রিয়াদুল হাসান:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে নব্বইয়ের গোড়া অবধি পৃথিবীতে দুটো বৃহৎ পরাশক্তি একে অপরের বিরুদ্ধে সাংঘাতিকভাবে শীতল যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। একটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, অপরটি হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এদের নেতৃত্বে গোটা পৃথিবীই যথাক্রমে পুঁজিবাদী ব্লক ও সমাজতান্ত্রিক বøক এই দুটো ভাগে বিভক্ত ছিল। আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রক্সিযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায় এবং পৃথিবীর বহু সমাজতান্ত্রিক দেশ গণতন্ত্রকে আলিঙ্গন করে নেয়। এই দীর্ঘ সময়ে সমাজতন্ত্রের কেবল রাজনৈতিক পরাজয়ই ঘটে নি, তাত্ত্বিক বা আদর্শিক পরাজয়ও ঘটেছে। সমাজতন্ত্রের নামে ফ্যাসিবাদ এসে যে শক্তির শাসন দ্বারা শ্বাসরুদ্ধকর নরককুণ্ড পয়দা করেছিল, সেসব দেশ থেকে পালাতে গিয়ে লাখে লাখে মানুষ সাগরে ডুবে গুলি খেয়ে মরেছিল। এই যে ঠাণ্ডা যুদ্ধ, এতে বড় অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে প্রপাগান্ডা বা উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচারকে।
অপপ্রচার বা প্রপাগান্ডা এমন একটি হাতিয়ার যা যুগে যুগে কালে কালে অপশক্তি ও মিথ্যার ধারক বাহকরা সত্যের বিপক্ষে মিথ্যাগুজব ও অপপ্রচারকে ব্যবহার করেছে। এ অপপ্রচারের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে বহু সাধারণ মানুষ পথভ্রষ্ট হয়েছে।বহু মানবতা বিপর্যসৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ড সম্পাদিত হয়েছে, বহু ঘাত সংঘাত সংঘর্ষ হয়েছে। সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ইরাকে পারমাণবিক অস্ত্র আছে এই মিথ্যা কথাটি প্রচার করে তার ভিত্তিতে সেই দেশটি আক্রমণ করে দশ লক্ষাধিক আদম সন্তানকে হত্যা করা হয়েছে। একইভাবে ফেসবুকের একটি পোস্টকে নিয়ে গুজব ও হুজুগ ছড়িয়ে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, মানুষ হত্যা করাও অহরহ চলছে।
এ প্রসঙ্গে হিটলারের প্রচারমন্ত্রী ভন গোয়েবলস বলেছিলেন, একটা মিথ্যাকে যদি একশবার প্রচার করা হয় তাহলে সেটাই সত্য হিসাবে গৃহীত হয়ে যায়। এই নীতি মোতাবেকই কাজ করেছিল সাম্যবাদী ও পুঁজিবাদী ব্লক। নব্বইয়ের দশকে সমাজতন্ত্র প্রভাব হারিয়ে ফাঁকাবুলিতে পরিণত হলো। সেই থেকে একক পরাশক্তি হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পুঁজিবাদী ব্লক বিশ্বকে তটস্থ করে রেখেছে। সমাজতন্ত্রের কোমর ভেঙে যাওয়ার পর আদর্শ হিসাবে কেবল মাত্র ইসলামই রইল পুঁজিবাদের সামনে। কারণ ইসলাম অন্যান্য ধর্মের মত কেবল আচারসর্বস্ব নয়, এতে সামগ্রিক জীবন পরিচালনার জন্য সকল বিধি-বিধান ও দিক নির্দেশনা রয়েছে। প্রায় এক হাজার বছর পৃথিবীর একটি বৃহৎ অংশে এই জীবনবিধানের চর্চা হয়েছে এবং যার দরুন মুসলিমরা বিশ্বের বুকে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠাও লাভ করেছে। সুতরাং ঔপনিবেশিক যুগের দাসত্ব শেষে গোটা মুসলিম বিশ্বেই আবার ইসলামের একটি জাগরণের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। বহু রাজনৈতিক দল, সন্ত্রাসবাদী দল, মধ্যপন্থী দল ইত্যাদি তাদের বহুমুখী কর্মকাণ্ডের দ্বারা ইসলামকে আবার শাসনক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য চেষ্টা, সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। ইসলামের এই জাগরণের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে পশ্চিমা সভ্যতা। এখানেও তাদের সেই একই গোয়েবলসীয় রণকৌশল- প্রোপাগান্ডা চালানো।
ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের সেই ক্রুসেডের যুগ থেকে শুরু হয়েছে অপপ্রচার আর হুজুগ সৃষ্টির পাঁয়তারা। তারপর থেকে লাখ লাখ বই, সাহিত্য তারা রচনা করেছে ইসলামবিদ্বেষ প্রচারের জন্য। মুসলমানদের শত শত বছর ধরে গোলাম বানিয়ে নির্মম নির্যাতন করা হয়েছে। কেউ প্রতিবাদ করলেই তার সঙ্গে সন্ত্রাসী, জঙ্গি ট্যাগ জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে তারাই ইন্ধন দিচ্ছে, অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে বড় করে তুলছে। অতঃপর তারা যখন কোনো সন্ত্রাসী কর্মাকাণ্ড ঘটাচ্ছে তখন গোটা মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো ও মুসলিমদের ভূ-খণ্ডগুলো দখল করে নেওয়ার অসিলা তারা পেয়ে যাচ্ছে। তাদেরকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে মুসলমানদেরই একটি ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী যারা ওয়াজ করে তরুন মুসলিমদেরকে আফগান যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য উজ্জীবিত করেছে এবং সৈন্য সরবরাহ করেছে। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর আবির্ভাব হয়েছিল সে সময়টিতেই।
এখন এই জঙ্গিবাদের বিষয়ে মুসলিম জাতির মধ্যে কোনো সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশ নেই। গোটা জাতি হাজার হাজার ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে। তাদের কী করণীয় কী বর্জনীয়, তাদের জীবনের লক্ষ্য কী, কী করে তারা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের এই ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচতে পারবে, তারা কী করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের পানে অগ্রসর হবে এই প্রশ্নগুলো করা হলে তাদের মধ্যে হাজার হাজার উত্তর পাওয়া যাবে। মুসলমান জাতির কোনো কর্তৃপক্ষ নেই, সিদ্ধান্ত দেওয়ার কেউ নেই, কোনো নেতৃত্ব নেই।
এইরকম হালবিহীন নৌকার মত তারা পরিস্থিতির সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে আর সবার দ্বারা লাঞ্ছিত অপমানিত হয়ে চলেছে। কিন্তু তাদেরকে যদি এখন জীবন বাঁচাতে হয়, দেশ ও ধর্ম বাঁচাতে হয় তাহলে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এক কলেমা তওহীদের ভিত্তিতে। একটা কথাই সবাইকে মেনে নিতে হবে যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো হুকুম মানবো না। সবাই যখন আল্লাহর তওহীদ, সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ জাতি গড়ে তুলবে তখন সেই জাতির একজন নেতা থাকবে, সবাই তার কথা শুনবে এবং মানবে। এই অবস্থাই জাতিকে শক্তিশালী একটি রূপ দান করবে। এর কোনো বিকল্প নেই। হেযবুত তওহীদ এই ঐক্যবদ্ধ জাতিগঠন ও তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করার রূপরেখাটিই তুলে ধরছে।