হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

রোহিঙ্গা সঙ্কট: কার কী ভূমিকা?

সুলতানা রাজিয়া:
রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে আজ পর্যন্ত কাউকে শক্ত অবস্থান নিতে দেখা যায় নি। জাতিসংঘ বিশাল ভূমিকা পালন করতে পারত। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে নিন্দা আর উদ্বেগ প্রকাশ করা ছাড়া এই সংগঠনটি বাস্তবসম্মত কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। মুসলিম জাহানের স্বার্থ রক্ষার্থে গঠিত হয়েছিল ওআইসি, আরব লীগ ইত্যাদি। তারাও নিন্দা জ্ঞাপন করেই দায়িত্বের ইতি টেনেছে। তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি কয়েকটি মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র থেকে ঘনঘন মিয়ানমার সরকারকে চাপ প্রয়োগ করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানানো হচ্ছে বটে, কিন্তু তাতেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। মিয়ানমার সরকার কারো নিন্দা, উদ্বেগ আর আহ্বানের পরোয়া করছে বলে মনে হচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন একদিনের জন্যও তারা বন্ধ রাখে নি। ফলে প্রতিদিনই রোহিঙ্গারা গণহত্যার শিকার হচ্ছে, লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে।
বাংলাদেশ এখন সরাসরি এই সঙ্কটের একটি বিরাট অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যান্য দেশগুলো যেভাবে নিন্দা প্রকাশ করেই অমানবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে দায়িত্বের ইতি টানতে পারছে বাংলাদেশ তা পারছে না। বাংলাদেশ সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কূটনৈতিকভাবে বিষয়টিকে মোকাবেলা করতে। কিন্তু তাতে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এর কারণ আমাদের সরকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যাদের কাছেই ছুটে যাচ্ছে বা যাদের কাছে সহযোগিতার আশা করা হচ্ছে, তাদের সকলেরই কোনো না কোনো স্বার্থ রয়েছে মিয়ানমারের মাটিতে। সেই স্বার্থ রক্ষার্থে তারা মিয়ানমার সরকারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়, তার জন্য বর্বরোচিত গণহত্যাকে সমর্থন দিতেও কসুর করছে না।
ইসরায়েলের সংবাদ মাধ্যম হারেতজ লিখেছে, দেশটির সরকার মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিরি এক গবেষণায় বলা হয়েছে, রাখাইনে হত্যাযজ্ঞ চলছে এবং ইসরায়েল সরকার মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে। ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর সামরিক প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে একটি ছবি প্রকাশ করা হয়েছিল। ছবিটি ছিল ইসরায়েলের নির্মিত কর্নার শর্ট রাইফেলস হাতে প্রশিক্ষণের। ছবির সঙ্গে ছিল এক বিবৃতি, যাতে উল্লেখ করা হয়েছে মিয়ানমার অভিযানে এসব অস্ত্রের ব্যবহার শুরু করেছে। (সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন : ৬-৯-২০১৭)
এতদঞ্চলের অন্যতম পরাশক্তি চীন। রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে এই একটি দেশই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু চীনের অবস্থান বিবেকবান মানুষমাত্রকেই হতাশ করেছে। দেশটি রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের বিরুদ্ধে ‘টু’ শব্দটিও উচ্চারণ করছে না। সরাসরি মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলেই চীন ও রাশিয়া তাতে ভেটো দিচ্ছে। ভারতও মিয়ানমারের পক্ষে নিজের অবস্থান সুস্পষ্ট করেছে। মিয়ানমার গণহত্যা শুরু করলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মিয়ানমার সফরে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। ভারত রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে অন্তত চাপের মধ্যে রাখবে এমনটাই প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু ঘটল তার উল্টোটা। সেখানে গিয়ে নরেন্দ্র মোদী যে বিবৃতি প্রদান করেছেন তাতে বোঝা যায়, তিনি মিয়ানমারের পক্ষেই আছেন এবং তার কারণ আর কিছু নয় ভারতের জাতীয় স্বার্থ।
চীন ও ভারত উভয় দেশই যার যার জাতীয় স্বার্থের কারণে মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে জনবহুল এই দেশ দুইটির মধ্যবর্তী ভৌগোলিক অবস্থানে মিয়ানমার। দুই দেশেরই দরকার প্রাকৃতিক সম্পদ, আর মিয়ানমারে তা যথেষ্টই আছে। নতুন সরকারের অধীনে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ব্যবসায়ে আগ্রহী। জমির চাহিদাও প্রচুর। বিদেশি ফার্মগুলো যাচ্ছে, জমিদখল চলছে আর সর্বস্ব হারাচ্ছেন জমি-মালিকরা। জমি ব্যবসা চলছে রমরমা। রোহিঙ্গাদেরকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া গেলে তাতে সবারই লাভ। ইতোমধ্যেই চীন ও ভারতের অনেক প্রতিষ্ঠান মিয়ানমারে বিনিয়োগ করেছে। তাছাড়া আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় ভারত ও চীন উভয়েরই মিয়ানমারকে দরকার। এদিকে মিয়ানমারের সাথে সামরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে উত্তর কোরিয়া। এসব দরকষাকষিতে মিয়ানমার নিজেদের দাম বাড়িয়ে নিয়েছে এতটাই যে, দেশটির এতবড় বর্বরোচিত গণহত্যাও কেউ দেখেও দেখছে না।
অন্যদিকে পাশ্চাত্য শক্তির প্রয়োজন সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাববলয়ের জন্য চীন-ভারতের মতো শক্তিধর দেশের সংযোগস্থল এবং মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার মতো প্রভাবশালী মুসলিম দেশের সমুদ্রপথে মধ্যপ্রাচ্যের ইসরায়েলের মতো নতুন এক রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করে স্থায়ী আসন গেড়ে বসা। তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এ অঞ্চলকে ঘিরে তাদের মিশনারি চক্র, মিডিয়া চক্র ও কূটনৈতিক চক্র দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। মিয়ানমারের তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক সরকারকে’ আস্থায় রেখে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ আদায় করে নিতে চায়। তাদের স্ট্রাটেজি পরিষ্কার- চীনকে ঘেরাও করা। আর তার জন্য মিয়ানমারের বিকল্প নেই। তাই এককালে মিয়ানমারের উপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা জারি রাখলেও বর্তমানে তেমন কোনো পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র নিবে না, তার পশ্চিমা মিত্রদেরও এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে দেবে না।
অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের জীবনে আজ যে দুর্বিসহ বিপর্যয় নেমে এসেছে তাতে যেন কারোই বিশেষ কোনো ক্ষতি নেই, বরং মিয়ানমার সরকারসহ বহু দেশ তা দ্বারা লাভবান হচ্ছে, পরাশক্তিগুলোও নিজেদের স্বার্থ খুঁজে নিচ্ছে। জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি কেবল রোহিঙ্গাদের, আর নিরাপত্তার সঙ্কট বাংলাদেশের।

যোগাযোগ:
০১৭১১০০৫০২৫, ০১৯৩৩৭৬৭৭২৫
০১৭৮২১৮৮২৩৭, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...