রিয়াদুল হাসান: মুসলমানদের সমাজ কাঠামোয় ধর্মব্যবসা ও ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণির অনুপ্রবেশের পর থেকে এ পর্যন্ত যারা ধর্মীয় কার্যাবলীর দ্বারা স্বার্থসিদ্ধি করেছেন, যারা ইসলামের ভাষ্যকার বলে জনারণ্যে গৃহিত তারা স্বভাবতই আল্লাহ রসুলের এতদসংক্রান্ত কঠোর সাবধানবাণীগুলো মানুষের কাছে প্রচার করেন না। এর কারণ এগুলো যদি ধর্মবিশ্বাসী জনম-লী জানতে পারে তাহলে তাদের ধর্মব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। তাই তারা সর্বদা সচেষ্ট থেকেছেন জনগণ যেন ধর্মের বিষয়ে অজ্ঞ-মূর্খ থাকে, কেননা এ অজ্ঞতা-মূর্খতাই হচ্ছে তাদের ব্যবসায়ের পুঁজি।
এই যে তারা আল্লাহর থেকে আগত বিধানগুলোকে, শিক্ষাগুলোকে নিজেদের কায়েমী স্বার্থ বজায় রাখার নিমিত্তে গোপন করে থাকেন, এই সত্য গোপন করাটা ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ। সত্য গোপন করা আর মিথ্যাচার করা একই কথা। সত্য মানুষকে শান্তির পথ দেখায়, জান্নাতের পথ দেখায়। যারা সেই সত্যকে গোপন করে তারা মানবজসমাজের শান্তির অন্তরায়, তাদের পরকালীন জান্নাতের অন্তরায় অর্থাৎ জাহান্নামের কারণ। সামান্য কিছু টাকার জন্য যারা মানবজাতির এত বড় ক্ষতি সাধন করে তারা কত বড় অপরাধে অপরাধী এবং পরকালে তাদের কী কঠিন দুর্দশা হবে তা পবিত্র কোর’আনের বহু স্থানে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন। এই কথাগুলোকেও তারা গোপন করে থাকে। যাদের মাতৃভাষা আরবি নয় তাদের কাছে কোর’আনের শিক্ষা গোপন রাখা সহজ। এমন কি যারা আরবি বোঝেন বা কোর’আনের অনুবাদ পড়েন তাদেরকেও ঐ আয়াতগুলোর ভুল ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে সেগুলোর প্রকৃত শিক্ষাকে আড়াল করেন ধর্মব্যবসায়ী মোফাসসের, মুফতি ও আলেমগণ।
পবিত্র কোর’আনে আল্লাহর বাণীকে, সত্যকে গোপন (পড়হপবধষ) করার ক্ষেত্রে আল্লাহ ব্যবহার করেছেন ‘তাক্তুমু, ইয়াকতুমুনা’ এই শব্দগুচ্ছ। আর ধর্মের কাজ করে মানুষের কাছ থেকে তার বিনিময়ে তুচ্ছ পার্থিব মূল্য, বৈষয়িক স্বার্থ (ংসধষষ ঢ়ৎরপব, ধ মধরহ) হাসিল করার ক্ষেত্রে আল্লাহ ব্যবহার করেছেন ‘সামানান কালিলান’। এই শব্দ দুটো কোর’আনে বার বার এসেছে। এ কাজটি যে কেবল হারামই নয়, এটা যে কুফর, যারা এ কাজ করবে তারা যে আগুন খাচ্ছে, পরকালেও তারা যে জাহান্নামে যাবে, তারা যে পথপ্রদর্শক নয় পথভ্রষ্ট, পবিত্র কোর’আনের সুরা বাকারার ১৭৪-১৭৫ নম্বর আয়াতে এই সবগুলো কথা আল্লাহ দ্ব্যার্থহীন ও সরল ভাষায় উল্লেখ করেছেন যা বোঝার জন্য কোনো তাফসিরের প্রয়োজন হয় না। এ আয়াতে আল্লাহ বলেন, বস্তুত, যারা আল্লাহ কেতাবে যা অবতীর্ণ করেছেন তা গোপন করে এবং এর বিনিময়ে পার্থিব তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করে, তারা তাদের পেটে আগুন ছাড়া আর কিছুই ঢুকায় না। এবং আল্লাহ হাশরের দিন তাদের সঙ্গে কথাও বলবেন না, তাদেরকে পরিশুদ্ধও করবেন না। এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আজাব। (সুরা বাকারা ১৭৪)
এরাই হচ্ছে সেই সমস্ত মানুষ যারা সঠিক পথের (হেদায়াহ) পরিবর্তে পথভ্রষ্টতা (দালালাহ) এবং ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তি ক্রয় করে নিয়েছে। আগুন সহ্য করতে তারা কতই না ধৈর্যশীল। (সুরা বাকারা ১৭৫)
এই দীনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নীতি এই আয়াতে ঘোষিত হয়েছে। যারা আল্লাহর অবতীর্ণ কেতাবের বিধিবিধান ও শিক্ষাকে গোপন করে এবং দীনের বিনিময়ে অর্থ বা স্বার্থ হাসিল করে তারা-
১। “আগুন ছাড়া কিছুই খায় না।” অর্থাৎ তারা যা কিছু খায় তা সমস্তই জাহান্নামের আগুন। তাদের এই অপকর্ম, গর্হিত কাজ তাদের ভক্ষিত সকল বস্তুকেও হারামে পরিণত করে, যেভাবে আগুন সব কিছুকেই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়।
২। “হাশরের দিন আল্লাহ তাদের সঙ্গে কথাও বলবেন না”। এ থেকে বোঝা যায় আল্লাহ তাদের উপর কতটা ক্রোধান্বিত। আল্লাহ যার সাথে কথাও বলবেন না তার সেই মহাবিপদের দিন কী দুর্দশা হবে কল্পনা করা যায়?
৩। “তাদেরকে পরিশুদ্ধও করবেন না।” মানুষ মাত্রই পাপী, আল্লাহর ক্ষমার সরোবরে ¯œান করেই মানুষ পাপমুক্ত হয়ে জান্নাতে যেতে পারে। আল্লাহর এই ক্ষমার হকদার হচ্ছে মো’মেনগণ। কিন্তু যারা ধর্মব্যবসায়ী তারা গাফুরুর রহিম, আফওয়ান গফুর, গাফুরুন ওয়াদুদ আল্লাহর ক্ষমা থেকেও বঞ্চিত হবে। আল্লাহ তাদেরকে পরিশুদ্ধও করবেন না।
৪। “তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আজাব”। এ হচ্ছে চূড়ান্ত কথা যা সব অস্পষ্টতাকে নস্যাৎ করে দেয়। ধর্মের কাজ করে স্বার্থহাসিলকারীরা জাহান্নামী এ নিয়ে আর কোনো সন্দেহের বা দ্বিমত পোষণের অবকাশ থাকে না।
৫। “তারা হেদায়াতের বিনিময়ে পথভ্রষ্টতা ক্রয় করেছে”। খুবই দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য। আমরা ঐ বিশেষ শ্রেণিটির কাছে কেন যাই, কেন তাদের ওয়াজ, খোতবা নসিহত শ্রবণ করি? নিশ্চয়ই পরকালীন মুক্তির পথ জানার জন্য? হেদায়াহ শব্দের মানেই হচ্ছে সঠিক পথনির্দেশ। আল্লাহ বলেই দিচ্ছেন, যারা ধর্মের কাজের বিনিময় গ্রহণ করে তারা নিজেরাই পথভ্রষ্ট। একজন পথভ্রষ্ট মানুষ কী করে আরেক ব্যক্তিকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে? এ কি সম্ভব? সুতরাং ধর্মজীবী, পেশাদার আলেমদের কাছে যারা মুক্তিপথের সন্ধান করবে তারাও পথভ্রষ্টই হবে, তারাও জাহান্নামেই যাবে। সঠিক পথের দিশা পাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। একজন মানুষ অকপটচিত্তে কোনো একটি গন্তব্যের পানে রওয়ানা করল। কোনো এক চৌরাস্তায় গিয়ে যদি সে ভুল পথটি বেছে নেয় তাহলে সে কি বাকি জীবন পথ চলেও তার গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে? তার পথ চলাই সার হবে। সে মনে মনে ভাববে একটু পরেই আমি গন্তব্যে পৌঁছে যাব কিন্তু সে কোনোদিনই গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে না। তেমনি ধর্মব্যবসায়ীদের দিক নির্দেশনা অনুসরণ করে কোনোদিনই একজন মহা পরহেজগার মানুষ জান্নাতে যেতে পারবে না। তার সব আমল-আখলাকই দিনশেষে ব্যর্থতায় পর্যবশিত হবে, কেয়ামতের দিন তাকে হতাশা ঘিরে ধরবে।
এ কারণেই পবিত্র কোর’আনের সুরা ইয়াসীনের ২১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, তাদের অনুসরণ করো যারা তোমাদের কাছে কোনোপ্রকার বিনিময় চায় না এবং যারা সঠিক পথে, হেদায়াতে আছে।
এই আয়াতে আল্লাহ বিনিময় গ্রহণকারীর, বিনিময় কামনাকারীর কথা শুনতে ও মানতে, তাদের অনুসরণ করতে সরাসরি নিষেধ করে দিলেন। এই নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও যদি কোনো ব্যক্তি তাদের অনুসরণ করে তাহলে সে আল্লাহরই নাফরমানি করল, অবাধতা করল। বর্তমানে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব এভাবেই ধর্মব্যবসায়ীদের আনুগত্য করে আল্লাহর হুকুমকে লঙ্ঘন করে চলেছে।
আল্লাহর দৃষ্টিতে দীন ব্যবসা কত ঘৃণিত তা উপলব্ধি করার জন্য সুরা বাকারার ১৭৪ নম্বর আয়াতের পূর্বের আয়াতটিও পড়া দরকার। মনে রাখতে হবে, কোর’আনের একেকটি বিচ্ছিন্ন আয়াত উল্লেখ করে অনেক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী মানুষের ঈমানকে বিপথে চালিত করে। তাই একটি বিষয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে হলে সেটার পূর্ণ রূপটাকে বিবেচনায় নিতে হবে। হাতির একটি শুঁড় পুরো হাতির প্রতিনিধিত্ব করে না, বরং ভুল ধারণাই প্রদান করে।
সুরা বাকারা ১৭৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ কিছু বস্তুকে খাদ্য হিসাবে হারাম করেছেন, কিন্তু বলেছেন অনন্যোপায় হলে খেতে পার, আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন। তিনি বলেন, “তিনি তো হারাম করেছেন মৃত জন্তু, রক্ত, শুকরের মাংস এবং যা আল্লাহ ব্যতিত অন্য উপাস্যের প্রতি উৎসর্গ করা হয়েছে। কিন্তু কেউ যদি অনন্যোপায় হয়ে, লোভের বশবর্তী না হয়ে বা সীমালঙ্ঘন না করে তা ভক্ষণ করে তাহলে তার কোনো গোনাহ হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াময়।” (সুরা বাকারা ১৭৩)
লক্ষ্য করুন, এ আয়াতে আল্লাহ কয়েকটি বস্তু ভক্ষণকে হারাম করলেন, কিন্তু পরিস্থিতির চাপে পড়ে বা বিশেষ প্রয়োজনে কেউ যদি বাধ্য হয়ে খায় তাহলে তাকে তিনি ক্ষমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তী আয়াতে যেখানে আল্লাহ দীনের বিনিময়ে অর্থগ্রহণ করাকে ‘আগুন খাওয়া’ বললেন, তার পরে কিন্তু এটা বললেন না যে, অনন্যোপায় হলে, বিশেষ প্রয়োজনে খাওয়া যাবে এবং আল্লাহ সে অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন। এতে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, কোনো অবস্থাতেই, এমন কি মরে গেলেও আল্লাহর দীনের বিনিময়ে স্বার্থ হাসিল করা, অর্থ রোজগার করে, একে জীবিকার মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না।
যারা পথভ্রষ্ট ও ধর্মব্যবসায়ী তারা কীভাবে জাতির ধ্বংস বয়ে আনে সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ হলেও এখানে একটু উল্লেখ করে যেতে চাই। সুরা বাকারার ১৭৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ অল্প কথার মধ্যে সেই কারণটি উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, “যে কারণে এ শাস্তি তা হলো, আল্লাহ সত্যসহ কেতাব নাজিল করেছেন। এবং যারা এই কেতাবের বিষয়বস্তু নিয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি করে তারা চূড়ান্ত পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত।”
বস্তুত আল্লাহর দীন বিকৃত হয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে দীনের বিষয়বস্তু নিয়ে মতভেদ সৃষ্টি করা। এই কাজটি সাধারণ মুসলিমরা করেন না, এটা করেন যাদের দীন সম্পর্কে জ্ঞান আছে অর্থাৎ কথিত ধর্মজ্ঞানীরা। তাদের দীন সংক্রান্ত মতভেদের পরিণামে জাতিও তাদের অনুসরণ করে বহু ভাগে খ-বিখ- হয়ে গেছে এবং এখনও নতুন নতুন মতবাদে দীক্ষা নিয়ে এক উম্মাহকে আরো টুকরো টুকরো করে ফেলছে। সামান্য তারাবির সালাত ৮ রাকাত না ২০ রাকাত, নবী নূরের তৈরি না মাটির তৈরি এসব অনর্থক বিষয় নিয়ে তারা শত শত বছর বিতর্ক করে যাচ্ছেন।
একজন জীবিত মানুষকে যখন দুইটি টুকরো করা হয় সে আর জীবিত থাকে না, তেমনি আজ ১৬০ কোটি উম্মতে মোহাম্মদীর দাবিদার জনগোষ্ঠী অর্ধপৃথিবী জুড়ে বিরাট লাশের মত পড়ে আছে। হাজার হাজার ভাগে তারা খ-বিখ-। এই কাজটি করেছেন জাতির কথিত আলেম সাহেবরা, ফেরকা সৃষ্টিকারী ইমামগণ, দীনের অতি বিশ্লেষণকারী মুহাদ্দিস, মুফাসসির, মুজতাহিদ, মুফতিগণ, ভারসাম্যহীন সুফিবাদী পীর, মাশায়েখ, বুজুর্গানে দীনেরা। তারা তাদের অনুসারী তৈরি করেছেন, রসুলের (সা.) হাতে গড়া জাতি ছিন্নভিন্ন হয়ে প্রাণহীন লাশে পরিণত হয়েছে।