মোহাম্মদ আসাদ আলী:
নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইডেন ইত্যাদি দেশের উদাহরণ টেনে ধর্মবিদ্বেষীরা বলেন, ওগুলো নাস্তিকদের দেশ, ওইসব দেশের মানুষরা ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামায় না, যারাও বা আস্তিক আছেন তারাও ধর্মকে নিছক ব্যক্তিগত, পারিবারিক কালচারের বাইরে কিছু ভাবেন না। অথচ দেশগুলোতে অপরাধ নেই, সন্ত্রাস নেই, দুর্নীতি নেই। দারিদ্র্য নেই, অশিক্ষা নেই। ধর্ম ছাড়াই দিব্যি দেশগুলো চলছে, তাহলে ধর্মের কী দরকার?
তাদের প্রতি আমার দাবি হচ্ছে, নেদারল্যান্ডস বা নরওয়ে বা সুইডেনের এতই যখন সমৃদ্ধি এসেছে তখন তাদের উচিত নয় সীমান্ত দিয়ে সেই সমৃদ্ধিকে কয়েকটি ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা। তাদেরকে বরং বলুন বর্ডার খুলে দিতে। তারা ঘোষণা দিয়ে দিক- আমাদের দেশ সবার জন্য। সব ধর্ম, বর্ণ, দেশ, জাতির মানুষের জন্য। যে কেউ আমাদের দেশে আসতে পারে, যতদিন ইচ্ছা বসবাস করতে পারে, ব্যবসা-বাণিজ্য করে যত ইচ্ছা টাকা কামাতে পারে। কোনো ভিসা লাগবে না, পাসপোর্ট লাগবে না। তারপর দেখা যাক তাদের শান্তি, সমৃদ্ধি কতদিন স্থায়ী হয়! জেনে রাখা দরকার- ইসলাম কিন্তু এই ঘোষণা অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবেই দেয় কারণ ধারণাগতভাবে ইসলাম এসেছে সমস্ত মানবজাতির জন্য, কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে সীমানাপ্রাচীরের শাসনে বন্দী হয়ে থাকার জন্য নয়।
দ্বিতীয়ত- নেদারল্যান্ডস, সুইডেন বা নরওয়ের প্রতি আরও দাবি হচ্ছে, তারা যে অভিনব আদর্শ দিয়ে এমন সমৃদ্ধ (?) দেশ গড়ে তুলেছে, অন্যায়, অপরাধ নির্মূল করে ফেলেছে সেটাকে বাকি পৃথিবীতেও প্রতিষ্ঠা করুক। কেবল নিজেরা সুখে থাকবে, অন্যদের কথা ভাববে না তা কী করে হয়? সারা পৃথিবী চুলোয় যাক, আমরা ভালো থাকলেই হলো- এরকম মানসিকতা থাকলে সে তো মানুষই না। তার উন্নতিই কি, সমৃদ্ধিই কি! নেদারল্যান্ডস কি পারবে বাকি পৃথিবীকেও তাদের মত শান্তি-সমৃদ্ধি দিয়ে ভরিয়ে তুলতে? নরওয়ে কি পারবে তাদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাকে ছোট্ট ঐ ভূখণ্ডের পরিসরে আবদ্ধ না রেখে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে? সেই আশা কেউ করেন কি? অথচ ইসলামকে সেটাই করতে হয়েছে।
বিশ্বনবী পারতেন কেবল মদীনাকে শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা দিয়ে ভরিয়ে রাখতে। তারপর চারদিকে শক্ত পাহারা বসিয়ে দিয়ে আরাম-আয়েশে দিন কাটাতে! বাকি আরবে চলত আইয়ামে জাহেলিয়াত, সারা পৃথিবীতে চলত রোমান-পারস্যের অপশাসন। তাতে কী? রসুল তো ভালো থাকলেন, তাঁর সাহাবীরা তো সুখে থাকলেন! কিন্তু ইতিহাস বলছে আল্লাহর রসুল তা করলেন না। তিনি যে মহান আদর্শ নিয়ে এসেছেন সেই আদর্শ সমস্ত পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, সমস্ত পৃথিবীতে ন্যায়, সাম্য, নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে- এই লক্ষ্য নিয়ে তিনি সামনে এগিয়ে গেলেন। তারই ফলে মাত্র ৬০-৭০ বছরের মধ্যে অর্ধেক পৃথিবীতে ন্যায়, সাম্য ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হলো। উল্লেখিত দেশগুলোও সেটা করে দেখাক। তাহলে বোঝা যাবে আসলেই ধর্ম ছাড়াও এমন আদর্শ সম্ভব যা পুরো মানবজাতিকে সর্বাঙ্গীন সমৃদ্ধি এনে দিতে সক্ষম।
আচ্ছা, নেদারল্যান্ডস এর মত দেশগুলোর সমৃদ্ধি যে ‘ধর্মহীনতার’ কারণে হয়েছে তারই বা নিশ্চয়তা কী? বাংলাদেশ তো পৃথিবীর গরীব দেশগুলোর অন্যতম। সেই দেশটারই একটি এলাকা হচ্ছে গুলশান-বনানী। সেখানে গিয়ে দেখুন অন্য রকম চিত্র। যেমন নিরাপত্তার কড়াকড়ি, তেমনি চোখ ধাঁধানো ইমারত। বিলাসবহুল হোটেল রেস্টুরেন্ট। ঝা তকতকে রাস্তায় দামী দামী গাড়ি সাই সাই করে চলছে। মনে হবে কতই না সমৃদ্ধ এলাকা। কিন্তু আমরা সবাই জানি এই সমৃদ্ধি আমার আপনার মত সাধারণ মানুষের চোখের তৃপ্তি যোগাতে পারে মাত্র, তার বেশি কিছু নয়। এই সমৃদ্ধি ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ছোট্ট একটি শ্রেণির শ্রেণিগত সমৃদ্ধি! কোটি কোটি খেটে খাওয়া মানুষের ঘামের বিনিময়ে মুষ্ঠিমেয় একটি শ্রেণির সমৃদ্ধির ইমারত গড়ে উঠেছে, যা কস্মিনকালেও সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়, সারা পৃথিবীতে তো আরও নয়।
আপনি কেবল ঝলমলে অট্টালিকা, ফ্লাইওভার, রাজপথ দেখবেন, কিন্তু এসবের যোগানদাতা বস্তিবাসীদের দেখবেন না তা কী করে হয়? ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের শিকার দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলোর ক্ষুধা-দারিদ্র্য, অশিক্ষা-কুশিক্ষা আর নিরাপত্তাহীনতার বিনিময়ে গড়ে উঠেছে কয়েকটি নেদারল্যান্ডস। সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত নেবার মত করে কয়েক শতাব্দী ধরে নেদারল্যান্ডস এর মত ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো আফ্রিকা, এশিয়ার দেশগুলো থেকে অর্থ-সম্পদ শোষণ করেছে। আজকে আমরা এই দেশগুলোকে তৃতীয় বিশ্বের দেশ, অনুন্নত দেশ, দারিদ্র্যপীড়িত দেশ বলছি, কিন্তু কয়েক শতাব্দী আগেও এই দেশগুলোর সমৃদ্ধি দেখে পশ্চিমাদের চোখ ছানাবড়া হত। নিছক সামরিক শক্তিবলে জোর করে দখল করে সমৃদ্ধ এই ভূখণ্ডগুলোকে কয়েক শতাব্দী ধরে শোষণ করে দেউলিয়া বানিয়ে ছেড়েছে পশ্চিমারা। এই অবস্থায় নামানো হয়েছে যে, আগামী কয়েক শতাব্দীতেও এদের পক্ষে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। আর এদের শোষণ করে তারা এতই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে যে, আগামী কয়েক শতাব্দীতেও তাদের হেসেখেলে চলে যাবে! তারাই সুইডেন, নরওয়ের মত কার্যত কিছু পর্যটন স্পট বানিয়ে রেখেছে অবকাশ যাপন তথা ফূর্তি করবার জন্য। কাল যদি পৃথিবীতে ধর্ম বলে কিছু নাও থাকে তাহলেও পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশ নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, নরওয়ে হতে পারবে না, যেমন পারবে না বাংলাদেশের প্রত্যেকটি জনপদ গুলশান-বনানী হতে।
একমাত্র ইসলামই পেরেছে সকল মানুষের মধ্যে শ্রেণিগত, বর্ণগত, ভৌগোলিক, ভাষাগত বৈষম্য দূর করে মানুষ হিসেবে সকলকে সমান মর্যাদা ও অধিকার প্রদান করতে। সবার জীবনে ন্যায়, সাম্য, সুবিচার ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করতে। অর্থের সুসম বণ্টনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা নিশ্চিত করতে। ভবিষ্যতেও একমাত্র ইসলামের পক্ষেই সম্ভব সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটানো।