মসীহ উর রহমান:
আমি যদিও রাজনীতি করি না কিন্তু বাংলাদেশের জনগণকে নিয়েই তো কাজ করি, তাই এদেশের মানুষের মনস্তত্ত্ব আমাকে মাঝে মধ্যে ভাবিয়ে তোলে। গতকালকে সরকারের প্রতি বিএনপি চেয়ার পারসন খালেদা জিয়ার আহ্বান ছিল এমন যে, “নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে দেখুন মানুষ কী চায় (প্রথমআলো)।”
তিনি খুবই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছেন যে, মানুষ আসলে বিএনপি-কেই চায়। অভিযোগ রয়েছে পরিবহন বন্ধ করে দিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সমাবেশস্থলে হাজার হাজার মানুষকে আসতে দেওয়া হয় নি, তথাপি জনসভা যেন জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। বোঝা গেল, যদি সবকিছু স্বাভাবিক থাকতো তাহলে গোটা রাজধানী লোকে লোকারণ্য হয়ে যেত।
একই রকম দৃশ্য দেখেছিলাম বারো বছর আগে। যখন বিএনপির শাসনামলে সন্ত্রাস, লুটপাট, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের নৌকার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। শেখ হাসিনার জনসভা মানেই জনসমুদ্র, তখন তিনিও আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলতেন যে, জনগণ কী চায়, মানে আওয়ামী লীগকেই চায়। সত্যিই তাই হলো, নির্বাচনে তিনি ভীষণভাবে বিজয়ী হলেন। যে লোকটা কোনোদিন ইউপি চেয়ারম্যান হবে কিনা সন্দেহ সেও নৌকা প্রতীক নিয়ে এমপি হয়ে গেল। সংসদে নৌকা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেল, আর অন্যদিকে বলা চলে বিএনপির ভরাডুবি হলো।
সে সময়ে বিএনপির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর সবই এখন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আনা হচ্ছে। তাহলে জনগণ আসলে কী চায় আমি বুঝলাম না। তারা কি মৌলিক কোনো পরিবর্তন চায়? নাকি তারা উপায়ন্তর না পেয়ে কড়াই থেকে চুল্লিতে, আবার চুল্লি থেকে কড়াইতে আসা-যাওয়া করছে? নাকি আসলে জনগণ কোনো ফ্যাক্টরই না, যারা রাজনীতির ব্যবসা করছেন তারাই জনগণের নাকে রশি বেঁধে এভাবে গরুর মতো ঘোরাচ্ছেন? ভাবে মনে হয়, জনগণের সামনে অপশন মাত্র দুইটা- হয় গলায় দড়ি দিয়ে মরবে নয় বিষ খেয়ে মরবে।
যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মনস্তত্ত্ব নিয়ে গেল নির্বাচনের সময় ব্যাপক গবেষণা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে মার্কিন জনগণ এমন একজন মাস্তান প্রেসিডেন্ট চাচ্ছিল যিনি অন্যান্য সকল পরাশক্তির দাপটকে দমন করে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠত্বকে অক্ষুন্ন রাখবেন। এ কারণে অনেকেই হিলারিকে সমর্থন করে নি। ভাবা হয়েছিল নারীরা হিলারিকে সমর্থন দেবেন, কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল অধিকাংশ নারী ট্রা¤পকে সমর্থন দিয়েছে।
একইভাবে ব্রিটেন ফ্রান্স জার্মানী ভারতের জনগণের মনস্তত্ত্ব নিয়েও বেশ আলোচনা আমরা দেখতে পেয়েছি। ভারতের জনগণের মধ্যে অধিকাংশই ধর্মীয় চেতনায় জাগ্রত রাস্ট্র চায় এবং উপমহাদেশে নয় কেবল, বিশ্বের বুকেও ভারতের ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চায়। এ কারণেই তারা শত বছরের ধর্মনিরপেক্ষ কংগ্রেসকে জরাজীর্ণ, দুর্নীতিগ্রস্ত হিসাবে চিহ্নিত করে বহু অঘটনঘটনপটিয়সী হিন্দুত্ববাদী মোদিকে বিপুল সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় আনেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে জার্মান জাতির উচ্চাভিলাস ও মনস্তত্ত্ব এমনভাবে কাজ করেছিল যে তারা হিটলারের নেতৃত্বের অধীনে সারা দুনিয়াকে ধরাশায়ী করবে। হিটলার ভালো কি মন্দ সেই বিবেচনার বোধও তারা হারিয়ে ফেলেছিল। যুদ্ধের একটা পর্যায়ে কে জার্মানির শত্রু আর কে মিত্র সেই হিতাহিত জ্ঞানটাও তাদের হারিয়ে গিয়েছিল। যার ফলে জার্মান সেনারা মিত্র দেশ রাশিয়ার লেলিনগ্রাদ আক্রমণ করে বসেছিল, এবং বৈরী আবহাওয়ায় ধরাশায়ী হয়েছিল। পরবর্তী ইতিহাস সবারই জানা- লজ্জাজনক পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সমগ্র জাতি ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছিল। কাজেই জাতির মনস্তত্ত্ব পর্যবেক্ষণ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
কিন্তু এখন বাংলাদেশের জনগণের মনস্তত্ত্ব আমাকে ভাবিয়ে তুলছে। এদেশে যেভাবে মৌসুমী বায়ু উত্তর দিকে যায়, আবার উত্তরের হিমশীতল বায়ু দক্ষিণ দিয়ে যায়- এই বায়ু প্রবাহ বাংলার মানুষের মনস্তত্ত্বের উপরও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে কিনা আমার সন্দেহ আছে। যেভাবে তারা কিছুদিন যেতে না যেতেই অতীতকে বেমালুম ভুলে যায় সেটা তাদেরকে স্মৃতিভ্রংশ বা অ্যামনেশিয়া রোগী বলেও ভ্রম সৃষ্টি হয়।
ইতিবাচক পরিবর্তন চাওয়া অবশ্যই উত্তম, গতিশীলতাই প্রাণ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কীসের পরিবর্তন ঘটিয়ে কী আনব, সেটা কেন আনব তার চূড়ান্ত লক্ষ্য ও পরিণতি কী হবে সেটা বিবেচনা করাই কি মানসিক সুস্থতার পরিচয় নয় কি? আমি যখন দেখব যে, যিনিই লঙ্কায় যাচ্ছেন তিনিই রাবন বনে যাচ্ছেন তখন আমাকে ভাবতে ব্যবস্থার পরিবর্তন নিয়ে। কিন্তু আমাদের জনগণ সেই ব্যবস্থা পরিবর্তন না করে সরকার পরিবর্তনকেই রাজনীতির লক্ষ্য বানিয়ে নিয়েছে যা কস্মিনকালেও তাদেরকে কাঙ্ক্ষিত অর্জন এনে দিতে পারবে না।