তাই তাঁর পক্ষেই সম্ভব হয় একটি ত্রুটিহীন ও শাশ্বত জীবনবিধান রচনা করা। তাই তাঁর হুকুম যদি মানবজাতি মেনে নেয় তাহলেই তারা প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন হতে পারবে এবং পৃথিবীর বুকে স্বর্গের শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।